পুস্তক পরিচয় ১

হোক চুলচেরা বিচার, হোক আর্কাইভও

তথ্যটা যখন প্রথম জানতে পারি চমকে উঠেছিলাম আমরা অনেকেই— মুম্বইয়ের হিন্দি কমার্শিয়াল সিনেমার দুটি বক্স-অফিস হিট ‘নাগিন’ এবং ‘মধুমতী’র কাহিনি বা চিত্রনাট্য নাকি রচনা করেছিলেন আমাদের বিজন ভট্টাচার্য এবং ঋত্বিক ঘটক!

Advertisement
বিভাস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০০:০১

তথ্যটা যখন প্রথম জানতে পারি চমকে উঠেছিলাম আমরা অনেকেই— মুম্বইয়ের হিন্দি কমার্শিয়াল সিনেমার দুটি বক্স-অফিস হিট ‘নাগিন’ এবং ‘মধুমতী’র কাহিনি বা চিত্রনাট্য নাকি রচনা করেছিলেন আমাদের বিজন ভট্টাচার্য এবং ঋত্বিক ঘটক! তেমনই মৃণাল সেন যখন ১৯৬৬-তে বাংলা সাহিত্যের দুটি জনপ্রিয় উপন্যাস জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার এবং কাঁচ কাটা হীরে-র চিত্রনাট্য লিখলেন পরিচালক অজিত লাহিড়ী এবং অজয় করের জন্য, তখনও কম বিস্মিত হইনি। আবার ছবিদুটিও কম জনপ্রিয় হয়নি। ঠিক ওই সময়টাতেই তাঁর বাংলা ছবি ‘আকাশকুসুম’ (১৯৬৫) এবং ওড়িয়া ভাষার ছবি ‘মাটির মনিষ’ (১৯৬৬) পর পর দু’বছর আঞ্চলিক ভাষার শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কারের স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। এবং সেই ছবি দুটিতে মৃণালবাবুর নতুন চিত্রভাষার সন্ধানের আগাম বার্তাও আমরা পেয়ে যাই। কিন্তু আমরা এটাও লক্ষ করব যে, প্রথমোক্ত চারটি ছবির কমার্শিয়াল সাফল্য বা জনপ্রিয়তা বিজন-ঋত্বিক-মৃণালকে পথ ভোলাতে পারেনি। তাঁরা যে যাঁর অভীষ্টে ফিরে গেলেন অচিরেই, ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়’ আপ্তবাক্যটি জেনেবুঝেই। তিনটি বছর পরেই, ১৯৬৯-এ মৃণাল সেনের হিন্দি ছবি ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন তরঙ্গের সূচনা করবে।

Advertisement

বেড়ে-ওঠা বা গড়ে-ওঠার পর্বে, আমরা জানতে পারি, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বংশী চন্দ্রগুপ্তদের পরিমণ্ডলটির কথা। ‘কালীঘাট দমকলের কাছে হেমবাবুর চায়ের দোকান— প্যারাডাইস কাফে, সকাল-সন্ধে ওখানে আমরা আড্ডা দিই।’ আড্ডায় প্রায়শই এসে পড়তেন আইজেনস্টাইন, অরসন ওয়েলস, রোজেলিনি, ডি সিকা, নিও-রিয়ালিজম, ‘প্যাশন অফ জোঅন অফ আর্ক’, এবং অবশ্যই মৃণালের দর্শনের এবং শিল্পের গুরু চ্যাপলিন। বাংলার রাজনীতিতে তখন বামপন্থা এবং শিল্প-সংস্কৃতিতে আন্তর্জাতিকতাবোধের প্রবল প্রভাব। অন্য দিকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীসাথী বা মণ্ডলী হয়তো একই নয়, কিন্তু এ সব থেকে খুব দূরে ছিল না তাঁর অবস্থান। তাই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হোক, বা ‘চলচ্চিত্র’ পত্রিকার প্রকাশই হোক, সবেতেই তো একজোট ছিলেন তাঁরা। সত্যজিৎ স্বীকার করেছেন, ‘আমি এবং ঋত্বিক-মৃণাল প্রায় একই সময় কাজ শুরু করি। কিন্তু ওরা যা ছবি করত, তা আমার থেকে ভিন্ন, একেবারেই ভিন্ন... কিন্তু আমি মনে করি সেগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী।’ সত্যজিৎ নিজে যা-ই বলুন না কেন, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো হেমন্ত-ধনঞ্জয়, শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত, উত্তম-সৌমিত্র এবং অবশ্যই সত্যজিৎ-মৃণাল বা সত্যজিৎ-ঋত্বিকের ছায়া-দ্বন্দ্বের সঙ্গে কুস্তি করে আমাদের গাত্রব্যথা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।

যিনি স্বীকার করেন যে, ভারতীয় ছবির সমাজবাস্তবতা ‘অনেকটাই জেনেছি সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-মৃণাল সেনের ছবি দেখে’ সেই আদুর গোপালকৃষ্ণনের খেদোক্তি: ‘আওয়ার কলোনিয়াল পাস্ট হ্যাজ ইনগ্রেনড ইন আস আ ডিপ সেন্স অফ সেল্ফ-ডেপ্রিকেশন অ্যান্ড ইনফিরিওরিটি’। তাঁর সঙ্গে সহমত কৃতী নাট্য ও চলচ্চিত্র আলোচক শিলাদিত্য সেন: ‘সম্ভবত সে জন্যই মৃণাল সেনের মতো শিল্পীকে এ দেশের সিনেমার অন্যতম পুরোধা হিসেবে মেনে নিতে এখনও যেন বাধো-বাধো ঠেকে কারও-কারও।... দীর্ঘ দু-শো বছরের পরাধীনতা আমাদের এমন এক অনিবার্য আত্মবৈপরীত্যের দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে যে আমরা ফিল্ম বিচারের কোনো স্বচ্ছন্দ নিয়ম বা শিল্পগত পদ্ধতি আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। আমাদের ছবি বোঝার আত্মবিশ্বাসেও লেগে আছে উপনিবেশের গ্রহণ!’

আর সেই খেদ এবং জেদ থেকেই শিলাদিত্য, যাঁকে ছাড়া ‘লিখতে গিয়ে, বলতে গিয়ে, ভাবতে গিয়ে’ তাঁর (মৃণাল সেনের) ‘চলেনি কখনও’, আলোচ্য গ্রন্থ মৃণাল সেনের ফিল্মযাত্রা প্রণয়নে উদ্যোগী হন। তাঁর উস্কানিদাতা ছিলেন সমমত-পোষণকারী শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রতিক্ষণ, যাঁরা বাংলার অনেক বহু মূল্য শিল্পসম্পদকে দুই মলাটের মধ্যে সংরক্ষণ করার কাজে ইতিমধ্যেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। কুড়ি বছর যাবৎ তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে-থাকা শিলাদিত্যর মৃণাল সেন সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ের নানান লেখা এবং ছবির আলোচনা ছাড়াও এই গ্রন্থে যুক্ত হয়েছে মৃণাল-জায়া অভিনেত্রী গীতা সেন, এবং মৃণাল-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা অঞ্জন দত্তের বয়ানে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথাসমূহ। সর্বোপরি, অমূল্য প্রাপ্তি স্বয়ং মৃণাল সেনের চারটি বয়ান— আমার প্রথম বই, তাহাদের কথা, কথোপকথন, পদাতিক থেকে মহাপৃথিবী।

লঘুতা ক্ষমা করলে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে— ‘গ্রোথ আপনা আপনা।’ অর্থাৎ যে যার মতো করে বেড়ে-ওঠে বা গড়ে-ওঠে। ‘কলকাতায় এসে (ফরিদপুর থেকে) কলেজে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু-আধটু রাজনীতিও করছি, চাকরিবাকরিরও খোঁজ করছি। মন্বন্তর, দাঙ্গা, নৌবিদ্রোহ, আজাদ হিন্দ সপ্তাহ, বন্দিমুক্তির মিছিল, ডাক-তার ধর্মঘট, শ্রমিক ধর্মঘট, রক্তপাত...’, অর্থাৎ ‘সমস্তের ঘোলা গঙ্গাস্রোতে’ সাঁতরে-সাঁতরে পাড়ি মৃণাল সেনের। আবার গীতা সেনের কথায়, ‘উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীতে ছিল আমাদের বাড়ি।... খুব অভাবী পরিবারে আমি মানুষ হয়েছি। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতেও অভাব পেয়েছি। পূর্ববাংলার একটি পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসে কীভাবে নিঃস্ব অবস্থায় দিন কাটিয়েছে, তাও আমি জানি। হুগলি আর ফরিদপুর, দু-বাংলার দু-ধরনের দরিদ্রজীবনই আমি চিনি। কখনো আমার মাকে, কখনো ওঁর মাকে এক অসহনীয় অবস্থা আর যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতে দেখেছি।’ ভাঙা বাড়ি, পোড়ো বাড়ি, ভাঙা মানুষ, ভাঙা বিবেক, ভাঙা পট, ধ্বস্ত দেশ, ধ্বস্ত পৃথিবী; আর তারই ছড়ানো টুকরোগুলো জুড়ে নিয়ে মৃণালের যাপনচিত্রই তাঁর চলচ্চিত্র। তাই আদ্য-মধ্য-অন্ত মেনে নিটোল গল্প বলা তাঁর ধাতে নেই। ফরাসি শব্দ ‘মন্তাজ’ মানে জোড়া।

জীবন থেকে পাঠ নিয়েছেন মৃণাল সেন, জনতার মুখরিত সখ্যে বাঁধা-পড়া এক মানুষ এবং শিল্পী। তাই ছবি করে বা দেখিয়েও তাঁর স্বস্তি নেই, প্রেক্ষাগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি নিয়ে জবাবদিহি করতেও দেখেছি তাঁকে, মোকাবিলা করতে দেখেছি অত্যন্ত চোখা-চোখা বা বোকা-বোকা প্রশ্নেরও। অন্য দিকে শিল্পসৃজনে বিজ্ঞান, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির এত ব্যাপক ভূমিকা সিনেমা ছাড়া আর কোনও শিল্পমাধ্যমে আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। তার খুঁটিনাটি, শক্তি-দুর্বলতা, প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ সর্ববিষয়েই শিক্ষার্থীর সকৌতূহল আগ্রহ নিয়ে মৃণালবাবুর পড়াশোনার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা আমাদের বিস্মিত করে। চলচ্চিত্রের ভাষা নির্মাণে সে সবের উদ্ভাবনী প্রয়োগের পিছনের ভাবনা বা ব্যাখ্যাও খুঁজে পাই তাঁর বয়ানে। ভাবনার আদান-প্রদান ঘটেছে তাঁর বিশ্বের তাবড় সব চিত্রনির্মাতা বা চলচ্চিত্রবিদদের সঙ্গে।

১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে সত্যজিৎ রায় একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রেক্ষাগৃহে, ‘অমল ভট্টাচার্য স্মৃতি বক্তৃতা’, সেটি ‘মাই লাইফ, মাই ওয়ার্ক’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বক্তৃতার বিষয় বলা যায়, ‘দ্য এডুকেশন অব আ ফিল্মমেকার’। মৃণাল সেনের ‘এডুকেশন’-এর বিস্তৃতি অপার, তা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর নিজের বয়ানে এবং শিলাদিত্যর অনেকগুলি লেখায়। তাঁর ফর্মের ভাঙচুর নিয়ে শিলাদিত্য এক জায়গায় লিখছেন: ‘শার্পকাট, ফ্রিজ শট, ইমেজের ফাঁকে ফাঁকে দুধ সাদা অথবা নিকষ কালো স্ক্রিন, সংলাপের সঙ্গে পূরক ইমেজ বা বিপরীতে অসমঞ্জস ইমেজ, সাউন্ড ও ইমেজের পারস্পরিকতা, আবার পারস্পরিকতাহীন সাউন্ড ও ইমেজের সমন্বিত শট, ট্রলিতে না চাপিয়ে হাতে ধরে ক্যামেরা চালানো, প্যামফ্লেট বা সাংবাদিকতার ঢঙে কমেন্টারি বা ন্যারেশন, আর তার পাশেপাশে সম-বিষম ভিন্ন ভিন্ন ভিশুয়াল ইমেজ, সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে-থাকা কোনো চরিত্রের সঙ্গে দর্শকের সংলাপবাহী কমিউনিকেশন, শক থেরাপি, ডকুমেন্টেশন, আভাঁ গার্দ বা সিনেমা ভেরিতে রীতিতে শট কম্পোজ ও ক্যামেরার কৌণিক বিন্যাস, স্যুররিয়্যালিজম, ফ্যান্টাসি, এক্সপ্রেশনিজম, ব্রেশটীয় পদ্ধতি অনুসারে পৃথক পৃথক এপিসোডে ন্যারেটিভের অখণ্ড প্যাটার্নকে ভেঙে ফেলা— এই সবকিছুই বা এই সবকিছু ছাপিয়েও আরও অনেক কিছু মৃণাল সেনের ফিল্ম তৈরির প্রকরণ, এবং অবশ্যই প্রকরণজাত শৈলীর নিদর্শন।’‌‌‌

বইটির অসংখ্য অসাধারণ আলোকচিত্র চোখকে তৃপ্তি দিয়েছে, তথ্যকে দৃশ্যায়িত করেছে। কাগজ, ছাপা, বাঁধাই-এর মানকে ততোধিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে শিল্পী যোগেন চৌধুরীর আঁকা মৃণাল সেনের স্কেচ-শোভিত প্রচ্ছদ। হোক, মৃণাল সেনকে নিয়ে হোক চুলচেরা বিচার, তর্ক-বিতর্ক, হোক কলরব, হোক একটা আর্কাইভও!

আরও পড়ুন
Advertisement