Nyay Samhita

আর নির্যাতিত পুরুষ?

ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারায় ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌনাচারে লিপ্ত ভারতীয় নাগরিকের জন্য দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ধার্য ছিল।

Advertisement
ভাস্কর মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৩৪

গত ১৪ জুন উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলাতে পুলিশ চার জন ব্যক্তির (সকলেই পুরুষ) বিরুদ্ধে এক জন পুরুষকে ধর্ষণ করার অপরাধে ৩৭৭ ধারায় এফআইআর নথিভুক্ত করে। তার আগেই ধর্ষিত মানুষটি সামাজিক হেনস্থার জন্য আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এই ধরনের ঘটনাগুলি ৩৭৭ ধারা নিয়ে আলোচনাকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে, একটু অন্য প্রেক্ষিতে।

Advertisement

ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারায় ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌনাচারে লিপ্ত ভারতীয় নাগরিকের জন্য দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ধার্য ছিল। ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌনাচার ব্যাপারটা ঠিক কী, তা এই আইনে পরিষ্কার করে বলা ছিল না। তবে শিশ্ন ও যোনির মিলনকে যে-হেতু তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ ধরে নেয়, তাই এর বাইরের যে-কোনও যৌনাচারই প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ধরা হয়। এই জন্য সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করে তাঁদের হেনস্থা-হিংসা করা হয়েছে দশকের পর দশক। ভারতীয় সমকামী-উভকামী মানুষেরা অন্তরালে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৮-র ৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারার আওতা থেকে সম্মতিমূলক যৌনাচারকে বার করে আনে।

এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ৩৭৭ ধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি বৈষম্য তৈরি করা। তাঁদের দিক থেকে এই ধারা ছিল অনভিপ্রেত। কিন্তু ওই ধারার ‘মন্দের ভাল’ দিক একটা ছিল— পুরুষের প্রতি ধর্ষণ ও যৌনহিংসার শাস্তিবিধান করা যেত এর অধীনে। যদিও যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের হয়রান করতে এই ধারা প্রয়োগে পুলিশ যত তৎপরতা দেখাত, পুরুষের উপর যৌন-নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনায় ততটা নয়। তবু, যৌনহিংসা তথা ধর্ষণের প্রতিবিধান পেতে হলে এই একটিই আইনি উপায় ছিল পুরুষ বা রূপান্তরকামীদের হাতে।

১ জুলাই থেকে দেশে ভারতীয় দণ্ডবিধি (ইন্ডিয়ান পিনাল কোড) উঠে গিয়ে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা নামের যে নতুন আইনপঞ্জি এল, তাতে ধারা ৩৭৭ অনুপস্থিত। একে স্বাগত জানাতে অসুবিধা কিছু ছিল না। কিন্তু এখন পুরুষ ও সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি যৌনহিংসার শাস্তিবিধানের কী ব্যবস্থা রইল? ধর্ষণের আইনে পুরুষ বা যৌনসংখ্যালঘুদের ‘ধর্ষিত’ বলে প্রবিষ্ট করানো হয়নি, তাঁদের জন্য আলাদা আইনও হয়নি। তবে কি ধরে নিতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার মনে করছে পুরুষের প্রতি ধর্ষণ কিংবা যৌনহিংসামূলক ঘটনা ঘটতে পারে না? না কি রূপান্তরকামী বা পুরুষের প্রতি যৌনহিংসাকে সরকার লঘু করে দেখছে?

সমাজ ধরে নেয়, ‘পুরুষ’ হল সেই প্রজাতি যার কান্না আসে না, যার দুর্বল হতে নেই, যাকে কেউ হেনস্থা করতে পারে না। প্রবল পরাক্রমশালী না হলে পুরুষ নয়, এমন একটা চাপ নিয়েই বড় হয় বালক-কিশোররা। এ-ও কিন্তু পুরুষতন্ত্রের ঠুলি, যা মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষদেরও বিপন্ন করে। নাবালক বা সাবালক পুরুষ ও যৌনসংখ্যালঘুদের উপর ধর্ষণ-সহ নানা নির্যাতন সব দেশেই ঘটে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়।

ভারতের ধর্ষণ-বিরোধী আইনে ধরে নেওয়া হয়, ধর্ষণকারী কেবল পুরুষই হবে। তার সঙ্গত কারণও আছে। পুরুষতান্ত্রিক এ-দেশে পুরুষ ও নারীর মধ্যে ক্ষমতার যে যোজন দূরত্ব রয়েছে, এবং পুরুষ যে সুবিধাজনক জায়গায় আছে, তা মনে আনলে ধর্ষণকারীর পরিচয় লিঙ্গ-নিরপেক্ষ রাখা কিঞ্চিৎ বিপজ্জনক। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতে পুরুষের প্রতি যৌনহিংসা-সহ অন্যান্য হেনস্থা-হিংসার ঘটনায় সাধারণত দায়ী অন্য একটি পুরুষই হয়ে থাকে। কিন্তু সমকামী-রূপান্তরকামী সম্পর্কেও যে ধর্ষণ বা যৌনহিংসার ঘটনা ঘটে না, তা-ও তো নয়। মূল কথা হল, যৌনহিংসার আশ্রয় যে-ই নিক না কেন, তার শাস্তির প্রয়োজন আছে। যৌনহিংসার শিকার হলে একই দেশে নারী, পুরুষ ও রূপান্তরকামী মানুষ, সকলে একই রকম বিচার আইনের চোখে পাবেন, এটাই কাম্য।

সেটা যে হচ্ছে না তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নতুন ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৩ ধারায় নারী-ধর্ষণের শাস্তি কম পক্ষে দশ বছরের জেল, সঙ্গে আর্থিক জরিমানা। রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য এ ক্ষেত্রে কোনও স্পষ্ট আইন নেই। তবে যদি ২০১৯-এর ‘ট্রান্সজেন্ডার বিল’ ধরে যায়, তা হলে সেখানে যৌনহেনস্থার শাস্তি মাত্র আড়াই বছরের জেল। পুরুষের ধর্ষণের কোনও আইনই নেই।

ভারতীয় বিচারবিভাগের একটা চালু কথা আছে, আইন থাক আর না-ই থাক, অপরাধ করলে তার শাস্তি বিধান হতেই হবে। দরকার পড়লে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইন তৈরির নির্দেশ দিতে পারে সরকারকে, যা কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থার জন্য ‘বিশাখা গাইডলাইন্স’-সূত্রে আমরা দেখেছি। এখন ভারতে পুরুষ বা রূপান্তরকামী মানুষের উপর ধর্ষণ হলে পুলিশ প্রশাসনের কী করা উচিত? এফআইআর নথিভুক্ত হবে কোন আইনের সূত্রে? লিঙ্গপরিচয় ও নানা যৌনতার সূক্ষ্মতার কথা মাথায় রেখে নতুন আইনের প্রণয়ন ও প্রয়োগ খুবই জরুরি। ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্তর্গত বহু ধারা ব্রিটিশ সরকারের আমলে তৈরি হয়েছিল। সেই দণ্ডবিধি তুলে দিয়ে নতুন আইন কার্যকর করে বর্তমান সরকার হয়তো নতুন ভারত গড়ে তোলার ধারণা দিতে চাইছে। কিন্তু এখনও সমাজের পুরুষ ও রূপান্তরকামী মানুষদের নির্যাতন থেকে সুরক্ষার আইন তৈরি হল না।

আরও পড়ুন
Advertisement