দুশ্চিন্তা হয় নিজেদের জন্য, এবং শাসকের জন্যও
TMC

জনগণের সব সয়ে গেছে

সরকারি ক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁরা জনসাধারণের কাছে অসুবিধা সৃষ্টির জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন।

Advertisement
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২২ ০৫:০১
জনসমুদ্র: শহিদ দিবস উপলক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসের সমাবেশ ধর্মতলায়। ২১ জুলাই, ২০২২। দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

জনসমুদ্র: শহিদ দিবস উপলক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসের সমাবেশ ধর্মতলায়। ২১ জুলাই, ২০২২। দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ নিয়ে ইতিমধ্যেই কথার পাহাড় তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিক। হাসিঠাট্টা, কটাক্ষ, ব্যঙ্গবিদ্রুপের বান ডেকেছে, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। বঙ্গসমাজে অলীক কুনাট্য রঙ্গের কদর এখন যেমন দাঁড়িয়েছে, তা দেখলে মধুসূদন দত্তেরও আর কলম সরত না। একটি রাজনৈতিক দলের বার্ষিক ব্রতপালনের জন্য কেবল একটা দিন নয়, তার আগের কয়েক দিন ধরে জনজীবনে যে ধরনের সমস্যা তৈরি করা হয়েছে, যত মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা হয়েছে, তা নিয়েও নতুন করে আর কিছু বলার নেই। এটাই এ-রাজ্যে অনেক দিনের রীতি, তদুপরি দু’বছরের বকেয়া উদ্‌যাপন সুদে-আসলে মিটিয়ে নেওয়ার তাগিদ ছিল, তাড়নাও কম ছিল না। সরকারি ক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁরা জনসাধারণের কাছে অসুবিধা সৃষ্টির জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। এ-রীতিও এখন প্রচলিত বটে। জনসাধারণের অবশ্য ক্ষমা না করে কোনও উপায় নেই। আর, ক্ষমা এবং ক্ষমতা, দু’টি শব্দই যখন একই ধাতু থেকে সঞ্জাত, তখন ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবতীরা ক্ষমা চাইলে সেটা বেশ ব্যাকরণসম্মত ব্যাপার বলেও মানতেই হয়। সুতরাং, একুশের পরে বাইশে জুলাই আসে, বাইশের পরে তেইশে, রঙ্গরসিকতা, ভিডিয়ো ক্লিপ, মন্তব্যের স্রোত ক্রমে শীর্ণ হয়, জীবন যে রকম চলছিল, চলতে থাকে, চলতে থাকবে। জনগণের সব সয়ে গেছে। আসছে বছর আবার হবে।

কিন্তু স্রোত চলে গেলে পলি জমে। দুশ্চিন্তার পলি। দুশ্চিন্তাটা ওই সয়ে যাওয়া নিয়েই। দেখতে দেখতে কত কিছুই সয়ে যায়, কত দূর অবধি সয়ে যায়! নিয়ম বানানো যাঁদের কাজ, নিয়ম মানানো যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরাই এমন অকাতরে নিয়ম ভাঙার মহোৎসবে নেতৃত্ব দিলে ক্রমে ক্রমে অনিয়মটাই কেমন স্বাভাবিক হয়ে যায়, সে তো আমাদের অজানা নয়। প্রত্যেক দিন আমাদের চার পাশে যে অন্তহীন বেনিয়মের লীলা উত্তরোত্তর জমজমাট হয়ে উঠছে, আমরা বিলক্ষণ জানি যে তার মূলে আছে এক বিপুল প্রশ্রয়ের বাণী: চলতা হ্যায়। প্রশ্রয়ের হাতখানি যতক্ষণ মাথার উপর আছে, ততক্ষণ— আমরা যা খুশি তাই করি। নিয়ম আছে, কানুন আছে, কিন্তু সেই নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? আইন আইনের পথে চলবে, আমরা আমাদের পথে। ভয় হয়, এই পথে আলো জ্বেলে যত এগিয়ে যাব, আইনের শাসন কথাটাই ক্রমে তত অর্থহীন হয়ে পড়বে। আজ অবধি যে আইন মানছি, কাল থেকে আর তা মানবার দরকার থাকবে না। দুশ্চিন্তা জমতেই থাকে।

Advertisement

দুশ্চিন্তাটা কিন্তু কেবল নিজেদের জন্য নয়, শাসকদের জন্যও। তাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে, ক্ষমতার দাপট আছে, সেই দাপট দেখানোর হাজার কলাকৌশল যন্ত্রপাতি সেপাইসান্ত্রি আছে। কিন্তু শুধু দাপট দিয়ে রাজ্য শাসন করতে গেলে আজ না হোক কাল ঝঞ্ঝাট হবেই। ক্ষমতার দাপটকে ঘষামাজা করে ঠিকঠাক রাখতে হলেও শাসকের একটা স্বাভাবিক বিশ্বাসযোগ্যতার দরকার হয়। কোনও সুনীতি বা আদর্শের কথা হচ্ছে না, ও-সব এই বাজারে অবান্তর, কিন্তু শাসকের নিজের কথার একটা ন্যূনতম দাম যদি না থাকে, তা হলে আইনের শাসন ধরে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়তে বাধ্য। ইতিহাসে তার বিস্তর নমুনা আছে। স্বয়ং মাকিয়াভেলি যখন বলেন, প্রজাদের ভালবাসার চেয়ে তাদের ভীতি শাসকের পক্ষে বেশি নিরাপদ, তখনও তিনি নিছক পাইক-পেয়াদার কথা বলেন না, প্রজাদের সমীহ আদায়ের জন্যও তাঁদের চোখে বিশ্বাসযোগ্য হওয়া চাই বইকি। তা না হলে, গুরুদেব যেমনটি লিখে গিয়েছেন: মহারাজা ভয়ে থাকে পুলিশের থানাতে, আইন বানায় যত পারে না তা মানাতে! মনে রাখবেন, কবিকল্পনা আকাশ থেকে পড়ে না। পোড়-খাওয়া নাগরিক বরং প্রশ্ন তুলবেন, আইন মানাতে না পারলে পুলিশের থানাই বা নিরাপদ আশ্রয় থাকবে কী করে?

বিশ্বাস তৈরি করা কঠিন, শ্রমসাধ্য। বিশ্বাস হারানো অনেক সহজ। প্রায়শই তার প্রক্রিয়াটা বাইরে থেকে বোঝাও যায় না, আপাতদৃষ্টিতে ছোট ছোট অসঙ্গতির মধ্য দিয়েই লোকে প্রশাসনের কথায় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সেটা কোনও রাগ বা বিদ্রোহের ব্যাপার নয়, স্রেফ প্রজার মনে রাজারানিদের কথায় গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাসটা ক্ষয়ে যায়। একেবারে হাতে-গরম একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। অতিমারির উদাহরণ। কোভিড নামক দৈত্যটি হয়তো ইতিমধ্যেই পোষ মেনেছে, কিন্তু বিপদ এখনও যায়নি, বিশেষ করে যাঁরা জরা ও ব্যাধির কারণে বিশেষ ভাবে অশক্ত তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সকলের সাবধান থাকা দরকার। চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, সরকারি মহল থেকেও নানা সতর্কবাণী শোনানো হচ্ছে, জনসাধারণকে সংক্রমণ প্রতিরোধের নিয়মকানুন পালনের উপদেশ দেওয়া চলছে। আমাদের মাথার উপর উদ্বেগের খাঁড়া এখনও ঝুলছে। কেবল সংক্রমণের উদ্বেগ নয়, সংক্রমণ বাড়লে বা তার উপক্রম হলেই আবার পরিবহণ উধাও হতে পারে, দোকানপাট কাজকারবার রোজগারপাতি বন্ধ হতে পারে, সবচেয়ে আগে বন্ধ হতে পারে স্কুলকলেজ— এ-রাজ্যের সরকারি মহলের এক নম্বর সফট টার্গেট। অথচ শাসক দলের মহাসমারোহ হয়ে গেল, কোভিড-বিধির ন্যূনতম শর্তগুলিও জনসমুদ্রে বেবাক তলিয়ে গেল! সেই বিধির অভিভাবকরা সমুদ্রের ঢেউ গুনলেন। এরই মধ্যে মহানগরে সমাবেশ-অভিযাত্রীদের শিবিরে আশ্বাসবাণী শোনা গেল: এখানে কারও কোভিডের কোনও লক্ষণ মেলেনি, কেবল বদহজমের কেস!

প্রশ্নটা আসলে অতিমারির নয়। অতি বড় ‘সুপারস্প্রেডার’ও হয়তো আর বিপর্যয় ঘটাতে পারবে না। কিন্তু কোভিডের মোকাবিলায় সরকারের বিচিত্র অস্থিরতা এবং অবিবেচনা, বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী পদক্ষেপ এবং নিজেদের সতর্কবাণী নিজেরাই অগ্রাহ্য করার হঠকারিতা— এই সবই নাগরিকদের মনে শাসকের বিশ্বাসযোগ্যতায় ক্রমাগত আঘাত করে চলছে না কি? শাসকরা অবশ্য প্রশ্নটাকেই অবান্তর ভাবতে পারেন। তাঁদের বিচারে হয়তো আইনের শাসন ব্যাপারটাই তাঁদের অভিরুচি মাফিক চলছে চলবে; যখন মনে করবেন আইন মানাতে হবে, প্রজাদের ঘাড় ধরে মানিয়ে নেবেন। হবেও বা। তবু, দুশ্চিন্তা নাছোড়। বিপন্ন বিস্ময়ে সে প্রশ্ন তুলবেই: আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে, এমন অভিমান?

আরও পড়ুন
Advertisement