বাংলা সিনেমার সর্বভারতীয় গরিমা লোপের কারণটি রাজনৈতিক
Bengali Cinema

টালিগঞ্জের রাহুগ্রাস

১৯৫১ সালে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমার এই পরিণতি অভাবনীয় ছিল, কারণ তার আগের বছর কুড়িই বাংলা সিনেমার ইতিহাসের প্রকৃত স্বর্ণযুগ।

Advertisement
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২২ ০৫:১৩
শিখর: বাংলা সিনেমার প্রকৃত স্বর্ণযুগের ছবি মুক্তি-র (১৯৩৬) দৃশ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী

শিখর: বাংলা সিনেমার প্রকৃত স্বর্ণযুগের ছবি মুক্তি-র (১৯৩৬) দৃশ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী

যে অত্যাশ্চর্য দ্রুত গতিতে বাংলা সিনেমার পতন হয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। স্বাধীনতার ঠিক পরে, ১৯৫১ সালে, গণনাট্য সঙ্ঘের প্রাদেশিক কমিটির খসড়া প্রস্তাবে ঋত্বিক ঘটক লিখেছিলেন, “কলিকাতা ভারতীয় ফিল্মের দুটি প্রধান প্রাণকেন্দ্রের একটি।” তাঁর জানা ছিল না, এর ছ’-সাত বছরের মধ্যেই সর্বভারতীয় চালিকাশক্তির জায়গা থেকে সরে এসে কেবলমাত্র সাদা-কালো আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হবে বাংলা সিনেমা, আর কয়েক দশকের মধ্যেই ধুঁকতে ধুঁকতে কোনও ক্রমে বেঁচে থাকাই তার ভবিতব্যে পরিণত হবে। চলচ্চিত্রশিল্পী ও কলাকুশলীদের কলকাতা থেকে মুম্বইমুখী মহানিষ্ক্রমণ অবশ্য তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। এক বছর আগেই মুম্বই পাড়ি দিয়েছেন বিমল রায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, অসিত সেনের মতো ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তখন জানা ছিল না যে, এই একমুখী নিষ্ক্রমণের গতি ক্রমশ বেড়েই চলবে, এবং তার থামার কোনও লক্ষণ আর দেখা যাবে না।

১৯৫১ সালে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমার এই পরিণতি অভাবনীয় ছিল, কারণ তার আগের বছর কুড়িই বাংলা সিনেমার ইতিহাসের প্রকৃত স্বর্ণযুগ। না, উত্তম-সুচিত্রার সময় নয়, কারণ বাংলার ঘোষিত মহানায়ক ও নায়িকাকেও শেেষ মুম্বই দৌড়াতে হয়েছিল সর্বভারতীয় স্বীকৃতির আশায়। উল্টো দিকে, চল্লিশের দশকে প্রবাদপ্রতিম শিল্পী প্রমথেশ বড়ুয়া, মুম্বই থেকে অফার আসার পর নাকি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেন, “ওই বাজারের মধ্যে কে যাবে!” কানন দেবী কলকাতাতে বসেই পরিণত হয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম স্টাইল আইকনে।

Advertisement

ত্রিশ বা চল্লিশের দশকে এ সব ছিল খুবই স্বাভাবিক। সর্বভারতীয় মানেই মুম্বই— এই সমীকরণ তখনও দিনের আলো দেখেনি। কলকাতায় রাজত্ব করছে ভারতলক্ষ্মী বা ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির মতো বৃহৎ স্টুডিয়োগুলি। সবার উপরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কলকাতার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক বীরেন্দ্রনাথ সরকারের নিউ থিয়েটার্স, সংক্ষেপে এনটি— বাংলা সিনেমাকে নিয়ে যাচ্ছে ঈর্ষণীয় উচ্চতায়। ত্রিশের দশক থেকেই তৈরি হচ্ছে মুক্তি বা স্ট্রিট সিঙ্গার-এর মতো সর্বভারতীয় হিট। শৈল্পিক মানও এমন অভাবনীয় জায়গায় যে, ঋত্বিক ঘটকের মতো নাক উঁচু লোকও পরে প্রমথেশ বড়ুয়ার গৃহদাহ-এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। এনটি-তে শব্দগ্রহণ ব্যবস্থার তদারকিতে এসেছিলেন আমেরিকান শব্দবিশেষজ্ঞ উইলফোর্ড ডেমিং। তিনি নিউ থিয়েটার্স নিয়ে মুগ্ধ, আর মুম্বইয়ের কাজকর্মকে ‘আধাখ্যাঁচড়া’ আখ্যা দিয়েছিলেন। শোনা যায়, ডেমিং এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে, ‘টলি’র সঙ্গে ‘হলি’র ধ্বনিসাযুজ্যকে মাথায় রেখে তিনিই প্রথম টালিগঞ্জের ডাকনাম দিয়েছিলেন টলিউড। তিনি নাকি হলিগঞ্জ নামটার কথাও ভেবেছিলেন, সেটা রাখলে বলিউডের কী নাম হত, ভাবার বিষয়।

ডেমিং-এর পর, এনটি-তে ক্যামেরা এবং শব্দের দায়িত্বে ছিলেন, দুই দিকপাল নীতিন এবং মুকুল বসু, দ্বিতীয় জনের হাত ধরে প্রথাগত প্লে-ব্যাক সঙ্গীত প্রথম আসে ভারতে। সঙ্গীত বিভাগে ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, অসিতবরণ। এঁদের পরিচালনায় সামগ্রিক সঙ্গীত এবং শব্দগ্রহণ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রে গান এবং অভিনয়ের চালচিত্রই বদলে গিয়েছিল। চড়া দাগের অভিনয়ের বদলে এসেছিল ওঠানামা— তা সময়ের চেয়ে বহু বছর এগিয়ে ছিল। গানের ক্ষেত্রেও নিরীক্ষা এবং প্রয়োগ এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, বাংলাভাষী নয় এমন জায়গাতেও জনপ্রিয় গানগুলি, এমনকি রবীন্দ্রসঙ্গীত অবধি, লোকে হুবহু গেয়ে চলত।

সঙ্গে ছিল অভূতপূর্ব বিপণন কৌশল। তখনও ডাবিং প্রযুক্তি আসেনি। ফলে সর্বভারতীয় বাজারের জন্য তৈরি করা হত একই সিনেমার নানা ভাষার ভার্শন। চণ্ডীদাস থেকে মুক্তি পর্যন্ত প্রতিটি হিট ছবিরই হিন্দি ভার্শন তৈরি হয়েছিল, সেটাই ছিল দস্তুর। আর, মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি বানাত সিনেমার দক্ষিণী ভার্শন। ভারতলক্ষ্মীও পিছিয়ে ছিল না। স্টুডিয়োগুলির সমবেত উদ্যোগে কলকাতার ছবির অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটত দক্ষিণে তৎকালীন মাদ্রাজ অবধি। তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত উত্তর ভারত হয়ে সুদূর পশ্চিমের লাহোর পর্যন্ত। এই সময়েই কে এল সায়গল পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন। তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সর্বভারতীয় পরিচিতি এবং যশের আশায় কলকাতায় আসতেন অভিনয় করতে। এমনই ছিল কলকাতার জোর।

তাই, পঞ্চাশের শুরুতেও ভাবা কঠিন ছিল, এই বিস্তৃত ব্যবস্থা, নিপুণ নেটওয়ার্ক, এক দিন দুম করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! দশ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এই সর্বভারতীয় গরিমা! কিন্তু ঘটেছিল সে রকমই। না, কোনও অলৌকিক ঘটনা নয়, দক্ষতার অভাবজনিত কারণেও নয়। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা এ সবের পর পরই এসেছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দেশভাগ। বাংলার বহু কিছু ধ্বংস হওয়ার মূলেই দেশভাগ, কিন্তু সিনেমাশিল্পের মতো দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক প্রভাব বোধ হয় আর কিছুতে পড়েনি। স্বাধীনতার পর, এক শুভ প্রভাতে, বাংলা সিনেমা আবিষ্কার করেছিল যে, তার দর্শকসংখ্যা হঠাৎ কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। কারণ দু’-টুকরো বাংলায়, অর্ধেক সিনেমাহল চলে গিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। আর সদ্য তৈরি দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে সেই ভিনদেশে সিনেমা রফতানি অসম্ভব। দৌড়াতে থাকা একটা স্টিম ইঞ্জিনের সামনে হঠাৎই যেন উপস্থিত হয়েছে ভাঙা রেললাইন। সর্বভারতীয় হওয়ার লক্ষ্যে যে শিল্প দৌড়াচ্ছিল, নিজভূমেই, তার জায়গা হয়ে গিয়েছে অর্ধেক। অবস্থা এক ঝটকায় কতটা ভয়াবহ হয়েছিল, তৎকালীন বেঙ্গল মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির লেখায় সে চিত্র পাওয়া যায়— “মোটামুটি হিসেব করলে দেখা যায়, যে, বাংলার স্টুডিওগুলি তিন শিফটে কাজ করলে বছরে অন্তত ১৫০টি কাহিনীচিত্র তৈরি করতে পারে, কিন্তু রিলিজের এখন যা সুযোগসুবিধা, তাতে আমরা বড়জোর ৫০টি ছবিকে আঁটাতে পারি... দেশভাগের কারণে পূর্ব বঙ্গের বাজার এখন বাংলা সিনেমার হাতছাড়া।”

সঙ্গে বিষফোড়ার মতো আসে অর্থকরী সমস্যা। অবিভক্ত বাংলায় ১৮টা ব্যাঙ্কের প্রধান কেন্দ্র ছিল। দেশভাগের ফলে পঞ্চাশের দশকে এর সাতটাই সরাসরি লালবাতি জ্বালে। অন্য এক-তৃতীয়াংশ কোনও ক্রমে টিকে থাকতে আদালতের দ্বারস্থ হয়। নিউ থিয়েটার্স-এর অর্থলগ্নির মূল জোগানদার ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ঝাঁপ বন্ধ করে ১৯৫৪-৫৫’য়। বীরেন্দ্রনাথ সরকারের ছেলে দিলীপকুমার সরকার লিখছেন, “আমাদের লোকজন বোম্বে চলে যাচ্ছিল, অর্থের জোগানে প্রবল গোলযোগ, কোর্ট কাছারি চলছে, বাবা কার্যত দোকান বন্ধই করে দিয়েছিলেন।” সত্যিই নিউ থিয়েটার্স ঝাঁপ ফেলে দেয় ১৯৫৬ সালে। বছরখানেকেই অন্যান্য বড় স্টুডিয়োও একই রাস্তা ধরে। একই কারণে। স্বাধীনতার দশ বছরের মধ্যে বাংলা সিনেমার ভারতজয়ের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।

এর পরে যা হয়, তা, নেহাতই নিয়মরক্ষা। মুম্বই সিনেমার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনও ক্রমে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকার সংগ্রাম। মুম্বইয়ের তখন তুঙ্গে বৃহস্পতি। সেখানে অর্থলগ্নির সমস্যা কখনওই ছিল না। দেশভাগের ফলে কিছু বাজার হারালেও তা ছিল যৎসামান্য। এ ছাড়াও সে তখন পেয়ে গিয়েছে নতুন আন্তর্জাতিক বাজার। ১৯৫১ সালেই মুক্তি পায় আওয়ারা, পরের বছর রাহি। সে সব ভারতের বাইরেও সুপারহিট। কিন্তু সেটা এমনি এমনি হয়নি। সোভিয়েট বা ভারতে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সিনেমা আমদানি বা রফতানি অসম্ভব ছিল সে জমানায়। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সোভিয়েট ইউনিয়নে রীতিমতো বিপণন করা হয়েছিল এই দুই নায়ক এবং সামগ্রিক ভাবে মুম্বইয়ের হিন্দি সিনেমাকে। হঠাৎ কোনও জাদুমন্ত্রবলে রাজ কপূররা সোভিয়েট বা পূর্ব ইউরোপে পরিচিত নায়ক হয়ে যাননি। উল্টো দিকে বাংলা সিনেমা তখন টিকে থাকার লড়াই লড়ছে। মুম্বইয়ের জায়মান তারকাব্যবস্থার বিপরীতে কিছু অত্যন্ত শক্তিশালী শিল্পীরা সাদা-কালোয়, কম বাজেটে প্লটনির্ভর সিনেমাকে নিয়ে যাচ্ছেন অসম্ভব উচ্চতায়, উত্তম-সুচিত্রার পরবর্তী কালের জুটি যে প্রক্রিয়ার ফসল। কিন্তু সে সব ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমার একটাও কখনও সরকারি আনুকূল্যে বিদেশে রফতানি করা হয়নি। স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সব ভাষার সিনেমার সমমর্যাদা তো কখনওই ছিল না।

ফলে লড়াই হারারই ছিল। এর পর যা হয়েছে, তা গতিজাড্য মাত্র। কয়েক দশকের মধ্যেই বাংলা সিনেমা সঙ্কুচিত ও কুণ্ঠিত ‘আঞ্চলিক’ রূপ নিয়েছে। ১৯৫১ সালে বসে এর পুরোটা ঋত্বিক আন্দাজ করতে পারেননি। সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হল, পরবর্তী কালেও এ নিয়ে প্রায় সর্বাঙ্গীণ নীরবতা। এর মধ্যে বহু জিনিস আলোচিত হয়েছে। মুম্বইয়ের তারকা-ব্যবস্থা নিয়ে স্বয়ং ঋত্বিকই নিবন্ধ লিখেছেন। বাংলা সিনেমার সমস্যা ও ঘুরে দাঁড়ানোর পথ নিয়ে তো দশকের পর দশক ধরে লেখা হয়েছে, যার সর্বশেষ রূপ ‘বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান’ জাতীয় আহ্বান। কিন্তু বাংলা সিনেমা যে এমনি এমনি ধ্বংস হয়ে যায়নি, তার পিছনে একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছিল, যে প্রক্রিয়া একই সঙ্গে হিন্দি সিনেমাকে ‘ভারতীয়’ এবং বাকিদের ‘আঞ্চলিক’ অর্থাৎ প্রান্তিক বানিয়ে দিয়েছে, সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা নিয়ে কথা প্রায় হয়ইনি, বরং তা চলে গিয়েছে অন্তরালে। সিনেমা যাঁদের রুটিরুজি, সেই শিল্পী বা কলাকুশলীরা অবধি এর খোঁজ রাখেন না, এবং মুম্বই মানেই যে সর্বভারতীয়, এই ধারণাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে মুম্বইয়ের সামনে শ্রদ্ধায় নতজানু হন। বাংলা সিনেমার পতন এক বিরাট ট্র‌্যাজেডি, কিন্তু তার কার্যকারণ সম্পর্কে এই অদ্ভুত বিস্মৃতিও কিছু ছোট ট্র‌্যাজেডি নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement