COVID-19

ঘুরতে যাওয়া নেই, ভেস্তে যাচ্ছে উৎসব, করোনার এই সময়ে আমাদের কি ভূতে পেল!

আজ শহরের রাস্তায় মাস্ক ছাড়া হেঁটে যাওয়া, অন্য মানুষের জীবন বিপন্ন করা ‘নসফেরাতু’- র কাউন্টরলোকের মতন ভ্যাম্পায়াররাও যেন ঘুরছে।

Advertisement
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:১১
শতকের পর শতক— ফিরে আসা বিশ্বজোড়া মহামারির যোগসূত্র কোথাও যেন ‘নসফেরাতু’কে ঘিরে থেকে গিয়েছে। 

শতকের পর শতক— ফিরে আসা বিশ্বজোড়া মহামারির যোগসূত্র কোথাও যেন ‘নসফেরাতু’কে ঘিরে থেকে গিয়েছে।  গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ

১০০ বছরেরও আগে জার্মান খবরের কাগজে অদ্ভুত এক ‘সন্ধান চাই’ বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। একটি সিনেমা প্রোডাকশন হাউস তাদের অভিনয়ের প্রয়োজনে ৩০-৫০টি জীবন্ত ইঁদুর চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কারণ, সেই বছর গ্রীষ্মে উত্তর জার্মানির উইসমোর শহরে একটি সিনেমায় অভিনয় করার জন্য ইঁদুরগুলিকে প্রয়োজন।

সিনেমাটি ‘হরর সিনেমা’র আদিপর্বের একটি বহুল চর্চিত নাম— ‘নসফেরাতু’। ভ্যাম্পায়ারের ভয় কী ভাবে সারা শহরকে ছেয়ে ফেলছে এবং তার সঙ্গে সামাজিক অনেক বিষয়ই এই চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু সিনেমাটিতে অনেক ইঁদুরের প্রয়োজন হয়েছিল কেন, তার কারণটা হয়তো এই সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। শতকের পর শতক— ফিরে আসা বিশ্বজোড়া মহামারির যোগসূত্র কোথাও যেন ‘নসফেরাতু’কে ঘিরে থেকে গিয়েছে।

Advertisement

এমনিতে এই ছবিতে ভ্যাম্পায়ার কাউন্টারলোকের ভয়ে সারা শহর খাঁ-খাঁ করছে। তার সঙ্গে কোয়রান্টিন বা নিভৃতবাসে ঘরবন্দি হয়ে থাকার নির্দেশ আজকের সঙ্গে যেমন মিলে যায়, তেমনই সারি সারি ইঁদুরের ছুটে চলা কোথাও গিয়ে প্লেগের সময়কে মনে করিয়ে দেয়। জাহাজের দৃশ্যে ঝাঁক বেঁধে ইঁদুরের নেমে আসা প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার রূপকল্প যেন। ভূতের সঙ্গে মহামারি কয়েক শতক জুড়ে এ ভাবেই মিশে যায়।

তবে স্থান-কাল-প্রতিবেশ আর সভ্যতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামারি আর ভূত দু’জনেই ভোলবদল করেছে। মহামারির ইতিহাস খুঁজতে গেলে বাংলা সাহিত্যে দেখা যাবে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার পর জামাই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসে অনুভব করছে, সেখানে কেউ আর বেঁচে নেই। এই সময়ে ঠিক তেমন অভিজ্ঞতা আর তৈরি হবে না ঠিকই, বরং করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অনেক দিন কারও সঙ্গে কথা না হলে বা অসুস্থ হয়েছে জানতে পেরে হোয়াটসঅ্যাপের ‘লাস্ট সিন’ অনেকক্ষণ আগে হয়েছে দেখতে পেলে চিন্তাই হয়েছে। মাথার ভিতর জমাট বেঁধেছে অনির্দেশ্য আশঙ্কা। এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা তো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী জেঠুর আচমকা জ্বর আসা, তার পর এক দিন অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতাল, তার দিন দুয়েক পরে বাড়ির লোকের জেঠুকে আর শেষ দেখা দেখতে না পাওয়ার আফসোস।

জানলায়, পর্দায়, বাজারফেরত জিনিস, এটিএম মেশিন— সর্বত্রই সতর্ক থাকা— এ তো সেই অশরীরী ‘দি আদার্স’রা।

জানলায়, পর্দায়, বাজারফেরত জিনিস, এটিএম মেশিন— সর্বত্রই সতর্ক থাকা— এ তো সেই অশরীরী ‘দি আদার্স’রা।

সাদা মোড়কে কোথায় কী ভাবে হারিয়ে গেল আর জেনেই ওঠা হল না কোনও দিন। এর ক’দিন পরেই কাগজে বেরিয়েছিল একটা খবর। অস্থির সময়েও হাসির খবর হয়ে আদতে হয়তো এই সময়টাকেই ‘ডার্ক কমেডি’ বলে মনে করিয়ে সেই খবরে ছিল— বাড়িতে শ্রাদ্ধশান্তির দিন মৃত বলে ঘোষিত ব্যক্তি ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে। মহামারিতে মৃত ফিরে এসে সাময়িক ভূতের ভয় দেখিয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু আর ফিরে না আসা সেই প্রতিবেশী জেঠুর স্ত্রী ওই বাড়িতে আর থাকতেই পারেননি।

জীবনের অনিশ্চয়তা এবং আমার নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে— এই বোধ আসলে প্রতিমুহূর্তে আমাদের দেহ সম্পর্কে আরও আরও সচেতন করে তোলে। চারপাশের অনিশ্চয়তা, তার পর আমার এই থাকা ফুরোলে কী হবে? আমার এই ‘থাকা’ তো আসলে অন্যদের থেকে স্বীকৃতি পাওয়া। সমাজমাধ্যমে সকালে ‘লগ ইন’ করতে ভয়! চেনা প্রোফাইলের কারও মৃত্যু সংবাদ মহামারির নিত্যদিনের ভয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জানলায়, পর্দায়, বাজারফেরত জিনিস, এটিএম মেশিন— সর্বত্রই সতর্ক থাকা— এ তো সেই অশরীরী ‘দি আদার্স’রা। যে ভাবে অতর্কিত আক্রমণ করতে পারে ভূতেরা, যে ভাবে নিজের ইন্দ্রিয় ধরতে পারে ধাপে ধাপে তাদের উপস্থিতি।

লোককথা, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সমাজ ও সাহিত্য থেকে বিচিত্র সব ভূত-প্রেত-অশরীরী অস্তিত্বের কথা আমরা জানতে পারি। বিচিত্র তাদের বৈশিষ্ট্য আর নানা ভাবে উপকার, অপকার বা ভয় দেখায় মানুষকে। বিশেষ ভাবে খুঁজে দেখলে এই ভূতদের মধ্যে রয়ে গিয়েছে গভীর কোনও সামাজিক বার্তা। নিজের সঙ্গে, নিজের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে হয়ে যাওয়া কোনও অবিচারের কথা বলতে তারা আসে। আবার কখনও বা কেবল অশুভ শক্তি হয়েই আসে। ডেল্টা, ওমিক্রন, ইহু কেউ ভয়ানক কেউ বা মৃদু। কেউ বলছে সর্বগ্রাসী মানুষের কাছে এই আতঙ্ক আসলে প্রকৃতির প্রতিশোধ আবার কেউ বা বলছে গভীর ষড়যন্ত্র করে ছাড়া মহামারির ভূত।

ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসে। আমরা যারা শ্বাস নিতে পারি, তার পরেও বাইরে বেরিয়ে দেখি চেনা চেনা রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড, ওভারব্রিজের তলা, স্টেশন প্ল্যাটফর্মের কোণ, মফস্‌সলের সিনেমা হল, সেক্টর ফাইভের আশপাশ— সবটুকু যেন রয়েছে। কিন্তু আচমকা অনেক কিছু একেবারে উবে গিয়েছে, ভূতের মতোই। খাওয়ার দোকান, সাইকেল স্ট্যান্ড দেখার লোক, বাটি নিয়ে ভিক্ষা করা লোক কেউ নেই। কোথায় চলে গেল ওই লোকগুলো? পাড়ার সেই জেঠু তো তা-ও হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন জানতে পারা যায়। ওই লোকগুলোও কি সাদা প্যাকেটের মোড়কে কোথাও চলে গিয়েছে?

সবটা জুড়ে থাকা মানুষ কখনও জানতেই পারে না, ‘না থাকলে’ কী হয়? 

সবটা জুড়ে থাকা মানুষ কখনও জানতেই পারে না, ‘না থাকলে’ কী হয়? 


দীর্ঘ দিন অফিস খোলে না। ঘর থেকে কাজ। উইপ্রো মোড় পেরিয়ে ছোট্ট গুমটি করে চা-পাউরুটি বিক্রি করা দম্পতির মুখটাও মনে নেই। আচমকা কোথাও দেখলে চমকে উঠব কি? এরা তো আমার, আমার মতো অনেকের কাছেই আসলে ভূত হয়ে গেল। মহামারি কেবল প্রাণেই তো মারেনি। লোকাল ট্রেনে গান গাওয়া লোকটা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও গানই গায়। আমরা শুনতে পাই না। ওদের চোখে আমরাও হয়তো ভূত।

ভূত মানে সেই অর্থে এক অস্বস্তি। ‘রিটার্ন অব দ্য রিপ্রেসড’। ‘জমাট বাঁধা সময়’। মহামারি বাস্তবিক অর্থে সেই জমাট বাঁধা সময়। যে সময় সম্পর্কে আমাদের আশঙ্কা থাকে আবার একই সঙ্গে ফিরে এলে কী হতে পারে বলে এক রকম কল্পনাপ্রবণতাও থাকে। একটা বিশেষ সময়ের সাক্ষী থাকতে পারার যে আনন্দ, মনের মধ্যে তা যেমন সত্যি, তেমনই এই বিশেষ সময়ে আমার নিজের ‘থাকা’টাও ‘না-থাকা’ হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু সবটা জুড়ে থাকা মানুষ কখনও জানতেই পারে না, ‘না থাকলে’ কী হয়?

বার বার অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের এই দোলাচল মহামারির প্রাপ্তি। জীবন-মৃত্যু তো বটেই, অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করে রাখা আনন্দ উৎসব ভেস্তে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা পিছিয়ে যাওয়া, অনেক আশা নিয়ে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দিতে না পারা— অনেকগুলো ‘না হওয়া’ আসলে হয়তো ‘না থাকা’র বোধেরই স্মারক।

সেই কবেকার কথা। আমাদের পাড়ার সুবলকাকু। চমৎকার ফুটবল খেলত। আচমকা সেরিব্রাল অ্যাটাক। তার পর থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় দীর্ঘ কয়েক বছর একই ঘরে যাপন। বা বন্ধুর বাড়ির সেই রানুপিসি, যিনি অবিবাহিতা, বাড়ির কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে দেখভালও তাঁর কাঁধেই এসে পড়েছিল। অন্যেরা বেড়াতে গেলেও তিনি থেকে যেতেন। পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা মনের ভিতরেই রেখে দিয়েছিলেন। চিলেকোঠার ঘরেই মারা গিয়েছিলেন। তখন পৃথিবীতে মহামারি ছিল না। কিন্তু সুবলকাকু, রাণুপিসিরা ছিলেন। যাঁরা বহু বছর নিভৃতবাসেই জীবন কাটিয়েছেন।

আজ শহরের রাস্তায় মাস্ক ছাড়া হেঁটে যাওয়া, অন্য মানুষের জীবন বিপন্ন করা ‘নসফেরাতু’- র কাউন্টরলোকের মতন ভ্যাম্পায়াররাও যেন ঘুরছে। আবার নিঝুম দুপুরে কোনও দরজায় কান পাতলে যন্ত্রণা পাওয়া সুবলকাকুর আর্তনাদ বা কুয়াশা ঘেরা কোনও জানলায় মন খারাপ করা রাণুপিসির ছায়া জানান দেয়— আছি। ভয় হোক আর যন্ত্রণা— মহামারি তো সেই জমাট সময়, লুপের মতো ফিরে ফিরে আসে।

আরও পড়ুন
Advertisement