কোন অতীত থেকে মেয়েরা চাষাবাদ ছাড়াও পাহাড়, প্রান্তর, বনভূমি ঢুঁড়ে জল, জ্বালানি, খাদ্য সংগ্রহ করছেন। সেই থেকে তাঁর সনাতনী জ্ঞান রক্ষা করে চলেছে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। করে চলেছে তার ব্যবস্থাপনাও। তাই হয়তো প্রকৃতি ও পরিবেশে হঠাৎ বিপর্যয় ঘটলে, সেখানে কোনও ধীর ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলতে থাকলে, তার ধাক্কা সবচেয়ে বেশি এসে লাগে সেই মেয়েদের জীবনেই। খরা, বন্যা, বিধ্বংসী ঝড়; কিংবা নদী, সমুদ্র উপকূলের ভাঙন বা আগ্রাসন— তার অভিঘাতে বহু জনপদ তছনছ হয়ে যায়। হাজারো বাসিন্দা বাধ্য হন ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যেতে। এবং যাঁরা ‘পরিবেশ উদ্বাস্তু’ হয়ে শেষ পর্যন্ত চরম নিরাপত্তাহীনতার অনিশ্চিত স্রোতে ভেসে পড়তে বাধ্য হন, তাঁদের বেশির ভাগই নারী।
রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব বলছে, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যত জনকে জীবন-জীবিকা থেকে উৎখাত হয়ে উদ্বাস্তু হতে হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই মেয়ে। আসলে পরিবারে, সমাজে, দেশের অভ্যন্তরে যখনই কোনও সংঘাত তৈরি হয়, বিঘ্নিত হয় শান্তি ও নিরাপত্তা, তখনই পুরুষের তুলনায় মেয়েদের উপরই তার প্রভাব পড়ে বেশি। তেমনই প্রকৃতি ও পরিবেশের অবনয়ন ঘটলে, সেখানে বিপদ ঘণ্টা বেজে উঠলে, বেশি বিপর্যস্ত হন নারী ও শিশুরাই, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে। অনেককেই নামহীন, গৃহহীন, এমনকি রাষ্ট্রহীন হয়ে শেষ পর্যন্ত এক অতলান্তিক অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হয়।
ঠিক যেমন ২০০৪-এ ইন্দোনেশিয়ায় সুনামির পর বেড়ে যাওয়া মানব পাচারের বেশি শিকার হয়েছিলেন নারী ও শিশুরা। প্রবল খরার পর জীবিকার খোঁজে উত্তর ঘানা থেকে বড় শহরগুলিতে চলে যাওয়া অসংখ্য যুবক যুবতীদের মধ্যে, মেয়েরাই বেশি পাচার, যৌন নির্যাতন ও শ্রমদাসত্বের শিকার হন। ২০০৯-এর সমীক্ষা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বে যে ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হয়, তার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই দু’কোটি।
প্রথম থেকেই যুদ্ধ বিগ্রহের পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশগত কারণেও মানুষ বার বার স্থানান্তরিত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে প্রাচীন সভ্যতাও। দেশে দেশে সেই পরিযাণের ধারাবাহিকতা আজও প্রবহমান। ওয়ার্ল্ডওয়াচ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা, পরিবেশবিদ লেস্টার ব্রাউন ১৯৭৬-এ ‘এনভায়রনমেন্টাল রিফিউজি’ বা ‘পরিবেশ উদ্বাস্তু’ শব্দবন্ধটি, পরিবেশ পরিযায়ীদের সম্পর্কে প্রথম ব্যবহার করেন।
ক্রমবর্ধমান ‘পরিবেশ উদ্বাস্তু’ বা আজকের ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’দের নিয়ত প্রত্যক্ষ করছি চার পাশে রাস্তায়, শহরের পরিত্যক্ত বাড়িতে, ব্রিজের তলায়, প্ল্যাটফর্মে— সর্বত্র। যাঁরা কোথাও লাগাতার খরা, মরুকরণ, বন্যা বা বিধ্বংসী ঝড় আছড়ে পড়ায় নিরাশ্রয়। বাধ্য হয়েছেন স্থানান্তরে যেতে। বিশ্ব উষ্ণায়নে মেরু বরফ ভেঙে সমুদ্রের জলতল ক্রমশ উঁচু হয়ে ডুবছে ঘরবাড়ি। অসংখ্য মানুষকে ছাড়তে হচ্ছে ভিটেমাটি। দেশের মধ্যে, কখনও বিপুল ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরে পাড়ি দিচ্ছেন প্রাণ বাঁচাতে। বিশ্বে এ ভাবে প্রতি বছরই গড়ে প্রায় দু’কোটি ছিন্নমূল হচ্ছেন। তাঁঁদের মধ্যে নারী ও শিশু সর্বাধিক।
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত নারী, শিশুকন্যাদের বিপন্নতা আরও বাড়ায় লিঙ্গবৈষম্য। মুর্শিদাবাদ, মালদহে গঙ্গার ভাঙনে নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়া বহু গ্রামের উদ্বাস্তু পরিবারকে পথের ধারে আমবাগানে অস্থায়ী আশ্রয়ে দেখেছি। পুরুষরা কাজের সন্ধানে অন্যত্র গেলে, অরক্ষিত শিশু ও নারীদের বিপদ সম্ভাবনা বহু গুণ বেড়ে যায়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় দেখেছি, ডুবন্ত ঘোড়ামারা দ্বীপে এবং আয়লা, আমপানে বিপর্যস্ত সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হতদরিদ্র মেয়েদের আপ্রাণ লড়াই। স্বামীরা অনেকেই কাজের সন্ধানে অন্যত্র গিয়ে দ্বিতীয় সংসার গড়েন, ফেরেন না। ঘোর অনটনে থাকা বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি ও সন্তানদের বাঁচাতে সেই স্ত্রীদের মাঝরাতে নদী, খাঁড়িতে ডিঙি ভাসাতে হয়। কাঁকড়ার আশায় লুকিয়ে একেবারে বাঘের ডেরায় পৌঁছে গেলে, কারও বা বাঘের হাতে প্রাণ যায়। শুনেছি নোনাজলে জমি ভেসে যাওয়ায়, চাষহীন, জীবিকাহীন পরিবারের মহিলা-সহ অগণিত শিশু, কিশোর-কিশোরীদের বিয়ের ছদ্মবেশে দেশান্তরে পাচার, শ্রমদাস বা যৌনদাসী হওয়ার নিষ্ঠুরতার কাহিনি।
ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার্স ফর রিফিউজিস-এর রিপোর্ট বলছে, কয়েক দশক ধরে প্রকৃতি ও পরিবেশের অবনয়নে মেয়েদের জীবন আরও সঙ্কট সম্মুখীন। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট-এর রিপোর্টও জানাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন শিশু ও অল্পবয়সি মেয়েদের যে ভাবে অনিরাপদ পরিযাণে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে আগামী দশকগুলিতে ‘আধুনিক দাসত্ব’-এর ঝুঁকি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
জল, জ্বালানি, পশুখাদ্য জোগাড়ে মহিলাদের যাত্রা, শ্রম, ঝুঁকি ইতিমধ্যেই আরও বাড়ছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে, নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থেকে মেয়েরা এখনও বহু যোজন দূরে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের অধিকতর শিকার হলেও এই সম্পর্কিত তাঁদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আজও ব্রাত্য। এবং নারীর প্রতি ঘটমান নানা সহিংসতার টুপিতে যুক্ত হচ্ছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ নামক নতুন এক পালক।