এক দিকে সমাজমাধ্যমে সংবাদের বিস্ফোরণ ঘটেছে। অন্য দিকে, সাংবাদিকের ভূমিকা কী, তা নিয়ে লেখালিখি চলছে বিস্তর। পাশাপাশি, সাংবাদিকের ভূমিকার এক নতুন ছাঁচ তৈরি করার চেষ্টা চলেছে সরকারের তরফে। এর ফলে সংবাদজগতে একটা আলোড়ন শুরু হয়েছে।
সাংবাদিকের ভূমিকা কী? আমেরিকার এক সেনেটর বলেছিলেন, “সাংবাদিকের কাজ হল সত্যকে খুঁজে বার করে তাকে রক্ষা করা। সত্য না থাকলে আস্থা থাকে না, আর আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না।” লুইজ়িয়ানার এই সেনেটরের নাম জন কেনেডি, প্রবাদপ্রতিম প্রেসিডেন্টের সমনামী তিনি। এই কথাটাকে প্রায়ই উদ্ধৃত করেন ফিলিপিন্সের সাংবাদিক মারিয়া রেসা, যিনি এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন। তুরস্ক, বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া, ফিলিপিন্সের মতো দেশে সরকার নির্বাচিত হয়, কিন্তু সরকারের কাজ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হলেই শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে। নাগরিক সমাজ তখন এগিয়ে আসে। নির্যাতিত, অপমানিত সাংবাদিককে পুরস্কার দিয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠা ফিরিয়ে দেয়।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংলাপের সময়ে ভারত জাঁক করে যে, সে বিশ্বের ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’। কিন্তু দেশের মধ্যে আলোচনার যে পরিসর, সেখানে গণতন্ত্রে ঘাটতি ক্রমশই বাড়ছে। গণতন্ত্রে নাগরিক স্বাধীনতা মাপার যত রকম সূচক আছে, প্রতিটিতে ভারতের স্থান নিম্নগামী। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের ১৪২তম স্থান তারই অন্যতম প্রমাণ।
আজ ‘গণতন্ত্র’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে নাগরিকের ভোটদান। হয়তো সেই জন্যই দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যে সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন না, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন না, তা নিয়ে তেমন অস্বস্তি তৈরি হয়নি। সরকার মিডিয়ার ‘উপদেষ্টা’-র ভূমিকা নিয়েছে। কখনও কাগজ-চ্যানেলকে, কখনও ব্যক্তি সাংবাদিকদের সরকার বুঝিয়ে দিতে চায় মিডিয়ার সংজ্ঞা কী, সাংবাদিকের কাজ কী।
মিডিয়াকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা কখনও থাকে সূক্ষ্ম ও প্রচ্ছন্ন। আবার কখনও স্থূল ভাবেই বার্তা দেওয়া হয়— স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনের আধিকারিকদের কাজের তদন্তমূলক প্রতিবেদন, সরকারি নীতিকে প্রশ্ন করা বা সরকারের সমালোচনা, এ সব মেনে নেবে না সরকার। যাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন, তাঁদের গায়ে কাদা ছোড়া হয়। তা কেবল রাজনৈতিক রং লাগিয়ে নয়, সাম্প্রদায়িকতার রং লাগানোও ক্রমশ বাড়ছে। যাঁরা ‘নেগেটিভ’ খবর করেন— যেমন ধর্ষণ, বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কিংবা পবিত্র নদীতে ভাসমান দেহ— তাঁদের গ্রেফতার করা হয়, কঠোর আইনের অধীনে মামলা করা হয়, না হলে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা, যেমন সিবিআই বা ইডি, তাদের পিছনে লেগে যায়।
কোন খবরটা ‘নেগেটিভ’? সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সভায় বললেন, জেলার যে ছোট কাগজগুলি সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে ‘পজ়িটিভ’ খবর করবে, তারা সরকারি বিজ্ঞাপন পাবে। ‘নেগেটিভ’ বা নেতিবাচক খবর বোঝার উপায় কী, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। সাংবাদিকরা জানেন, যা জনস্বার্থের বিরোধী, সেটাই ‘নেগেটিভ’। সত্য, অর্থাৎ পরীক্ষিত তথ্য, সর্বদাই জনস্বার্থকে সুরক্ষিত করে। তাই সত্যকে প্রকাশ করাই সাংবাদিকের কাজ। প্রকল্পের রূপায়ণে যদি দুর্নীতি ও অপচয় হয়, তার তথ্য ‘পজ়িটিভ’ খবর। আজ ভারতে সর্বত্র ক্ষমতাসীনের স্বার্থবিরোধী তথ্য প্রকাশ করলেই সাংবাদিকের হেনস্থা শুরু হয়। বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়, কারাবন্দি হওয়াও আশ্চর্য নয়।
কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এক বছর ধরে জেলে। তিনি উত্তরপ্রদেশের হাথরসে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, এক দলিত কন্যার গণধর্ষণ ও হত্যার খবর পেয়ে। দুই তরুণী সাংবাদিক ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন সেখানকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর পেয়ে। ত্রিপুরার বিজেপি সরকার ‘ফেক নিউজ়’ প্রচারের অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করেছে। আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য কোনও অভিযোগ খুঁজে পায়নি বলে জামিন দিয়েছে। এই ঘটনা ঘটে এক সঙ্গে ১০২ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারায় মামলা দায়ের করার পর, যাঁদের অনেকেই সাংবাদিক। সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে এই ঘটনায়।
অথচ এ বছরের গোড়াতেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, সরকারের সমালোচনা করার জন্য কোনও সাংবাদিককে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে গ্রেফতার করা যাবে না, যদি না তিনি সরকারের বিরুদ্ধে, অথবা একাধিক সম্প্রদায়ের ভিতরে হিংসায় উস্কানি দিয়ে থাকেন। সাংবাদিকের গ্রেফতারের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে সরকার বার বার সংবাদের পিছনে ‘ষড়যন্ত্র’ দেখেছে, কিংবা ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ব্যাহত করার আশঙ্কা করেছে। নাগরিক সমাজ এবং সরকারের মধ্যে পরস্পর আস্থা ক্রমশ কমে আসছে, দু’পক্ষই তার নিজের মতো করে ‘সত্য’ তুলে ধরছে। সত্য ভুলে, আস্থা খুইয়ে গণতন্ত্র আজ যেন পথ হারিয়েছে।