বছরের শেষ সপ্তাহে হারিয়ে ফেলা এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথা দিয়ে শুরু করি, যিনি বেশি কথা বলতেন না, সামনে থেকে দেখতে পাওয়ার সুবাদে এও জানি যে, আদৌ কথা বলতেই চাইতেন না, কিন্তু যেটুকু বলতেন, আদ্যন্ত সুবিবেচনা, সুচিন্তা থাকত তাতে। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদীর দেশচালনার রকম দেখে মনমোহন সিংহ বলেছিলেন, দেশের মানুষকে একটা আস্থা দিতে হয় যে দেশের সরকার তাঁদের কথা ভাবে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী সেটা মোটেই করছেন না। সে দিন দেশজোড়া হিন্দুত্ব-আস্ফালনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্পবাক নেতার এমন ভর্ৎসনার মৃদুত্ব তখন অনেককেই অসন্তুষ্ট করেছিল। কিন্তু মৃদু হলেও বাক্যবাণটির লক্ষ্য ছিল একেবারে যথার্থ। সংখ্যালঘুর প্রতি বিদ্বেষ এ দেশে আজ কোনও নতুন কথা নয়, উপরন্তু যত দিন যাচ্ছে প্রমাণ হচ্ছে এই ভারত কেবল সংখ্যালঘু বা প্রান্তিকদের কথাই ভাবে না তা নয়— সংখ্যাগুরুর সামাজিক-অর্থনৈতিক ভালমন্দও এখন বহুলাংশে শাসকের কাছে ‘নন-ইস্যু’ হয়ে গিয়েছে। ২০২৪ সালে দিকে দিকে, একেবারে ঘরের কাছেও, নেতা ও নেত্রীরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানুষের সঙ্গে দূরত্ব রচনা হলে তাঁদের কিছু আসে যায় না, তাঁরা ভোটের কথা ভাববেন, ক্ষমতায় থাকার প্রক্রিয়ার কথা ভাববেন— মানুষের ভালমন্দ ভাববেন না। ভোট চলবে ভোটের মতো, শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক কেবল দূর থেকে দূরতর হবে।
এ এক আশ্চর্য মিল, দেশে দেশে। বিশ্ব জুড়ে এ বছরটা ছিল ভোটের বছর— ৬০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন হল ২০২৪ সালে, প্রায় সর্বত্রই দেখা গেল ক্ষমতাসীন শাসককে বিপন্ন করে বেরিয়ে এসেছে শাসিতের রাগ। কোথাও তাঁদের সরে যেতে হয়েছে, যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট পার্টিকে, গ্রেট ব্রিটেনের টোরি পার্টিকে। কোথাও আবার শাসক ফিরে এসেছেন, কিন্তু গণ-ভর্ৎসনার শাস্তিস্বরূপ আগের চেয়ে কম ভোটের ঝুলি নিয়ে, যেমন ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান কিংবা ফ্রান্স।
ভোটের বাইরেও কথাটা বেরিয়ে এসেছে বইকি। এই বছরের অন্যতম প্রধান মুখ, বিতাড়িত শাসক, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা ওয়াজ়েদের কথা ভাবা যেতে পারে। ছাত্র-আন্দোলনের এলোমেলো হাওয়া যে ভাবে দ্রুত বেগে সুনামিতে পরিণত হল, তার মধ্যে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রণোদনা স্বীকার করতে হবে, কিন্তু তা তো ভুলিয়ে দিতে পারে না আসল কথাটা— মানুষের ক্রোধ। সেই ক্রোধ একটাই কথা বলতে চেয়েছে— তাঁদের শাসক তাঁদের কথা শোনেননি, শুনতে চাননি। স্পর্ধা ও সুবিধার বৃত্ত-পরিবৃত হয়ে তাঁরা জনগণকে ‘শাসন’ করেছেন, তাঁদের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করেননি।
প্রসঙ্গত, গণতন্ত্রের কথা থেকে একটু সরে গিয়ে মনে করে নিতে পারি, বছরের শেষ মাসের বিস্ময়ভূমি সিরিয়ার কথা। গত দু’-দুটো বছর ধরে আমরা ইউক্রেনে আর প্যালেস্টাইনে দু’-দুটো হিংস্র যুদ্ধ দেখে চলেছি, যথাসম্ভব তাদের ভয়ঙ্করতাকে ভুলে থাকাও আমরা অভ্যেস করে ফেলেছি, এমনকি দু’দিন আগে ইজ়রায়েল সিরিয়ার উপর যে হানা চালাল, তাতে নিউক্লিয়ার বোমার ব্যবহার হল বলে যে সন্দেহ তাকেও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছি না। ঠিক এই ভাবেই ২০১১ সালের মার্চ থেকে প্রায় পৌনে চোদ্দো বছর ধরে সিরিয়াতে এক অমানবিক বীভৎসতা ঘটে গিয়েছে, সেও আমরা অসাধারণ দক্ষতায় ভুলে থেকেছি। নেতৃত্বসঙ্কট কী ভাবে কোনও দেশকে ছারখার করে দিতে পারে, এই সব নিয়ে আমরা তত আলোচনা করি না আর। এখন যাঁরা তারুণ্যে উপনীত কিংবা তারুণ্য অতিক্রমী, তাঁরা বোধহয় ‘সিরীয় উদ্বাস্তু’ নামক ঘটনাটিকে আবহমান হিসেবেই দেখেন, ‘চলছে চলবে’ গোছের। খুব বেশি হলে সিরিয়ার দেশছাড়া মানুষ কী ভাবে পশ্চিমি গণতন্ত্রগুলিতে সঙ্কট তৈরি করেছে, দক্ষিণপন্থীদের দাপট বাড়িয়েছে, এটুকুই আলোচনার পরিসরে আসে। অথচ এমন ছিল না শতক-শেষের বেলা। বিশ শতকের শেষ ভাগেও দামাস্কাস ছিল পশ্চিম এশিয়ার কসমোপলিটান সভ্যতার উজ্জ্বল উদাহরণ, নানা দেশের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গেও, ছিল তার অনবরত আদানপ্রদান। অতঃপর, শীর্ষ-শাসকের দুঃশাসন, বৈভবের স্পর্ধা, দমন-নিপীড়নের তীব্রতা, এবং তার পর যুগান্তকারী বিদ্রোহে সেই সভ্যতা ধুলোয় মিশে গেল। এই বছরের শেষে বিদ্রোহের বিস্ফোরণ এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল যে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ কোনও ক্রমে প্রাণ নিয়ে পালালেন। এর পিছনে সুপারপাওয়ারসমূহের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ ছিল, ‘আরব বসন্ত’-এর অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই। আবার আরব বসন্তেরই বহুবিলম্বিত সমাপনী পর্ব হিসেবে সিরিয়ায় আজ যে নতুন শাসন শুরু হল, তা আগেকার জমানার চেয়ে অনেক বেশি অসহিষ্ণু, অনেক কড়া ধাতের ধর্মান্ধ মৌলবাদ।
প্রসঙ্গটা আজ আবার জরুরি হয়ে উঠেছে কেননা, এ বছর এশিয়ার পুবে ও পশ্চিমে যে দুই জন দেশশাসককে মানে-মানে দেশ ছেড়ে পালাতে হল, সিরিয়ায় ও বাংলাদেশে, দেখে অবাক লাগতে পারে কেমন ভাবে তাঁরা স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রকে এক ধারায় মিলিয়েছেন। বাশার আল-আসাদের থেকে নিজের দেশবাসীকে কিছু কম খেপিয়ে তোলেননি ভোটে ‘জিতে আসা’ হাসিনা। এই সূত্রেই আবার গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যায়, নেতৃত্বের প্রশ্নটা নিয়ে। আর এই প্রশ্নকেই বলা যেতে পারে, এ বছরের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কেবল অনুদারতন্ত্রের উত্থান নিয়েই নয়, উদারতন্ত্র বলে বাজারে যা চলে, তার পতনটাই বেশি করে ভাবা জরুরি। বার বার আমরা ভাবি, ট্রাম্প জিতলেন কেন। বরং আর একটু ভাবি, ডেমোক্র্যাটরা কেন মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারলেন না? প্যালেস্টাইন প্রশ্নে ছাত্রদের বেধড়ক পেটানো, ইউক্রেন আর ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে সহায়তা, শ্রমিকের কর্মপরিবেশ বিনষ্ট করা, দেশে কাজ তৈরি ও উপার্জন বৃদ্ধিতে বিপুল ভাবে ব্যর্থ বাইডেন আর হ্যারিসরা কি ভেবেছিলেন, প্রোপাগান্ডা দিয়েই ভোট পাবেন?
গণতন্ত্রের সঙ্কট কথাটা ইতিমধ্যে বহু-পরিচিত, কিন্তু কথাটার একটি দিক এখনও কম আলোচিত— এই সঙ্কট কতটা তন্ত্রের ‘স্ট্রাকচারাল’ বা গাঠনিক সমস্যা, আর কতটা যে নেতারা সেই তন্ত্র চালান, তাঁদের নেতৃত্বের ‘ফাংশনাল’ বা কার্যপ্রক্রিয়াগত সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পর্তুগাল, কিংবা দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন ডিসি, এই যে বিভিন্ন ছোট বড় গণতন্ত্রের বাসিন্দারা প্রায় এক সুরে বলছেন— তাঁদের নির্বাচিত নেতারা পাত্তাই দেন না তাঁদের কথায়, মতামতে, মানুষের ভোটেই জিতে এসে মানুষের প্রতি উদাসীনতা বা অবজ্ঞায় অবগাহন করেন, এর মধ্যে দিয়েই সেই ‘ফাংশনাল’ বিপদটা বেরিয়ে আসে বিরাট ভাবে।
সাম্প্রতিক বইতে রাষ্ট্রতাত্ত্বিক রুথ বেন-গিয়াত বলছেন, একেই আমরা বলতে পারি ‘গণতন্ত্রের জরুরি অবস্থা’। গণতন্ত্র থেকে ফ্যাসিবাদের রাস্তাটা আসলে বেশ সিধে, নাক-বরাবর। তার কতকগুলি নিশ্চিত ‘স্টেজ’ দেখাচ্ছেন তিনি, পড়তে গিয়ে গায়ে কাঁটা দেয়, সে সব এতই আমাদের চেনা বাস্তব। এই যেমন— এক, গণতন্ত্রের নেতা আজ প্রোপাগান্ডার দিকে বেশি মনোযোগী, প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ তার প্রধান শর্ত। দুই, দুর্নীতি হল সেই নেতার প্রিয় পথ, কেননা তা দিয়ে সামাজিক মতামত কেনাবেচা যায়, ব্যুরোক্র্যাসিকে মনের মতো করে ব্যবহার করা যায়। তিন, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগে হিংসার দৈনন্দিন ব্যবহার, যার মধ্যে হুমকি-প্রথা থেকে নির্যাতন-নিধন সবই পড়ে। চার, ‘মাচিসমো’, বা এমন ‘ইমেজ’ তৈরি যা আদ্যন্ত পৌরুষ-নির্ভর (অবস্থা বিশেষে, নারীও পৌরুষগুণভূষিত হতে পারে): সবার থেকে আমার বেশি ক্ষমতা, ‘ম্যান অ্যাবাভ অল মেন’, ‘সেভিয়ার অব দ্য নেশন’। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর প্রণেতা, কিংবা ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি’র ‘বিশ্বগুরু’, কে এই খেলা বেশি ভাল খেলছেন, তার উপর স্থির হবে নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ। নেতারাই তৈরি করে দিয়েছেন খেলার রীতিনীতি, ‘খেলা হবে’ সেই মতোই।
গণতন্ত্র নামক ব্যবস্থাটি যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু জানতেন এমন এক সঙ্কটের দিন আসবে, কোনও না কোনও দিন। আমেরিকান গণতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা আলেক্সান্ডার হ্যামিলটন বলেছিলেন (ফেডারালিস্ট পেপার্স), “ইতিহাস দেখিয়ে দেবে, যাঁরা এই ‘লিবার্টি’ বা ‘রিপাবলিক’-এর বিরুদ্ধতা করবেন, তাঁরা কিন্তু মানুষের দরবারে অর্চনা দিয়েই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন: কমেন্সিং ডিমাগগস, এন্ডিং টাইর্যান্টস।” এই শেষ কথাটা আজ আমাদের বর্তমান সময় প্রতি দিন অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করছে। তাই গণতন্ত্রকে উঠতে-বসতে দোষ না দিয়ে এই আস্থাভঙ্গকারী ক্ষমতালোভী ‘ডিমাগগ’ থেকে ‘টাইর্যান্ট’-এ পরিণত ‘গণতান্ত্রিক’ নেতাদের প্রশ্নবিদ্ধ করার দিন এখন।
কে জানে, তার থেকে বেরোতেও পারে একটা আশার পথ: গণতন্ত্র যে সঙ্কট তৈরি করেছে, তার সমাধানে ‘আরও গণতন্ত্র’।