দেশ বললে মনে পড়ে ভিটেমাটি, সদর দরজা। আর রাষ্ট্র বললে— ভোটার কার্ড, সীমান্ত, আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর কথা। অনেকেই দেশের বাড়ি বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। কেউ সপ্তাহান্তে দেশের বাড়ি যান, কেউ পুজোয়। জীবনে অন্তত এক বার কাঁটাতারের ও পারে ফেলে আসা ‘দেশ’ ছুঁয়ে আসার স্বপ্ন দেখেন কেউ। এই দেশের ভিতরেই যে বাড়ির ছেলে যুদ্ধ থেকে অঙ্গ হারিয়ে বা পতাকা জড়ানো কফিনবন্দি হয়ে ফিরেছে, সেই সব পরিবার জানে, রাষ্ট্র কী। জানে স্বাধীনতা দিবসে পতপত ওড়া পতাকা, বীরের পদকের অর্থ।
ভারতে দেশীয় জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় জীবনের এক সমান্তরাল যাত্রা আছে। রাষ্ট্রীয় জীবনের ওঠাপড়া দেশ তথা সমাজজীবনে প্রভাব ফেলতে পারেনি কখনও। তবে বিদেশি শক্তি দ্বারা রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সমাজদেহে তার উত্তাপ অনুভূত হয়। সম্পদহানি, লুট, অত্যাচার বাড়ে। দেশ-কাল ভেদে এ নিয়ম ধ্রুব। যদিও রাজত্ব করতে আসা বিদেশি শক্তি ক্ষমতাসীন হলে কর কাঠামোয়, প্রথা ও রীতিনীতিতে বদল দেখা গিয়েছে। ক্ষমতাসীন শক্তি সমাজের উপর লুটতরাজ চালায়নি। খাজনা জমা করতে গিয়ে প্রজা জেনেছে, রাজশক্তির বদল ঘটেছে।
রাজ-শাসনে পাইক-পেয়াদারা ঘুরে বেড়াত, শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ ছিল তাদেরই। অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করত সৈন্যরা। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের যাত্রায়, অন্য ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের মতোই ভারতেও আন্তর্জাতিক সীমানা রক্ষা ও বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করে সৈন্যবাহিনী। দেশের ভিতরে রাজ্যগুলিতে শৃঙ্খলার দায়িত্ব পুলিশের। আর সীমান্ত থেকে চেকপোস্ট পর্যন্ত দূরত্বে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান রোখে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বিএসএফ-কে সম্প্রতি বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বিএসএফ গ্রেফতার, তল্লাশি ও বাজেয়াপ্ত করার কাজ করতে পারবে। আগে এই সীমা ছিল ১৫ কিমি। এ ছাড়া সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মণিপুর ও লাদাখে তল্লাশি, গ্রেফতার করতে পারবে। নয়া নির্দেশিকায় উত্তর-পূর্বের চার রাজ্যে এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়নি, জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের ক্ষেত্রেও না।
কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি— জাতীয় সুরক্ষা, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান রোধ ইত্যাদি। ভারতীয় ভূখণ্ডের সর্বত্র যে কোনও নাশকতামূলক কাজের তদন্ত করতে সক্ষম এনআইএ, দেশে মাদক বিষয়ক অপরাধের তদন্ত করতে সক্ষম এনসিবি। রাজ্যের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী আছে, আছে গোয়েন্দা সংস্থা। বিএসএফ, এনআইএ বা এনসিবি-র মতো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী নয়, তা সত্ত্বেও জাতীয় সুরক্ষার কথায় বিএসএফ-এর মতো আধা সামরিক বাহিনীর হাতে দেশের ভূখণ্ডের এতটা অংশ তুলে দেওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ নিয়ে বিরোধিতায় রাজ্যগুলি সরব। যে আধা সামরিক বাহিনীর কর্তাদের নাম জড়িয়েছে পাচারচক্রে, সিবিআই-তদন্তে যাঁরা তলবনামা পান, তাঁদের হাতে দেশের আরও বড় অংশ কেন তুলে দেওয়া হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে বিএসএফ-এর এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা বাড়ানোর প্রস্তাবের বিপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ১১২-৬৩ ভোটে প্রস্তাব পাশ হয়। কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে পঞ্জাব, অসমও। শুরু হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে তরজাও। জাতীয় সংহতি বনাম যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ— এই দ্বৈরথ থাকবেই। একটু অন্য ভাবে দেখলে বোঝা যাবে, এ আসলে নিরিবিলি সমাজজীবনে হইহই রাষ্ট্রীয় অনুপ্রবেশ। রাজপুরুষের ঘোড়ার খুরের শব্দ ও আজকের সেনার ভারী বুটের শব্দের মধ্যে মিল, দুটোই জনমনে পর্যাপ্ত ভয় তৈরিতে সক্ষম। এ ভয় রাজরোষে পড়ার ভয়, বিনা বিচারে মৃত্যুর বা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ভয়।
রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের সীমানার কাছাকাছি থাকা মানুষের জীবন নগরজীবনের থেকে আলাদা। সীমান্তের ও পার থেকে ছুটে আসা মারণাস্ত্রের আঘাত বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কা ঘনালে বাস্তুচ্যুত হওয়া— এ সমস্ত ভবিতব্য মেনেই বাস করে সেখানকার জনপদগুলি। সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে এলাকার বাসিন্দাদের সম্পর্ক যে খুব মধুর তা-ও নয়। যে কোনও সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী যে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা ভোগ করে, সমাজজীবনে তার অবাধ প্রয়োগ জীবনের ছন্দ ব্যাহত করতে পারে।
ব্যক্তি ও তার সমাজজীবনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় জীবনের দূত ভারতীয় সংবিধান। পুলিশ, সেনা, আধা সামরিক বাহিনী ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সংবিধানের ক্ষমতাতেই পুষ্ট। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সীমানা সুরক্ষার প্রশ্নে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সেই অর্থে কোনও প্রকৃত বিকল্প নেই। তা সত্ত্বেও, সীমান্তের উত্তাপ ও উদ্দীপনা দেশের ভিতরে এগিয়ে এসে কোনও ভাবেই যেন সমাজজীবনের স্থিতি বিঘ্নিত না করে, রাষ্ট্র যাঁরা চালান তাঁদের তা মনে রাখা দরকার।