Social Security

ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে অসংগঠিত শ্রমিকদের শিল্পনির্ভর পরিসংখ্যান কেন গুরুত্বপূর্ণ

ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে অসংগঠিত শ্রমিকদের শিল্প নির্ভর পরিসংখ্যান কিন্তু নীতিপঙ্গুত্ব এড়িয়ে, নীতিসক্ষম হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।

Advertisement
সুপর্ণ পাঠক
সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২২ ১৫:৩০

ছবি: পিটিআই

কলকাতার এক খ্যাতনামী বাচিক শিল্পী ও অভিনেতা জোট বেঁধেছেন এক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এঁরা দু’জনে মিলে ইউটিউবে শহরের রাস্তায়, জেলার দোকানে খেয়ে বেড়ান আর সেই খাওয়া নিয়ে, তার সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি নিয়েও হালকা চালে আলোচনা করেন। এই চ্যানেলটি দেখেন লক্ষাধিক মানুষ।

আমিও দেখি। সে দিন যেমন দেখলাম এক বিরিয়ানি বিক্রেতাকে। দক্ষিণ কলকাতায় রাস্তার ধারে বসে বিরিয়ানি বিক্রি করেন। তিনি এক সময়ে নাকি কোনও এক সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছিলেন। চাকরি চলে গেলে বাঁচার জন্য বেছে নেন রাস্তায় বিরিয়ানি বিক্রি। কথা প্রসঙ্গে উঠে এল লকডাউনের কষ্টের কথা। এবং জানলাম তাঁর সেই সময়ের অসহায়তার কথা।

Advertisement

ইনি ছিলেন দেশের রোজগেরে জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের উপর অসংগঠিত কর্মীদের এক জন। দৈনিক বিকিকিনি থেকে যেটুকু বাঁচে সেই সঞ্চয়কেই যিনি সামাজিক সুরক্ষা বলে মানতে বাধ্য হয়েছেন। ইনি জানেন না বয়সের কারণে অক্ষম হয়ে পড়লে বা কঠিন কোনও অসুখ হলে সংসার কী ভাবে চলবে!

বাঙালি যে শুধু বিরিয়ানি খায় তা নয়। চপ খাওয়ার চর্চাও রয়েছে। তা যে জারি আছে তা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই জানি। আজ আরও জানছি উত্তর সাম্মানিক স্তরের ছাত্রীর চপ শিল্পের উপর গবেষণা ঘিরে নেটমাধ্যম থেকে সংবাদমাধ্যমের উত্তাল হয়ে ওঠার কারণে।

গবেষণাপত্রটি পড়িনি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে পড়ে জানা যাচ্ছে যে একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে করা এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে পুরুষদের আয় মহিলাদের আয়ের থেকে বেশি। চপ বানিয়ে মহিলাদের আয় মাসিক ন’হাজার টাকা আর পুরুষদের আয় ১০ হাজারের বেশ খানিকটা উপরে।

এই তথ্যটি কিন্তু নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাথায় রাখতে হবে নিতি আয়োগের সমীক্ষা বলছে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের চাহিদার বৃদ্ধির হার ধ্রুবক হয়ে উঠছে। অর্থাৎ, অসংগঠিত ক্ষেত্রে আয়ের সূত্র হিসাবে কৃষি এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের জায়গা চাহিদার তুলনায় ছোট হয়ে উঠছে। যা অবশ্যই নীতি নির্ধারকদের দুশ্চিন্তার কারণ।

সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, চিকিৎসার খরচ যে হারে বাড়ছে তাতে বয়স্কদের একটা বড় অংশই সংগঠিত চিকিৎসা পরিকাঠামোর সুযোগ নিতে পারছে না। এমনকি নানান কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য প্রকল্পের আওতায় থাকা বয়স্ক নাগরিকদেরও বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ নিতে গেলে পকেট থেকে যে পরিমাণে টাকা খরচ করতে হয় তাও আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। মাথায় রাখতে হবে, সামাজিক সুরক্ষার অন্যতম দু’টি স্তম্ভ হল জীবনযাপনের ন্যূনতম মান বজায় রাখার উপযুক্ত আয় এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার।

ফেরা যাক চপ তথ্যে। আমরা কি জানি ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে কোন অঞ্চলে কত জন মানুষ, ঠিক কী ভাবে তাঁদের অন্ন সংস্থান করছেন? তাঁদের অঞ্চল ও পেশা ভেদে আয়ের বর্ণনা? এর উত্তর এক কথায়, ‘না’।

গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের সুরক্ষা রাষ্ট্রের দায়। আর সেই সুরক্ষা মানে শুধু বৈদেশিক হামলা বা ডাকাতি থেকে বাঁচানো নয়। সেই সুরক্ষা কিন্তু সামাজিকও। আমরা ভুলে যাই যে, কর ব্যবস্থার লক্ষ্য শুধু প্রশাসনের খরচ চালানোই নয়। এর অন্যতম লক্ষ্য হল সামাজিক সুরক্ষা। মাথায় রাখতে হবে রাজার ঘরে যা থাকে টুনির ঘরে তা অবশ্যই থাকবে না। (উপেন্দ্রকিশোর বললেও না। আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন তা জানতে বইটা পড়তে হবে।) কিন্তু বাঁচার অধিকার তো তারও আছে। তাই রাজার দায় কিন্তু টুনির বাঁচার দায় বহন করা। তার মানে এই নয় যে টুনির হয়ে রাজা তার শষ্য বহন করে দেবে। কিন্তু সে যদি তা বহন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে? সামাজিক সুরক্ষার দায় শুরু হয় এখান থেকেই।

সহজ উদাহরণের নানা সমস্যা। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার মূল কথাটা এটাই। রাজার দায় কিন্তু দেখা টুনির যাতে শষ্যের অভাব না হয়। তা করতে গেলে তাকে জানতে হবে টুনির চাহিদা। আর এখানেই আঞ্চলিক আর্থিক তথ্যের গুরুত্ব।

এই তথ্যের অভাব কী সমস্যা তৈরি করতে পারে তা লকডাউনের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার তাগিদে হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটেছেন। সরকার তাঁদের ঘরে ফেরার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। যার মূল্য চুকিয়েছেন অসংগঠিত শিল্পের এই শ্রমিকরা। যদি আঞ্চলিক স্তরে শ্রমিকদের তথ্য সরকারের কাছে থাকত, কোন রাজ্যের শ্রমিক অন্য কোন রাজ্যে গিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থান করছেন জানা থাকত, তা হলে নীতি নির্ধারকদের পক্ষেও এই সমস্যার সুষ্ঠু ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা সম্ভব হত। কিন্তু সরকার নিজেই স্বীকার করেছে এই তথ্যের অভাবের কথা।

একই সমস্যা কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৯৯-২০০০ সালে চা বাগান ঘিরে। শ্রমিকরা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারের ঘরে সুষ্ঠু ও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করতেই দুই বছর কেটে গিয়েছিল। সরকারের নিজস্ব তথ্যের অভাবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির কাছে এই সমস্যাকে একটা বড় চ্যালেঞ্জ করে তুলেছিল।

আবার অন্য ভাবে ভাবুন। মাথায় রাখতে হবে, প্রায় প্রতিটি পেশায় কিছু না কিছু স্বাস্থ্য-ঝুঁকি আছে। যেমন, স্বর্ণ শিল্পের কারিগরদের অ্যাসিডের ধোঁয়ায় থাকতে হয় দীর্ঘ ক্ষণ। যাঁরা মিষ্টি তৈরি করেন তাঁদের একটা বড় অংশই যে খুব একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করেন তা বলা যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যে অঞ্চলে যে শিল্পের ঘনত্ব সেই অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেই পেশার কারণে তৈরি স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা। অথবা, আমরা কি জানি কোন নাগরিক কোন দায়ে কোন পেশা বেছে নেন? তথ্যের সঠিক সঙ্কলন কিন্তু সাহায্য করে আঞ্চলিক পেশাভিত্তিক আর্থিক সহায়তা ও উপদেশ পরিষেবা তৈরি করতে যাতে এঁদের আয় বাড়ানো যায়। তৈরি করা যায় এমন এক আর্থিক সুরক্ষা বলয় যা সংশ্লিষ্ট নাগরিকের আজকের শুধু নয়, আগামীতেও নিশ্চিন্তে বাঁচার পাথেয় হয়ে উঠতে পারে।

আজকের আর্থিক পরিস্থিতিতে কিন্তু এই পরিসংখ্যানের অভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যখন ৮০ শতাংশের উপর নাগরিকের কাছে আয়ের সূত্র হয়ে উঠেছে অসংগঠিত শিল্প। ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে অসংগঠিত শ্রমিকদের শিল্প নির্ভর পরিসংখ্যান কিন্তু নীতিপঙ্গুত্ব এড়িয়ে, নীতিসক্ষম হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। আঞ্চলিক স্তরে সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও নির্দিষ্ট করে। এই তথ্য প্রয়োজনীয়, বিদ্রুপের লক্ষ্য না করে, এই তথ্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝা প্রয়োজন। এবং তা যাতে সরকারি স্তরে সংগৃহীত হয় তার দাবি জোরালো করে তোলা। তাতে হয়ত লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, বা চা শ্রমিকদের ওই তীব্র অসহায়তার মতো চ্যালেঞ্জকে সঠিক মোকাবিলা করা যাবে।

আরও পড়ুন
Advertisement