Parents and Teachers

শাসন করা তারেই সাজে

নতুন অর্থনীতি, নতুন শিক্ষানীতি, ক্রমহ্রাসমান নিশ্চিত চাকরির কারণে আমরা অসহায়, চিন্তিত। সন্তানকে দৌড়-প্রস্তুত করে মানুষ করছি। কার কত উপার্জন— তার কথাই ক্রমাগত বলেছি সন্তানকে।

Advertisement
ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫৫

এখন সারা বছরই পরীক্ষার সমারোহ। জানুয়ারিতে যদি কলেজের সিমেস্টার ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা হয়, পুজোর ছুটি ইত্যাদি বাদ দিয়ে, সামান্য কিছু মাস হাতে থাকে। তার মধ্যে যথাসাধ্য পড়িয়ে ছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে তৈরি করা, সন্তানকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে রওনা করার অনুভূতির সমান।

Advertisement

ঠাকুমা এমনটা করতেন, ডাব নিয়ে দাঁড়াতেন মা, টিফিন খেয়েই পরীক্ষার হলে। জিজ্ঞাসা করতেন, কেমন পরীক্ষা হল। ঘাম মুছিয়ে, পিঠে হাত বুলিয়ে পরবর্তী পরীক্ষা যেন সুস্থ ভাবে দিই— স্নেহ, সমর্থন, আশ্বাস ছিল তার জন্য। অধ্যাপকের সঙ্গে সাক্ষাতেও একই অনুভূতি। অধ্যাপক বলতেন, পরের পরীক্ষার কথা ভাবো, আগের ভুল নিয়ে ভাবতে নেই।

জীবনপথে মনে পড়েছে তাঁদের। নিজে শিক্ষক হয়ে বুঝেছি, এমন করে কেউ শেখাতে পারতেন না। অভিভাবক যেমন, শিক্ষকও তেমন। শাসন, বকাবকি করবেন না তো কী? কিন্তু শাসনের মধ্যে বইত স্নেহ, যা মনে করায়, কেন বড় হলাম— আর তো কেউ বলবে না, পরের পরীক্ষাটা ঠিক ভাল হবে।

তা হলে শাসন? খুব জনপ্রিয় কথা ‘ডিসিপ্লিন’? তার স্থান কোথায়? এই বাজার অর্থনীতির যুগে তার গায়েও কি লেগে থাকে স্নেহ? না কি, যে সন্তান যে ছাত্র পরীক্ষার ফলাফলের মাপকাঠিতে উতরোতে পারে না বা আপাতসফল নয়, তার জন্য বরাদ্দ থাকবে শুধু শাসন, স্নেহ নয়?

নতুন অর্থনীতি, নতুন শিক্ষানীতি, ক্রমহ্রাসমান নিশ্চিত চাকরির কারণে আমরা অসহায়, চিন্তিত। সন্তানকে দৌড়-প্রস্তুত করে মানুষ করছি। কার কত উপার্জন— তার কথাই ক্রমাগত বলেছি সন্তানকে। সন্তানের বন্ধুকে প্রশ্ন করেছি, কী কী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিচ্ছে? সে বেঙ্গালুরুতে পেলে, তুমি চেন্নাইতে পেলে না কেন জাতীয় অনর্থক প্রশ্ন করেই চলেছি। একই ভাবে ছাত্রছাত্রীকেও বলেছি, এ ভাবে চাকরি পাবে না। খুব চটপটে, ধোপদুরস্ত হতে হবে। নয়তো ইন্টারভিউতে টিকবে না। আর কর্পোরেটে না পেলে জীবনে কী হবে?

দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিখ্যাত অধ্যাপক, বিখ্যাত ছাত্রছাত্রীর জীবনধারণ দেখায়, মোটেই পাটভাঙা প্রস্তুতি নেই তাতে। যে ছাত্রীটি গ্রামে গিয়ে পড়াতে চায়, তার মুখে ভয়ের ছায়া। সত্যিই বিজ্ঞাপনের মডেলের মতো ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠতে হবে? নয়তো উপায় নেই?

এই পক্ষপাতমূলক দিক-নির্ধারণে অবধারিত ভাবে যুক্ত মানসিকতা— আমি অভিভাবক হয়ে যা বলছি, তা-ই ঠিক। ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে যাদের উপরে এই মনোভাব চাপানো, তারা কিন্তু জড় পদার্থ নয়। জীবন্ত মানুষ, দুঃসহ আঠারো পেরিয়েছে সবে।

শিক্ষক, অধ্যাপক বলে আমার ক্ষমতা আছে নম্বর না দেওয়ার, ক্লাসে ঢুকতে না দেওয়ার। সেই আপাত-সামান্য ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভয় দেখাচ্ছি: কথা শোনো, নইলে পরীক্ষায় বসতে দেব না। আরও কত কড়া হতে পারি, বুঝতেও পারছ না।

এই ভয় দেখানোর সংস্কৃতির বা যা সম্প্রতি ‘থ্রেট কালচার’ নামে পরিচিত হয়েছে, তার খবর রাখে কে? প্রতিবাদই বা করে কে?

প্রতিবাদ হয়তো সম্ভব সংগঠিত হলে। সেই সুযোগ থাকলে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, ঘেরাও চলে। যদি সে ভাবে সংগঠিত না হয় পড়ুয়ারা? কে পাশে দাঁড়ায়? কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষা ছাত্রীদের কথা, শারীরিক, মানসিক অসহায়তার কথা বোঝেন। যে অধ্যাপিকা অভিযোগ এনেছেন, তাঁর বিপক্ষে গিয়েও এমন অবস্থান নিতে দেখেছি।

তাতে হয়তো কোনও ক্রমে সেই মুহূর্তে ছাত্রীটি কোপদৃষ্টি থেকে বাঁচল। কিন্তু ছাত্রীটির প্রতি অধ্যাপকের মন্তব্যে প্রকাশিত মনোভাব বড় দুঃখের, অনভিপ্রেত। “তুমি জানো না, ওরা অত্যন্ত চালাক। সুযোগসন্ধানী।” মুখোমুখিই ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে চোখাচোখা বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। মনে থাকে না, একই ব্যবহার তারাও ফেরাতে পারে। না ফেরানোর কারণ জিনলালিত শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা। যে অধ্যাপক, শিক্ষক আমাদের বা আমাদের অভিভাবকদের পড়িয়েছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের উত্তরাধিকার থেকে ছেঁকে নেওয়া লাভটুকু। কর্পোরেট ভাষ্যে ‘ডিভিডেন্ড’।

বরং হয়তো বেশি কাঙ্ক্ষিত সেই উপাচার্য মানুষটির মতো, প্রশ্রয়-মিশ্রিত ভাবেই ঘেরাও হয়ে থাকা। প্রতিবাদ অবস্থানের জন্য বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর স্নেহ, প্রশ্রয়ের কাছে হার মেনেছিল, সাক্ষ্য হয়তো দেবে সকলেই। পুলিশ, শাস্তির ব্যবস্থার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তিনি অধ্যাপক, শাসক নন। কিন্তু যে অধ্যাপক বা শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর শাস্তির ব্যবস্থা করেন, ভয় দেখান পরীক্ষার সময় উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে— তিনি আসলে কে?

সেই অভিভাবক যিনি নিজের সব না পাওয়া, সন্তানের উপর, ছাত্রছাত্রীর উপরেও চাপান? সন্তানকে ইঁদুর দৌড় শিখিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীকেও তা-ই। যদি পারো— অনেক উপহার তোমার জন্য। না পারলে আছে ভয়াবহ জীবন। অভিভাবক হয়ে, অধ্যাপক হয়ে ভারী ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন বোধ হয় আমাদের। তাই সেই ভীতি চারিয়ে দিতে চাই তাদের মধ্যে। অভিভাবকের কাছে সন্তান ছাত্রছাত্রীরা তো ভরসাটুকুই চায়। “কিছু হয়নি, ঠিক হয়ে যাবে”— এইটুকুতেই তার কষ্টের অনেকটাই চলে যায়। আমরা এইটুকুও বলতে পারি না! বরং বলি, আগেই বলেছিলাম ওই প্রবেশিকা তোমার দ্বারা হবে না, জীবনে কিছুই করতে পারবে না।

হয়তো আপাতভাবে শাসন নয়। কিন্তু পরীক্ষায় অসাফল্য যা করতে পারেনি, এই কথা সেই ক্ষতি করে দিল। একে কী বলে? শাসন করে শুধরে দেওয়া? ঠিক পথ দেখানো?

Advertisement
আরও পড়ুন