Bangladesh Liberation War

‘এ বাংলা হারতে জানে না’

সে দিন বনগাঁ সীমান্তে ‌শরণার্থী শিবিরে ইন্দিরা গান্ধীকে দেখেছিলাম, মাথা নিচু করে বাঁশের বেড়া গলে শরণার্থী শিবিরে ঢুকছেন।

Advertisement
বিকাশ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:৩৪

চার জন গাইঘাটা-বনগাঁর রাস্তায় চলেছি ভ্যানে চেপে। গন্তব্য বনগাঁ সীমান্ত। ইন্দিরা গান্ধী যাচ্ছেন শরণার্থী ‌শিবিরে, তাঁকে একটু চোখে দেখাই উদ্দেশ্য। মাথার উপর কপ্টারের আওয়াজ, “ওই ইন্দিরা গান্ধী যাচ্ছেন!” আমরা থাকি গোবরডাঙায়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উত্তাপ মেখে রয়েছি তখন, ১৯৭১-এ। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে গোবরডাঙা কাছেই, এ দিকেও পাকিস্তানের তিনটে ফাইটার প্লেন এসেছিল। ভারতীয় সেনা তাড়া করে দুটোকে বনগাঁর কাছে ফেলে দেয়, একটা পালায়।

আমরা তখন গর্বে উত্তেজিত। কলেজে, বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছি। তাঁদের পাশে বসে শুনেছি পাক মিলিটারি, রাজাকারদের বর্বরতার কথা। এক কোটির বেশি মানুষ তখন এ পারে। গোবরডাঙা, বনগাঁ, বারাসত লোকারণ্য। স্কুল-কলেজ, ফাঁকা বাড়ি, মাঠ, রাস্তা, স্টেশন সর্বত্র মানুষ। বাড়িতে দোকানে রেডিয়ো বাজছে। কয়েক স্টেশন আগের দত্তপুকুরে যাঁর নিবাস, সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাত্ত কণ্ঠে আমরা উজ্জীবিত। সঙ্গে উপেন তরফদার, বিভূতি দাস, প্রণবেশ সেন প্রমুখ। আর আছে দেশাত্মবোধক গান, খবরের কাগজে ছবি। পাক সেনাপ্রধান নিয়াজি পোশাকের ব্যাজ খুলে, রিভলভার থেকে গুলি বার করে জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দিচ্ছেন। দেখে আমাদের জয়ধ্বনি, “জয় ভারত, জয় বাংলা।”

Advertisement

সে দিন বনগাঁ সীমান্তে ‌শরণার্থী শিবিরে ইন্দিরা গান্ধীকে দেখেছিলাম, মাথা নিচু করে বাঁশের বেড়া গলে শরণার্থী শিবিরে ঢুকছেন। ভিতরে-বাইরে জয়ধ্বনি, সে সবে ভ্রুক্ষেপ নেই। পরদিন কাগজে সেই ছবি। ইন্দিরা যখন সহমর্মিতার হাত বাড়াচ্ছেন, শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে। ’৭১-এর ৭ মার্চ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। যার ফল, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনার পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে আসা, মুজিবকে গ্রেফতার, কারাদণ্ড। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও মুক্তিবাহিনী জমাট বেঁধে ছিল। তাঁদের সব রকম সাহায্য করে ভারত। সে ইতিহাস সবার জানা।

মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে পাক সেনার তাড়া খেয়ে এ দিকে চলে আসতেন, ক’দিন থেকে কিছু রসদ সংগ্রহ করে চলে যেতেন। এমন দু’জনের সঙ্গে এক রাতে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল বাড়িতে। রাত এগারোটার পর কংগ্রেসের এক স্থানীয় নেতা আমাদের বাড়িতে দিয়ে যান তাঁদের। মৃদু স্বরে বলেন, দেখ যদি সামান্য কিছু খাবার... মা বললেন, “রুটি, আখের গুড় আছেই, একটু আলু ভাজি?” দুই যুবক হইহই করে উঠলেন, “রুটি গুড় হলেই হবে কাকিমা।” তাঁরা আমার উঁচু তক্তপোশে শুতে রাজি হননি, মেঝেতে একটা মাদুরে জোর করে দেওয়া চাদরের উপর একটা পাশবালিশে দুজনে মাথা রেখে শুয়েছিলেন। জেনেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের খবর পাওয়ার পর থেকে তাঁরা মাটিতে শোন। পর দিন কাকভোরে তাঁদের নির্দিষ্ট জায়গায় দিয়ে আসি।

এর পরেই শরণার্থী শিবির তদারকিতে যোগ দিই। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের ক’দিন পরে ক’জন বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সে কী উচ্ছ্বাস সবার! মাটিতে গড়াগড়ি, মাথায় মাটির তিলক, কেউ পকেটে মাটি ভরছে বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে। চোখে জল এসেছিল। দেশের মাটি এমনই প্রিয়।

পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আসতে লাগল, শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে হবে। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে তিনি কারামুক্ত হলেন, প্রথমে ব্রিটেন, সেখান থেকে ভারত হয়ে নিজের দেশে। একের পর এক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে থাকল। ভারত তো সবার আগেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু কলকাতায় এলেন। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ইন্দিরা ও মুজিবের ঐতিহাসিক সভা। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সাজ সাজ রব। ভিড় ট্রেন এড়াতে মায়ের নির্দেশে দু’দিন আগেই কলকাতায় চলে এসেছিলাম। আগের রাতেই কলকাতা লোকে লোকারণ্য। শিয়ালদহ স্টেশন ভর্তি, উত্তর-দক্ষিণ কলকাতা সর্বত্র এক চেহারা। সকালে একটু বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে জনস্রোত আটকায়নি। সব রাস্তা দিয়েই মিছিল যাচ্ছে ময়দানে। সভায় দু’টি মঞ্চ পাশাপাশি। একটি অনেক উঁচু, সেখানে ইন্দিরা আর বঙ্গবন্ধু। অন্যটিতে দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র-নজরুল-অতুলপ্রসাদের বৃন্দগান। ইন্দিরা-মুজিব মঞ্চে আসামাত্র জনসমুদ্রে দোলা লাগল। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, কেন বাংলাদেশের হয়ে ভারত যুদ্ধে গিয়েছে। এর পর বঙ্গবন্ধু বলতে উঠতেই আবার সাত সাগরের সম্মিলিত গর্জন। বললেন, “এ বাংলা হারতে জানে না। আর আমাদের সংগ্রামকে ‘কামিয়াব’ করেছে ভারতের মিলিটারি, ভারতের জনগণ... যাঁরা এক কোটি সহায় সম্বলহীন বাংলাদেশের মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁদের আহার বাসস্থানের বন্দোবস্ত করেছেন।”

আমাদের রোমাঞ্চ হচ্ছিল। আর যখন আবৃত্তি করলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই...’ চোখ সজল হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের মতো তাঁর দেশেরও আদর্শ। বলেছিলেন, যে জাতি মুক্তিপাগল, তাকে বন্দুক-কামান দিয়ে ‘দাবায়ে’ রাখা যায় না। দেশে দেশে, যুগে যুগে এর চেয়ে সত্য আর কী!

আরও পড়ুন
Advertisement