চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

স্মৃতির অতীতে আলোড়িত হয় বর্তমান

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত ‘ফলোইং দ্য বক্স’ শীর্ষক সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।পুরনো ছবির মধ্যে সব সময়ই কিছু স্মৃতি-মেদুরতা থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নস্টালজিয়া’। সেই স্মৃতির অতীত কেমন করে বর্তমানকে আলোড়িত করে তারই কিছু নিদর্শন দেখা গেল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলক প্রদর্শনীতে, যার শিরোনাম ‘ফলোইং দ্য বক্স’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০০:০১

পুরনো ছবির মধ্যে সব সময়ই কিছু স্মৃতি-মেদুরতা থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নস্টালজিয়া’। সেই স্মৃতির অতীত কেমন করে বর্তমানকে আলোড়িত করে তারই কিছু নিদর্শন দেখা গেল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলক প্রদর্শনীতে, যার শিরোনাম ‘ফলোইং দ্য বক্স’।

১৯৪৫ সালের মে মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যে সব আমেরিকান ও অন্য বিদেশি সৈন্য যুদ্ধ উপলক্ষে এদেশে এসেছিলেন, তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই সময় একজন আমেরিকান সৈনিক খড়গপুরের কাছে একটি মিলিটারি-ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। ফিরে যাওয়ার আগে তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে তাঁর ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছিলেন। সেই প্রায় ১২৭-টি ছবি ও নেগেটিভ বাক্সবন্দি হয়ে এক সময় চলে যায় শিকাগোর একটি সংগ্রহালয়ে। বহু দিন পরে যেটি উদ্ধার করেন এক শিল্পী-দম্পতি অ্যালান টেলার ও জেরি জিবরাল। নৃতত্ত্ব ও আলোকচিত্র মূলত তাঁদের চর্চা ও গবেষণার বিষয়। সংগৃহীত সেই আলোকচিত্রের ভিত্তিতে তাঁরা আলোচ্য প্রদর্শনীটির পরিকল্পনা করেন, যেখানে তাঁরা ছাড়া এখানকার দশজন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন। অতীতকে বর্তমানে প্রতিস্থাপিত করেছেন। কনসেপচুয়াল-আর্টের এই ব্যঞ্জনাময় দৃষ্টান্তগুলি এই সময়ের নিহিত সংকটকে শিল্পঋদ্ধ ভাবে উন্মীলিত করেছে। আদিত্য বসাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে মনে রেখে যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক আবহমণ্ডল তৈরি করেছেন বাস্তব ও কল্পরূপের সমন্বয়ে। ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা প্রতিমাপুঞ্জের সঙ্গে ডিজিটাল মিশিয়ে নিজস্ব আঙ্গিকপদ্ধতিতে কাজ করেছেন। বিভিন্ন যুদ্ধোন্মত্ত দেশের পতাকা উড়ছে। ছড়িয়ে রয়েছে মৃত-মানুষের করোটি। ভূমিতে অবস্থিত যুদ্ধবিমানের সামনে সুসজ্জিত সৈনিকরা মার্চ করছে। পথের উপর বসে আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষ আহার করছে। আর চিত্রক্ষেত্রের প্রায় মধ্যভাগে উড়ে আসছে একটি প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর কঙ্কাল। অনাদিকাল থেকে যুদ্ধের সন্ত্রাস ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তারই কল্পরূপাত্মক আখ্যান আদিত্যর ছবি।

Advertisement

মমতা বসাকের ছবিতে চলচ্চিত্রের প্রবহমানতাও রয়েছে। প্রতিমাকল্পে তিনি এনেছেন বিপন্ন সমাজবাস্তবতার নানা আলেখ্য।

ছত্রপতি দত্তের (১৯৬৪)রচনাটি এই প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজের দৃষ্টান্ত। শিরোনাম: ‘বক্স উইথ নো বাউন্ডারিজ’। তিনটি দেয়াল জুড়ে প্রবল নির্ঘোষে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধবিমান। ছ’টি বর্গাকার আলোড়িত প্রকোষ্ঠ সমস্থাপিত সেই দেয়ালে। তাতে সেরিগ্রাফে ও ভিনাইল প্রিন্টে রূপায়িত হয়েছে যুদ্ধ, ধ্বংস ও বিপর্যস্ত মানুষের নানা আলেখ্য। জীবনের ও প্রবহমান অস্তিত্বের নানা স্তর থেকে তুলে এনেছেন প্রতিমাপুঞ্জ।

সুনন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাক্তন আলোকচিত্রের সঙ্গে পুরাণকল্পভিত্তিক অনুচিত্রীয় প্রতিমাকল্পকে সমন্বিত করে কাজ করেছেন। পুরনো আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের সামনে উপাসনায় মগ্ন কয়েকজন মানুষ। সম্মুখপটে শিল্পী স্থাপন করেছেন মহিষাসুরমর্দিনীর ঝংকৃত বর্ণিল আলেখ্য। পাশে বংশীবাদনরত শ্রীকৃষ্ণও রয়েছেন। বাস্তব ও পুরাণকল্পের বিভিন্ন স্তরকে সমন্বিত করে কল্পরূপের দিকে নিয়ে গেছেন তিনিও।

লৌকিক পটচিত্রী স্বর্ণ চিত্রকর পোস্টমডার্ন লৌকিককে কী ভাবে আধুনিকের মূল স্রোতে সমপৃক্ত করতে চায়, এ তারই এক দৃষ্টান্ত। ৭০ বছরের পুরনো আলোকচিত্র নিয়ে গান বেঁধেছেন স্বর্ণ চিত্রকর।

অমৃতা সেন ‘ফলোইং দ্য বক্স’ শীর্ষক প্রকল্পে ১৯৪৫-এর আলোকচিত্রমালার সঙ্গে মিলিয়েছেন তাঁর পারিবারিক সংগ্রহের পুরনো আলোকচিত্রকে। এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন নিজের অঙ্কন।

সঞ্জীৎ চৌধুরী একজন আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্রকার। এই প্রদর্শনীতে তিনি দেখিয়েছেন ৬ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের একটি ভিডিও, যার শিরোনাম ‘লেটার্স টু রাচেল’। ১৯৪৫-এর সেই ছবিগুলোর কথা মনে রেখে তিনি গড়ে তুলেছেন এক প্রবহমান আলেখ্য যেখানে একজন ভিনদেশি মানুষ বাইরে থেকে দেখে অনুধাবনের চেষ্টা করছেন ভারতের বাস্তবতা ও সংস্কৃতির নানা দিক।

সর্বজিৎ সেন এই প্রদর্শনীতে কার্টুনধর্মী রূপারোপ নিয়েই কাজ করেছেন। এছাড়াও প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন অলকানন্দা নাগ, অ্যালান টেলার, জেরি জিবরাল ও প্রবীর পুরকায়স্থ।

আরও পড়ুন
Advertisement