গ্রামের সঙ্কটগুলির স্বীকৃতিই মেলেনি রাজনীতিতে

উন্নয়নের বিভ্রম

বাঁকুড়ার নারায়ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি বুথে বিরোধী জিতেছে বলে পানীয় জলের একমাত্র কলটি ভেঙে দিয়ে গিয়েছে কারা। মন্ত্রী উদয়ন গুহ-সহ বহু নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন, দল না জিতলে রাস্তা, জল হবে না।

Advertisement
স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৩ ০৭:০২

Sourced by the ABP

একটা ছোট সুটকেস। তার মধ্যে যা কিছু ধরে, কেবল সেটুকু নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। আর কখনও ফেরা হবে না। হাতে সময় কয়েক মিনিট। নতুন হিন্দি ছবি বাওয়াল এমন এক মোড়ে এনে ফেলে তরুণ নায়ককে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস-জড়িত স্থানগুলিতে গিয়ে ভয়ানক অতীত যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে লখনউ-এর অজয়ের কাছে। এক দৃশ্যে তার পিছনে দাঁড়িয়ে দুই বন্দুকধারী জার্মান সৈনিক, সামনে খোলা সুটকেস। অজয় যেন এক ইহুদি। প্রথমে বাক্সে ভরে জুতো, সুগন্ধীর বোতল। তার পর সে সব ছুড়ে ফেলে ভরতে থাকে বাবা-মায়ের ফটো, হনিমুনের স্মারক।

Advertisement

দেখতে দেখতে মনে হয়, তাই তো, যদি কেবল একটা বাক্সেই ভরতে হয় যা কিছু সম্বল, তবে কী ভরব— মার্কশিট-চেকবই, না কি বিয়ের অ্যালবাম? সদ্য-কেনা জ্যাকেট, না কি শৈশবসঙ্গী খেলনা ভালুক? যা কিছু ভরা গেল না, তার ভার বইতে হবে চিরদিন। নিজের অক্ষমতা, নির্বুদ্ধিতায় চিরদোষী হয়ে বাঁচতে হবে।

ব্যালট বাক্সের সামনে তেমনই কি দশা হল না আমাদের? যদি রাখতে হয় সরকারি সহায়তার খুদকুঁড়ো, স্বগৃহে বাসের শান্তিটুকু, সেচের জল পাওয়ার আশা, তা হলে জায়গা হবে না স্বাধিকারের— প্রশ্ন করার জোর, জবাব তলবের সাহস। এমনকি নিজের ভোট নিজে দিতে পারার ক্ষমতা, গরিবের যা প্রাণের ধন, তা-ও আঁটবে না। এক অসরকারি সংস্থার কর্মী বলছিলেন, বিরোধী জিতলে কেবল লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকাই বন্ধ হবে না, ঋণের দরখাস্তও না-মঞ্জুর হবে, জানিয়ে দিয়েছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্ঘ, মহাসঙ্ঘের নেত্রীরা। মেয়েরা যখন শুনেছে, তাদের ভোট ‘হয়ে গিয়েছে’, নীরবে ফিরে এসেছে। খবরে প্রকাশ, বাঁকুড়ার নারায়ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি বুথে বিরোধী জিতেছে বলে পানীয় জলের একমাত্র কলটি ভেঙে দিয়ে গিয়েছে কারা। মন্ত্রী উদয়ন গুহ-সহ বহু নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন, দল না জিতলে রাস্তা, জল হবে না।

ক্ষুদ্র সেচ দফতরের এক আধিকারিক গল্প করছিলেন, পুকুরের জল কাজে লাগিয়ে তাঁরা এক সারি নারকেল গাছ পুঁতেছিলেন পশ্চিমাঞ্চলের কোনও এক পঞ্চায়েতে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নতুন দল ক্ষমতায় এসে কেটে দিয়েছিল আগের পঞ্চায়েত বোর্ডের মেয়াদ কালের সেই গাছগুলো। সবে হাত চারেক লম্বা হয়েছিল। আহা, কী দোষ করেছিল ওই কচি গাছগুলো? সরকারি খরচে লাগানো, বড় হয়ে নারকেল দিলে তো গ্রামের মানুষেরই লাভ হত! কিন্তু না, তা হলে নাগরিকের ইচ্ছেমতো ভোট, আর সরকারি প্রকল্পের ফল, এ দুটো এক বাক্সে আঁটাতে হত। তাই কাটতে হয়েছিল গাছগুলো। রাজনৈতিক দল হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকল্পের ঠিকাদার।

রাজনৈতিক দল যত সংগঠন-ভিত্তিক থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়েছে, ততই ব্যক্তির হাতে এসেছে গ্রামবাসীর ভাগ্যের বরাত। রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বা কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী— ব্যক্তিই দল। এমনকি, ব্যক্তিই প্রশাসন। আধিকারিকের প্রতি তাঁর নির্দেশই উন্নয়নের নীতি। প্রচারসভায় তাঁর প্রতিশ্রুতিই উন্নয়নের প্রকল্প। সরকারি স্কিমের নামকরণে, লোগোতে, বিজ্ঞাপনে, ব্যক্তিরই স্বাক্ষর। তাতে বাজেট-বহির্ভূত ব্যয় কত বাড়ল, প্রশ্ন করতে ভয় হয়, যদি তিনি রাগ করেন?

তা বলে প্রশ্ন কি ছিল না? গত পাঁচ-সাত বছরে গ্রামীণ উৎপাদন ও শ্রমব্যবস্থার উপর যে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার কিছুমাত্র প্রতিফলন হয়নি রাজ্যের নীতিতে। চাষে লাভ নেই, পরিযায়ী শ্রমিকের হার বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে, প্রায় সব ধরনের কাজে দিন-প্রতি বা পিস-প্রতি মজুরি কার্যত কমছে, তাঁতিরা ব্যাপক হারে কাজ হারাচ্ছেন, গ্রামীণ রোজগার বৃদ্ধির হারকে বহুগুণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার। সমাধান দূরে থাক, এগুলি ‘সমস্যা’ বলে উঠেই এল না পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারপর্বে। আর্তের দুয়ারে ‘উন্নয়ন’ বলে যা এসেছে, তা আসলে ত্রাণ। একটু চাল, একটু টাকা। তা দিয়ে দিন গুজরান হয়, দিন বদলায় না।

এই রাজনীতির বিপরীতে রয়েছে সংবিধান, যা বলেছিল দরিদ্রের সক্ষমতার কথা। গ্রামের মানুষই গ্রামের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের নকশা তৈরি করবে। সেই ‘সহভাগী পরিকল্পনা’ কেমন, হাতে-কলমে করে দেখিয়েছিলেন অধ্যাপক অজিত নারায়ণ বসু। তাতে ধরা পড়েছিল, গ্রামের উৎপাদনের কে কতটুকু পায়। বর্ধমানের বিঘড়া-বামুনিয়ার পরিকল্পনার রিপোর্ট (২০০২) থেকে দেখা গিয়েছিল, আমন ধানের থেকে মোট আয়ের ২৯ শতাংশ পেয়েছিলেন খেতমজুর, জমির মালিক ৩৮ শতাংশ, এবং ব্যবসাদার ৩৩ শতাংশ। ফসলের ন্যায্য দাম, শ্রমের ন্যায্য মজুরি যদি গ্রামের মানুষ পায়, সরকারি প্রকল্পের দরকারই হয় না। অজিতবাবু লিখছেন, বাজারকে ন্যায্য করার দাবি যাতে না ওঠে, সেই জন্যই রাজনৈতিক দল এই ধারণা তৈরি করে যে, সরকারি প্রকল্প দিয়ে দারিদ্র দূর করা সম্ভব। এ এক সামূহিক সম্মোহন।

সম্মোহন থেকে হয় স্মৃতিবিভ্রম। বাংলাতেই কি হয়নি তেভাগা আন্দোলন, ভূমি সংস্কার? পঞ্চায়েতব্যবস্থা কি সে ধারাতেই আসেনি? মানুষের দুয়ারে প্রশাসনকে আনার চাইতে, প্রশাসনের ঘরে মানুষের চেয়ার পেতেছিল বাংলারই রাজনীতি। সে দিনের রাজনীতি প্রশ্ন করে, আমাকে বাক্স ধরানোর তুমি কে? গ্রামের নদী, বালি, খাদান, নয়ানজুলি, সবই তো জনসম্পদ। গ্রামের মানুষকে নিয়ে গ্রামের সম্পদের বিশদ ‘রেজিস্টার’ তৈরি করেছিলেন অজিতবাবু। তার স্বত্ব ছিল গ্রামসভার। আজকের রাজনীতি গ্রামবাসীর প্রাণের স্বত্বও তুলে দিচ্ছে দলের হাতে। বালিয়াড়ি, খড়ি খাদান, জমি-ভেড়িকে কোনও এক ব্যক্তির দখলে আনতে গ্রামের মানুষ বোমা বাঁধছে, গুলি খাচ্ছে, এ ওকে পিটিয়ে মারছে। তবু যা নিজের, তা নিজের বলে দাবি করতে পারছে না। গ্রাম সংসদ সভা ডেকে তলব করছে না বালি চুরি, কয়লা চুরির হিসাব। অথচ, সংবিধান সেই শক্তি গ্রামবাসীকে দিয়েছিল। গ্রামসভায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতা যে কেড়ে নিয়েছে, সে যে ভোটবাক্স কেড়ে নেবে, তাতে কি অবাক হওয়া মানায়?

কেন আমার হাতে বাক্স, আর পিছনে সৈনিক? কেন সংবিধানের ভিতে তৈরি স্বাধিকারের বসতবাড়ি ছেড়ে শাসক-নির্দিষ্ট কোনও ‘গেটো’ (ভোটব্যাঙ্ক) হবে আমার স্থান? প্রশ্নগুলো আজকাল সাংবাদিক বন্ধু, অধ্যাপক বন্ধুরাও ‘বড্ড বেসিক’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। অগতির গতি রবীন্দ্রনাথ। একটি ইংরেজি দৈনিককে একটি চিঠিতে (৫ অগস্ট, ১৯২৬) তিনি লিখছেন, ক্ষুদ্র মানুষ বৃহদাকার নেতা হয়ে ওঠে কী করে। এমন নয় যে লোকগুলো অসাধারণ শক্তিমান। কিন্তু তারা যাদের নেতৃত্ব দেয়, সেই সব মানুষের কিছু অসাধারণ দুর্বলতার প্রতিনিধিত্ব করে ওই নেতারা। “তার ফলে এক মরীচিকা তৈরি হয়, যা সত্যকে ভ্রান্তি বলে দেখায়, এবং আমাদের কল্পনায় সম্ভ্রম-মিশ্রিত মুগ্ধতা আর অত্যুচ্চ প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে।” বিমোহিত হয়ে এমন ভ্রান্তির কাছে নতিস্বীকার একটা গোটা যুগের লজ্জা, লিখছেন তিনি।

এই সেই লজ্জা, যা পঞ্চায়েত ভোট এলেই গ্রাস করে আমাদের। যখন দেখি গ্রামের কোনও মেয়ে বলছেন, বিরোধী প্রার্থী হয়ে জেতার পরে তিনি উন্নয়নের স্বার্থে ‘স্বেচ্ছায়’ যোগ দিয়েছেন শাসক দলে, তখন মনে হয়, যেন আমারই পিছনে দাঁড়িয়ে দুই সৈনিক। সামনে খোলা বাক্স। পিঠে গুলি লাগার আগে নিজেরটা গুছিয়ে নাও।

আরও পড়ুন
Advertisement