পুস্তক পরিচয় ২

সজীবতার সন্ধান তাঁর জীবন জুড়ে

জীবন কখনও বা হয়ে ওঠে নিরীক্ষার এক নিরাভরণ পরিক্রমা। সেই পরিক্রমা সহজলভ্য নয়; যাতে থাকে বঙ্গ-সাংস্কৃতিক রূপশৈলীর অন্যতম কারিগর হয়ে ওঠার কাহিনি। চুরানব্বই বছর বয়সে কয়েকশো ডায়ালিসিসের পরেও তিনি ছিলেন নির্বিকার!

Advertisement
দীপঙ্কর ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০১:৪৮
লোকায়ত থেকে রূপায়ত, প্রদীপ দত্ত। ধ্রুবপদ প্রকাশনী, ৫৫০.০০

লোকায়ত থেকে রূপায়ত, প্রদীপ দত্ত। ধ্রুবপদ প্রকাশনী, ৫৫০.০০

জীবন কখনও বা হয়ে ওঠে নিরীক্ষার এক নিরাভরণ পরিক্রমা। সেই পরিক্রমা সহজলভ্য নয়; যাতে থাকে বঙ্গ-সাংস্কৃতিক রূপশৈলীর অন্যতম কারিগর হয়ে ওঠার কাহিনি। চুরানব্বই বছর বয়সে কয়েকশো ডায়ালিসিসের পরেও তিনি ছিলেন নির্বিকার! একদিন রুগ্‌ণ দু’হাত ছড়িয়ে কথায় কথায় বললেন, ‘আমার একটা শরীরের মধ্যে গোটা চারেক পকেট আছে— এটা ফোক পকেট, এটা প্রচ্ছদ পকেট, এটা নাটক পকেট, এটা হচ্ছে বিবিধ।’ এমন আলাপের বহুমাত্রিক ইঙ্গিতে মিশে আছে— খালেদ চৌধুরীর জীবন-উত্তরণের ডানায় মেলা সহজিয়া যাপন। সেই যাপনের কথাকারও হয়ে ওঠেন তিনি। কথকতার বয়ানেই তৈরি প্রদীপ দত্তর আলোচ্য বইটি।

এ পরিক্রমার সূচনায়, আদিগন্ত মাঠে উড়ে যাওয়া খণ্ড মেঘের চলমান ছায়া-দেখা মন ছিল তাঁর। সে সময়ের অসমের সিলেটের চেপড়া গ্রামের লঙ্গাই নদীর পাড় ঘেঁসে নৌকার গুন টানা দেখত ছেলেটি। বাড়ির কোলে এই নদীর ধারেই তৈরি হয়েছিল তাঁর মায়ের চিতা। দশও পেরোয়নি তখন বয়েস। যে জীবন গড়া, বাবার অত্যাচারে ত্রস্ত-কালের বেদনার্ত ঘেরাটোপে। তবু, মাঠের দূরপ্রান্তে ছিল পাহাড়ের অবিরাম হাতছানি।

Advertisement

তাই, প্রতিকূলে গড়ে উঠতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার আখ্যান তৈরি হল না। ১৯১৯-২০১৪ জীবনকালে তাঁর নামের পরিচয়ও ধাঁধাঁর মতো। মা হেমনলিনীর মামা, প্রশাসক ও ব্রতচারীর পুরোধা গুরুসদয় দত্ত নাম রেখেছিলেন চিরকুমার। আবার, বাড়ির দেওয়া নাম হল চিররঞ্জন। কৈশোরকালেই যে বাড়ি তাঁর ‘নিজের’ হয়ে ওঠেনি। মায়ের মৃত্যুর পর, শেষ আশ্রয় বাড়ির কাজের মানুষ রমণী বাড়ি ছেড়ে যাওয়াতে, বাড়ির প্রতি টানও নির্মূলপ্রায় হল। বাড়িতে তখন বৈমাত্রেয় দাদা-দিদিরা আর নিজের ভাইবোন। পালিয়ে বেড়ানো সে সময়েই শুরু। নানা আশ্রয়ে নাম পাল্টে হল রহমান, করিম, ইউসুফ, আব্বাস— এমন কত। মুসলমান পরিবারে থেকে আচার-আচরণে মিশে, কৃতজ্ঞতা তখন মন জুড়ে। একসময় পারিবারিক নাম পাল্টেছেন, দত্তচৌধুরী পদবিও পাল্টে একটি ছবি এঁকে তাতে সই করলেন ‘খালেদ চৌধুরী’। সিলেটের পরিবেশে তখন ভাটিয়ালি, মনসামঙ্গল, ধামাইলের সুর-ছন্দের আবহ। ‘ঘুম ঘুম করেলো— ঘুমে মোরে ছাড়ে না’— তারুণ্যের স্পর্ধার মধ্যে নৌকাবাইচের গান তাঁকে টানছে।

সেই সূত্র ছিন্ন করে, সিলেটের চা-ব্যবসায়ী অজিত সিংহের বদান্যতায় এলেন কলকাতায়। স্বাধীনতা, দেশভাগ, দাঙ্গা, গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে পরিক্রমা— সব মিলিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা যুবাবয়সেই গভীর হতে লাগল। গান, নাচ, আঁকা, বাদ্যযন্ত্র তৈরি, নাট্য অভিনয়, পোশাক ভাবনা, প্রচ্ছদ-অলংকরণ আর মঞ্চসজ্জার দক্ষতার প্রস্ফুটন হল ফুলের পাপড়ি মেলার মতো। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তাপস সেন, ঋত্বিক ঘটক, কামরুল হাসান, নির্মলেন্দু চৌধুরী, চিত্তপ্রসাদ— এমন কত উদীয়মান প্রতিভার সঙ্গে কাজের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন। গানে দখল দেখে দেবব্রত বিশ্বাস তাঁকে ওস্তাদ বলছেন। শম্ভু মিত্র ‘বহুরূপী’তে টেনে নিলেন ‘রক্তকরবী’ নাটকের সূত্রে, কারণ তিনি তো বুঝেছেন লোকটি আঁকতে পারেন, যে কোনও বাজনা বাজাতে পারেন, গান বোঝেন আর তাঁর ভিতরে রয়েছে উদ্ভাবনী নিত্যনতুনের ক্ষমতা। দেখার চোখ আর নিজের মতো করে সৃষ্টি তাঁর সহজাত। কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক কাজকর্মেও মতবাদের আবেষ্টনে বন্দি হননি তিনি। এই উদ্দীপনায় পরবর্তীতে ‘ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ সক্রিয় হল রণজিৎ সিংহের মতো সহযোগীর একাত্মতায়। বইয়ের পাতায় পাতায় আলাপচারিতার স্বকীয় উচ্চারণ আমাদের মুগ্ধ করে। প্রচ্ছদপটে ‘খালেদ চৌধুরীর প্রামান্য জীবনী’, আবার আখ্যাপত্রে ‘খালেদ চৌধুরীর জীবন ও শিল্প’ এই ভিন্ন উপ-শিরোনাম, কখনও বানানে অসংগতি বা কিছু পুনরাবৃত্তি নিয়ে প্রশ্ন জাগলেও, এই বই আদতে খালেদ চৌধুরীকে আবিষ্কারের জগৎ। লেখকের এই ধৈর্য, পরিশ্রম ও নিবিষ্ট একাগ্রতাকেই কুর্নিশ জানাতে হয়।

কথাচ্ছলে নিজেকে ‘জোগাড়ে’ বললেও, নিজের দিশায় প্রত্যয়ী খালেদ বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দি’ নাটকে অভিনয়ও করেছেন। সময়ের ফেরে মেদিনীপুরে ‘নবান্ন’-র শেষ দিনেও অভিনয় করলেন। প্রথম ১৯৪৪-এ কলকাতায় এসে মহম্মদ আলি পার্কে দেখেছিলেন ‘নবান্ন’। পরের বছর পাকাপাকি ভাবে যখন কলকাতায় পৌঁছলেন, পকেটে ৬৪ টাকা আর হাতে ফুল আঁকা টিনের বাক্স। গোয়াবাগান কমিউনে মাসিক কুড়ি টাকা সুধী প্রধানের হাতে দিয়ে দিন গুজরান চলত। নব্বই পেরনো মানুষটির এ সব অনুভূতি আর সূক্ষ্ম স্মৃতির সান্নিধ্যে এসেছেন লেখক। এই সূত্রেই সুধীর চক্রবর্তীর আক্ষেপ-কথন, ‘বস্তুতপক্ষে খালেদ চৌধুরী আমাদের সবচেয়ে অব্যবহৃত মানুষ।’ এ সত্ত্বেও, নাটকের জন্য আঁকা অজস্র পোস্টার, হাজারো প্রচ্ছদপট, কত সুরের মতো হারিয়ে না গিয়ে বিস্তারী জীবনস্মৃতি অন্তত রক্ষা পেল। আগেও অন্য লেখায় তাঁর জগৎকে জেনেছি; কিন্তু এ বই খালেদ জীবনচর্যার এক খণ্ড ‘আর্কাইভ’ হয়ে রইল।

কলকাতায় কত ঠিকানা পাল্টে পাল্টে একক খালেদ পথ হেঁটেছেন। ছিন্ন শিকড়ে, সজীবতার সন্ধান তাঁর জীবন জুড়ে। বইতে ছোটবেলার স্কুল, বাড়ি, নদীর সাম্প্রতিক তোলা ছবিতে মেদুরতার ছোঁয়া পেতে পেতে দেখা হয়ে যায় তাঁর হাতে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মভূষণ’-এর ছবি। রামকিঙ্কর তূরীয় মেজাজে বরাবর ‘খালেক’ নামেই ডাকতেন। এমন প্রতিভার ‘পাগলামি’র ছোঁয়াও আছে বইটিতে। বংশলতিকা, জীবনপঞ্জি, মঞ্চচিত্রণ ও আবহ সৃজনের পঞ্জি, লেখা বই ও প্রবন্ধ, তাঁকে নিয়ে লেখা, অজস্র প্রচ্ছদের তালিকা, প্রাপ্ত পুরস্কারের তালিকা, রুবাইয়াত ছবির অ্যালবাম, প্রচ্ছদপট, নাটক ও নামপত্রের রঙিন নমুনাচিত্র বইটির অন্যতম আকর্ষণ। এ সবে জীবনব্যাপী কাজের হদিশ থাকলেও— এতে আছে জীবনপর্বের প্রথম চল্লিশ বছরের কথা। আশা করা যায়, পরবর্তী অংশ থাকবে আর একটি খণ্ডে।

স্বশিক্ষিত মানুষটির স্মৃতিতথ্যের মুগ্ধতায় জড়িয়ে যেতে হয় বইটি পড়তে পড়তেই। ফার্ন রোডে অমিতা চক্রবর্তীর বাড়িতে জীবনের শেষ দশ বছর কাটিয়ে গেলেন বাড়ি পালানো ছেলেটি। মায়াটানের মানচিত্রে শেষকালেও অন্তর ছুঁয়ে ছিল, বাড়ি ছেড়ে আসার সময় তাঁর ছোট্ট বোন ফোকলা দাঁতের পারুলের কথা। সময়কে দাঁড় করিয়ে এই বই খালেদ চৌধুরীর জীবন ও সৃজনসত্তার নির্লিপ্ত উদ্ঘাটন। আজকের কোলাহল আর স্ব-ঘোষণার বিপ্রতীপে, বইটিতে সেই ব্যতিক্রমী জীবন উদ্‌যাপনেরই বাস্তবতা। উদ্‌যাপনের এই উচ্চারণ আমাদের কাছে রঙিন হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন
Advertisement