প্রমাণ পেয়েছি, নিজের ন্যায্য প্রশংসাতেও বিব্রত হতেন তিনি
Manmohan Singh

এক বিরল ভদ্রলোক

তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অনেকেই দুর্বলতা বলে ভুল করেছেন। আসলে, তাঁর মধ্যে গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল— যার জোরে তিনি বিনয়ী হতে পেরেছিলেন। গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করার প্রয়োজন হত না তাঁর।

Advertisement
কৌশিক বসু
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৬

গভীর বিষাদের সঙ্গে এই লেখাটা লিখতে বসছি— প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিংহের প্রয়াণের পরে। তিনি এক বিরল গোত্রের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন— প্রজ্ঞাবান, সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, আনখশির সৎ। এবং, তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচির প্রধান স্থপতি— ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ অবধি ঘটে চলে আর্থিক সংস্কার, যা ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে বিশ্ব বাজারের কক্ষপথে স্থাপন করেছিল। সংস্কার-পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার যে ভাবে বেড়েছিল, তা থেকে এই প্রকল্পের তাৎপর্য বোঝা সম্ভব; আবার, বিশ্বমঞ্চে ভারতীয়দের প্রবল উত্থানও আর্থিক সংস্কারের সাফল্যের সূচক। আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বা ইউরোপে বহু অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার পরিচালকের আসনে আসীন ভারতীয়রা; তাঁরা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রথম সারিতে রয়েছেন, নীতিনির্ধারণেরও। এর পিছনে যেমন সদ্যস্বাধীন দেশে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খাতে বড় মাপের বিনিয়োগের প্রভাব রয়েছে, তেমনই প্রভাব আছে ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় ঘটা আর্থিক সংস্কারের। আমার কোনও সংশয় নেই যে, মনমোহন সিংহকে ইতিহাস সর্বকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা হিসাবেই মনে রাখবে।

Advertisement

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে। তখন আমরা পূর্ব দিল্লির একটি আবাসনে থাকতাম। তখন মনমোহন সিংহ সদ্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবে নিজের মেয়াদ শেষ করেছেন। আমার এক বন্ধু এক দিন ফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি ডক্টর সিংহকে এক বার আমাদের ফ্ল্যাটটা দেখাতে নিয়ে আসতে পারেন? বন্ধু জানালেন, মনমোহন সিংহ আমাদের এলাকায় একটা ‘সাধারণ ফ্ল্যাট’ খুঁজছেন— আমাদের বাড়িটা দেখলে তিনি খানিক আন্দাজ পাবেন। মনমোহন এলেন। আমার মা তখন দিল্লিতে, আমাদের কাছে— মনমোহন তাঁর সঙ্গে অনেক ক্ষণ গল্পও করলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ফ্ল্যাটটি কেনা হয়নি। আমাদের বাড়িতে আসার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি জেনিভায় সাউথ কমিশনের মহাসচিব পদে নিযুক্ত হলেন, এবং তার পরে, ১৯৯১ সালে হলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী।

২০০৪ সালে ডক্টর সিংহ যে দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন, সে দিন মা প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ফোন করলেন— যিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী! মা বললেন, উনি যখন কথা বলছিলেন, তখন তো মনেই হয়নি!

তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা এ বছর জুলাইয়ে। আমি এবং আমার স্ত্রী দিল্লিতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম, মনমোহন ও তাঁর স্ত্রী গুরশরণ কউরের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে দেখে বেশ দুর্বল মনে হল, কিন্তু আমরা যাওয়ায় স্পষ্টতই খুব খুশি হলেন। সে দিন অনেক কথা হল তাঁর সঙ্গে। ভারতের রাজনীতিতে যে ভাবে মেরুকরণ হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি খুবই বিচলিত ছিলেন; দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে সাঙাততন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত নিয়েও।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে মনমোহন সিংহ চিরকালই ব্যতিক্রমী— বিনয়ী, মৃদুভাষী, এবং এমন এক জন মানুষ, যিনি মৌলিক ভদ্রতাবোধ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অনেকেই দুর্বলতা বলে ভুল করেছেন। আসলে, তাঁর মধ্যে গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল— যার জোরে তিনি বিনয়ী হতে পেরেছিলেন। গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করার প্রয়োজন হত না তাঁর। একাধিক বার আমি তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তার পরিচয় পেয়েছি।

২০০৯ সালে আমি ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে যোগ দিই। তার কিছু দিনের মধ্যেই আমার একটি বই প্রকাশিত হওয়ার কথা। তার মধ্যে বহু বছর আগের একটা প্রবন্ধে মনমোহন সিংহের ভূয়সী প্রশংসা ছিল— তিনি রাজনীতির ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠার আগের সময়কার লেখা। আমার মনে হল, প্রবন্ধটি যবেকারই হোক, এখন যে-হেতু আমি এই সরকারে কাজ করছি, এবং লেখাটির মুখ্য চরিত্র তিনি, তাই প্রবন্ধটি এই সঙ্কলনে প্রকাশ করার আগে এক বার তাঁর অনুমতি নেওয়া ভাল। লেখাটি তাঁর কাছে পাঠালাম। ধরেই নিয়েছিলাম যে, তিনি সম্মতি দেবেন। তাঁকে বুঝতে ভুল হয়েছিল আমার। প্রধানমন্ত্রী আমায় ফোন করলেন, এবং অনুরোধ করলেন, আমি যেন এই লেখাটি সঙ্কলনে প্রকাশ না করি। বললেন, এই প্রশংসায় তিনি অস্বস্তিতে পড়বেন। টের পেলাম, এক অতি বিরল রাজনীতিকের সঙ্গে কাজ করছি, নিজের ন্যায্য প্রশংসাতেও যিনি অস্বস্তি বোধ করেন।

মনমোহনের সততা ছিল প্রশ্নাতীত। দুর্নীতি এবং সাঙাততন্ত্র বিষয়ে তিনি গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন— পুতিনের রাশিয়ায়, অথবা পশ্চিম এশিয়ার বহু দেশে যেমন মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীই প্রকৃত পক্ষে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন, ভারতে যাতে তেমনটা না ঘটে, সে বিষয়ে তাঁর নিরন্তর চিন্তা ছিল। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন যে, দুর্নীতি বিষয়ে এতখানি উদ্বিগ্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তিনি দুর্নীতিকে সমূল বিনষ্ট করলেন না কেন? আসলে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়া অতি জটিল। অস্ত্রোপচার করে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বাদ দেওয়ার মতোই— মূল চ্যালেঞ্জ হল, সুস্থ টিসুতে আঘাত না করে টিউমারটিকে কাটতে হবে। দুর্নীতি শেষ করার অত্যুৎসাহে ভালর চেয়ে মন্দ বেশি হতে পারে— এমনই আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যে, স্বাভাবিক ব্যবসার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৬ সালে নোট বাতিলের সময় কী কাণ্ডটা হল, আমরা দেখেছি— সেই কুঠারাঘাতে দুর্নীতি মরেনি, কালো টাকাও নিকেশ হয়নি, কিন্তু ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছিল। মনমোহন সিংহকে আমি যতখানি চেনার সুযোগ পেয়েছি, তাতে আমি নিশ্চিত ভাবে জানি যে, তিনি দুর্নীতি এবং সাঙাততন্ত্র নিয়ে গভীর ভাবে বিচলিত ছিলেন, এবং এই দু’টি ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিজের যথাসাধ্য করেছিলেন।

তিনি যে কোনও নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাতেন। ২০১১ সালে আমি ঘুষ দেওয়ার প্রথাটি বন্ধ করার জন্য কিছু আইনি সংস্কারের প্রস্তাব করেছিলাম, এবং তা নিয়ে বিপুল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এর পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার একটি স্মরণীয় সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি বললেন, আমি যে সংস্কার প্রস্তাব করেছি, তিনি তার সঙ্গে আদৌ একমত নন; এবং প্রায় এক নিঃশ্বাসে বললেন, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে আমার কাজই হল নতুন নতুন চিন্তাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। যদি আমার কোনও ভাবনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী একমত না-ও হন, তার মানে এই নয় যে, আমি সেই ভাবনাটি ত্যাগ করব। এই খোলা মনের কারণেই প্রথমে অর্থমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর নেতৃত্বে বহু চমকপ্রদ চিন্তা শেষ অবধি সরকারের নীতিগত স্তরে ঠাঁই পেয়েছে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে নিয়ে গিয়েছে এক নতুন কক্ষপথে।

এমনই একটা নীতিগত ধারণার কথা বলি, যা ভারতীয় অর্থব্যবস্থার চেহারা পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে অবধি ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ছিল নিতান্তই অগভীর, মোটামুটি ৫০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। মাঝেমধ্যে আরও কমে যেত বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ, এবং তৈরি হত বিপুল আতঙ্ক— এর পর ভারত আর বিদেশ থেকে অত্যাবশ্যক পণ্যও আমদানি করতে পারবে না। বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার এত সীমিত হওয়ার কারণে বিস্তর কড়াকড়িও ছিল— নিয়ম ছিল যে, কেউ দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না বিদেশি মুদ্রা। সে আমলে বিদেশ সফর করেছেন, এমন ভারতীয়মাত্রেরই মনে পড়ে এয়ারপোর্টের দুঃস্বপ্নের কথা— বিপুল কড়াকড়ি, বিপুলতর তল্লাশি, এবং বিস্তর প্রশ্নোত্তর পেরিয়ে তবে চড়া যেত বিদেশগামী বিমানে। কিন্তু, এখানে যুক্তির গোড়ায় একটি গলদ ছিল— যদি কেউ ভারত থেকে বিদেশে যাওয়ার সময় নিজের খুশিমতো বিদেশি মুদ্রা নিয়ে না-যেতে পারেন, তা হলে কেউ বিদেশ থেকে ভারতে ফেরার সময়ও বিদেশি মুদ্রা সঙ্গে আনবেন না, কারণ এক বার ভারতে ঢুকে গেলে তা আর বার করা যাবে না।

১৯৯১ সালে মনমোহন সিংহ যে সংস্কারগুলির সূচনা করেছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল দেশের বাইরে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে যাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞার অবসান। এই নীতিগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি বিলক্ষণ ছিল— দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গেই অনেকে নিজেদের যাবতীয় বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাইবেন। অতএব, ভারতকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের দ্বারস্থ হয়ে নিরাপত্তার আশ্বাস নিতে হল। কিন্তু, দু’তিন বছরের মধ্যেই দেখা গেল, দীর্ঘমেয়াদে যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, ঠিক তেমনটাই ঘটছে। মানুষ যখন নিশ্চিত হলেন যে, নিজের ইচ্ছেমতো বিদেশি মুদ্রা নিয়ে যাওয়া যাবে দেশের বাইরে, তাঁরা বিদেশ থেকে ভারতে বিদেশি মুদ্রা পাঠাতে আরম্ভ করলেন। পাঁচশো কোটি ডলারের তহবিল দেখতে না-দেখতে ৩০,০০০ কোটি ডলারে পৌঁছে গেল। এবং, ভারত পৌঁছল বিশ্বমঞ্চে।

ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক; ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারত সরকার

Advertisement
আরও পড়ুন