নতুন বছরে সাহস করেই কিছু নতুন কথা বলা যাক। সম্প্রতি কলকাতা শহরের এক পুরপ্রতিনিধিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টার কারণ জলাভূমি বুজিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ ও সেখানে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের সংবাদ বেশ চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। এ ছাড়া কলকাতার পূর্বপ্রান্তের উত্তর-দক্ষিণগামী রাজপথটির পাশে বেশ কয়েক জায়গায় একটি মানচিত্র টাঙানো হয়েছে, যার শিরোনাম পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। ফলে জলাভূমি এখন বেশ পরিচিত শব্দ মনে হয়।
অথচ বাংলা অভিধানে জলাভূমি কথাটা ছিল না। শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘জলা’র অর্থে লেখা আছে— জলমগ্ন নিম্নভূমি ও বিল। সুতরাং জলা কথাটিই যথেষ্ট ছিল মনে হয়। বোঝা যায় এটি একটি নবনির্মিত শব্দ, ইংরেজিতে ওয়েটল্যান্ড। ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় যার নাম ছিল ‘আন্তর্জাতিক বিশেষ ওয়াটার ফাউলের (হাঁসজাতীয় পাখি) বাসস্থান হিসাবে জলাভূমি সংক্রান্ত সম্মেলন’। এর আগে পরিবেশের আলোচনাতেও ‘ওয়েটল্যান্ড’ শব্দটির উল্লেখ প্রায় পাওয়াই যায় না। এই সম্মেলনের পর জলাভূমি বাঁচাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ শুরু হল যার নাম রামসার কনভেনশন। রামসার কনভেনশনের জলাভূমির সংজ্ঞায় খাল বিল পুকুর জলা ধানখেত, কিছুই বাদ দেওয়া হল না। ফলে আমাদের নিত্য ব্যবহারের পুকুরটি জলাশয় থেকে হয়ে গেল জলাভূমি। এখন পুকুর থেকে স্নান করে উঠে আসা কাউকে যদি বলি আপনি কত দিন এই জলাভূমিতে স্নান করছেন, তিনি নিশ্চয় দারুণ ঘাবড়ে যাবেন, বলবেন ভূমি কোথায় পেলেন মশাই, এ তো শুধুই জল। আর জলা বলতে আমরা বুঝি একটি প্রাকৃতিক সৃষ্টি, নিচু স্থানে জমা জল, সেখানে কিছু জঙ্গল, গ্রীষ্মে হয়তো অনেকটাই শুকনো। সুতরাং ভূমিকেই জলাভূমি বলে চালানোর ব্যাপার নিয়ে কিছু কথা।
১৯৯১ সালে একটি প্রতিষ্ঠান পূর্ব কলকাতার ভেড়ি অঞ্চলে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নামে একটি অফিস অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করে। এর কয়েক দশক আগে কলকাতার উত্তর-পূর্বে ১৪ হাজার হেক্টর মাছের ভেড়ি জলার লবণ হ্রদ বুজিয়ে তৈরি হয়েছে বিধাননগর। ১৯৯২-এর জানুয়ারিতে ‘পাবলিক’ নামক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের বিরুদ্ধে ও জলাভূমি বাঁচানোর জন্য মামলা করে। অতি দ্রুত ১৯৯২-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতা হাই কোর্টের আদেশে পূর্ব কলকাতার আবর্জনা পুনশ্চক্রায়ন অঞ্চল বা ওয়েস্ট রিসাইক্লিং রিজিয়ন ঘোষণা হল ও এই অঞ্চলটিতে কোনও নতুন উন্নয়ন কার্যক্রম নিষিদ্ধ হল। লক্ষ করতে হবে, এই সমগ্র অঞ্চলটিকে জলাভূমি বলা হয়নি, কেবল আবর্জনা পুনশ্চক্রায়ন অঞ্চল বলা হয়েছিল। কারণ, এই অঞ্চলের কিছু খেতে সার হিসাবে এর সংলগ্ন ধাপায় ফেলা শহরের আবর্জনা ব্যবহৃত হয়।
এর পরেই ১৯৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইনল্যান্ড ফিশারিজ় আইনে একটি কঠোর ধারা যোগ করল। তা হল— পাঁচ কাঠার (৩৫০ বর্গ মিটার) বেশি কোনও জলাশয়কে (ওয়াটার এরিয়া) আর বোজানো যাবে না। এতে জলাভূমি বা ওয়েটল্যান্ড কথাটি ব্যবহৃত হয়নি। জলাশয় মানে বলা হল যেখানে অন্তত বছরে ৬ মাস জল থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই আইনটির ফলেই পশ্চিমবঙ্গে জলাশয় বোজানো বেশ কঠিন হল। কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন কেউ এক বারও উচ্চারণ করলেন না যে, প্রায় সব পুকুর ব্যক্তিগত মালিকানার, পরিবেশের উন্নতির জন্য তাঁদের পুকুর ভেড়ি আর পরিবর্তন করা যাবে না, কিন্তু তাঁদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না? পরিবেশ উদ্বাস্তু বলে একটা কথা চালু হয়েছে, এই সব পুকুর ভেড়ির মালিকদের সেই পর্যায়ে ফেলা যায়। পরিবেশ উন্নয়নের নামে এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
পশ্চিমি পরিবেশ ভাবনার ঢেউ এখন এ দেশেও যথেষ্ট প্রভাবশালী। ফলে পূর্ব কলকাতার আবর্জনা পুনশ্চক্রায়ন অঞ্চল এক দিন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি হয়ে গেল এবং এক দিন রামসার জলাভূমির শিরোপা পেল। এই আন্তর্জাতিক মনোনয়নের চাপেই রাজ্য সরকার ২০০৬ সালে একটি আইন করে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি) গঠন করল। এ সব হল আন্তর্জাতিক শিরোপা বজায় রাখার জন্য, যার সুবাদে আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক সাহায্য, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ ইত্যাদি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কলকাতা পুরসভার কিছু অংশ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৩৭টি মৌজার মোট ১২৫০০ হেক্টর অঞ্চল নিয়ে এই জলাভূমি। অর্থাৎ, আয়তনে এটি প্রায় বিধাননগরের সমান এবং কলকাতা পুরসভার আয়তনের ৬০ শতাংশ।
এই ঘোষিত জলাভূমিতে কোথায় কী হয়। এই জলাভূমির প্রাথমিক গুরুত্ব এই যে, এখানকার প্রায় আড়াইশো মাছের ভেড়িতে কলকাতার বর্জ্য জলের কিছু অংশ ব্যবহার হয়। এই বর্জ্য জল ভেড়িতে মাছের খাদ্য উৎপাদনে সাহায্য করে এবং এই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য জল কিছুটা পরিশোধিত হয়ে খাল দিয়ে নদীতে চলে যায়। এই জলাভূমির ভেড়িগুলি বর্জ্য জল পরিশোধনের কাজ করে ও মাছ উৎপাদন করে। রাজপথের ধারে টাঙানো পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মানচিত্রে (এবং তাদের ওয়েবসাইটে) দেখানো আছে ৪৫% জমি ব্যবহৃত হচ্ছে মাছ চাষে, বাকি ৫৫% জমি ডাঙা জমি। তাতে চাষবাস হয় ও কিছু অংশে মানুষের বসবাস। এই জলাভূমি নিয়ে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে যে, এখন মাছের ভেড়ি কমে হয়েছে মাত্র ১৬%।
কিন্তু যে কথা বলার জন্য এই নিবন্ধের অবতারণা, মাছের ভেড়ির বাইরে ৫৫ শতাংশ বা ৭৫ শতাংশ জমি একেবারেই ডাঙা জমি, কৃষি বা বসবাসের জন্য ব্যবহৃত। রামসার, ভারত সরকার, বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জলাভূমির সংজ্ঞাতে ডাঙা জমিকে জলাভূমি বলা হয়নি, অথচ সেই ডাঙা জমিকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি তৈরি হয়ে গেল। আর কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো এই ডাঙা জমি, বসত বাড়ি বা কৃষিক্ষেত্র, কোথাও কোনও নির্মাণ করা যাবে না। কলকাতা শহরের একেবারে গায়ে-লাগা কলকাতা শহরের আয়তনের অন্তত ৩৫ শতাংশ জমি তার মালিকেরা নগরায়ণে ব্যবহার করতে পারছেন না।
লক্ষ করার বিষয় যে, বিভিন্ন গবেষণাপত্রে দেখা গেছে এই ঘোষিত জলাভূমি অঞ্চলে ক্রমশ বাড়িঘর নির্মাণ বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পুলিশের কাছেও এসেছে। কিন্তু এই আদতে ডাঙা অঞ্চলকে জলাভূমি বলে দিলে এ রকম ঘটনাই কি স্বাভাবিক নয়? মহানগরের একেবারে গায়ে-লাগা একটি কৃষিজমির আয়ের থেকে তাকে বাস্তু জমি করে নগরায়ণে ব্যবহারে আয় অনেক বেশি। সুতরাং পরিবেশের দোহাই দিয়ে এই ঘোষিত জলাভূমির জমির মালিকদের কি বঞ্চনা করা হচ্ছে না? লন্ডন, নিউ ইয়র্কের মতো কলকাতাও গড়ে উঠেছে জলাজমি বুজিয়েই। রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের বর্ণনায় “যে সকল স্থান বর্তমান সময়ে শিয়ালদহ ও বৌবাজার বলিয়া প্রসিদ্ধ সে সমস্ত স্থান পর্যন্ত লবণ জলের হ্রদটি বিস্তৃত ছিল।” জলা বুজিয়ে বিধাননগর হয়েছে, এই সে দিন জলা আর কৃষিক্ষেত্র পরিবর্তন করে তৈরি হল রাজারহাট বা নিউ টাউন। ফলে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি অঞ্চলকে অক্ষত রেখে বাকি ভূমি অংশটির সেই অধিকার থাকবে না কেন?
যদি পরিবেশবাদীরা মনে করেন এই পুরো অঞ্চলটিই মহানগরের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি, তা হলে কিন্তু এই জমিমালিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রয়োজন বলে মনে হয়। সেই অর্থ নানা ভাবে পাওয়া যায়: পাওয়া যেতে পারে বিধাননগর ও নিউ টাউনের অধিবাসীদের উপর পরিবেশ কর বসিয়েও। একাত্তরের যুদ্ধের সময় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যয়ের জন্য সিনেমা টিকিটে, ডাক টিকিটে, বাসের টিকিটে অতিরিক্ত মূল্য যুক্ত করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। সে ভাবে কলকাতার জনসাধারণের বিভিন্ন কাজে পরিবেশ কর বসানো যেতে পারে। আমেরিকাতে অনেক ব্যক্তিগত অরণ্য আছে। সে রকম এই ভূমি অঞ্চলটুকুও কিনে নিয়ে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে আরও উন্নত, আরও পরিবেশবান্ধব করার কথা ভাবা যায় না কি?