পুস্তক পরিচয় ২

স্বয়ং কবির অন্বেষণ তাঁর বড় আমিকে

রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর যোগাযোগের কাহিনি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থে বিস্তৃত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্জেন্টিনায় কবির বসবাসের বিস্তারিত বিবরণ নানা ভাবে বিশ্লেষিত। ইস্পানো-আমেরিকার বৌদ্ধিক জগৎ রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিল আবেগঘন দৃষ্টিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১

রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর যোগাযোগের কাহিনি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থে বিস্তৃত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্জেন্টিনায় কবির বসবাসের বিস্তারিত বিবরণ নানা ভাবে বিশ্লেষিত। ইস্পানো-আমেরিকার বৌদ্ধিক জগৎ রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিল আবেগঘন দৃষ্টিতে। রাজু আলাউদ্দিন দক্ষিণে সূর্যোদয় (অবসর, ঢাকা, ৫০০.০০) গ্রন্থে ইস্পানো-আমেরিকায় রবীন্দ্র চর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। লাতিন আমেরিকার নেতৃস্থানীয় লেখকরা রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের প্রতি কী ভাবে সাড়া দিয়েছিলেন, সেখানকার সংস্কৃতিতে কবির উজ্জ্বল উপস্থিতির বহু নমুনা সংগৃহীত হয়েছে। গ্রন্থে বহু বিদেশি লেখকের নাম আছে, সে ক্ষেত্রে লেখকনাম জীবনকাল সহ রোমান হরফে পাশাপাশি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন অভ্র বসুর গীতাঞ্জলির ঈশ্বর (টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ২৫০.০০)। গ্রন্থনাম যে প্রবন্ধটিকে আলোকিত করেছে, সেটিই মুখ্য। ‘আমার মাথা নত করে দাও’, ‘সকল গর্ব দূর করি দিব’ বিভিন্ন উদ্ধৃতি তুলে গোড়া থেকেই লেখক প্রমাণ করতে চেয়েছেন ঈশ্বর ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের আত্মবিরোধ। শতবর্ষ অতিক্রান্ত গীতাঞ্জলি-র কবিতা পৃথিবীর বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছে শুধু নয়, আপ্লুতও করেছে। গীতাঞ্জলি-র মধ্যে দিয়ে স্বয়ং কবির অন্বেষণও তাঁর বড় আমিটিকে। রবীন্দ্রনাথ তো কবি, তত্ত্বদর্শী নন, তিনি তো কিছু প্রমাণ করতে বসেননি।

Advertisement

বহুচর্চিত বহুগ্রন্থিত বিষয় রবীন্দ্র-সঙ্গজনকে কেন্দ্র করে অনুত্তম ভট্টাচার্যের রবীন্দ্র সান্নিধ্যে বিশ্বজন (প্রতিভাস, ৪০০.০০)। ভূমিকা জানাচ্ছে, চার-পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিতব্য গ্রন্থের ‘শেষ বা সংযোজন খণ্ডে ছেড়ে-যাওয়া ব্যক্তিদের আলোচনা থাকবে।’ কার ছেড়ে যাওয়া, রবীন্দ্রনাথ না গ্রন্থকারের? আভিধানিক সজ্জায়-রীতিতে গ্রন্থটির প্রকাশ অথচ সে ধারার কোনও কিছুই মান্য করা হয়নি। আইনস্টাইন, আলবার্ট; আঁদ্রে কার্পেলো; আনা তড়খড়; আর্নেস্ট রীহ্‌স; ইয়েটস; উইলিয়ম বার্টলার; উইন্টারনিজ; উইলিয়ম ভন মুডি (মৃত্যু ১৯১০, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হৃদ্যতা হয়েছিল এঁর স্ত্রী হ্যারিয়েট মুডি-র), উইলিয়ম উইনস্ট্যানলি পিয়রসন; উইলিয়ম রোদেনস্টাইন; এজরা পাউন্ড; এডওয়ার্ড টমসন; এল্‌মহার্স্ট; ওকাকুরা কাকুজো; নির্দেশিকার এই এলোমেলো চেহারাই বইটির পরিচয়।

‘অনুমান’ আর ‘সম্ভবত’-র জোড়ে ৩৬০ পাতার রয়্যাল সাইজের বইয়ের বিষয় রবীন্দ্রনাথ: অক্সফোর্ড ও ডি. লিট প্রসঙ্গ (পত্রলেখা, ৪০০.০০)। বিজন ঘোষাল রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে অক্সফোর্ড সম্বন্ধীয় যা-কিছু, সবই দুই মলাটবন্দি করেছেন। ‘সময়ের দাঁড়িপাল্লায় ডি.লিট প্রদানের দিনটির এক দিকে আছে আটত্রিশ বছরের ইতিহাস অপর দিকে মাত্র এক বছরের।’

‘প্রবাসী সম্পাদক সর্বদা তাঁর লেখার দ্বারা, নিজের দ্বারা, পরামর্শ দ্বারা মমত্বের বহুবিধ পরিচয়ের দ্বারা বিশ্বভারতীর যথেষ্ট আনুকূল্য করেছেন।... তিনি আমার অতি ভার পীড়িত আয়ুকেই রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন।... আমার অল্প সংখ্যক কর্মসুহৃদের মধ্যে প্রবাসী সম্পাদক অন্যতম।’ ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক চার দশকের বেশি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি রবীন্দ্র বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন রবীন্দ্রনাথ (সম্পা: অর্ণব নাগ। সূত্রধর, ১৫০.০০)

গাঁধীজির কাছে রবীন্দ্রনাথের শেষ ইচ্ছেটুকু মহাত্মা সঁপে দিয়েছিলেন ভারত ভাগ্য নির্ধারকদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের কাল অস্তমিত হলে ভারত সরকারের অধীন বিশ্বভারতীর আর অর্থের অভাব রইল না। বিশ্বভারতীর ভাবনা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই বিদায় নিয়েছে। সংসদ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে পথে চলছে বিশ্বভারতী। সংসদে বিশ্বভারতী প্রসঙ্গ গ্রন্থিত করেছেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহ এবং দেবপ্রসাদ সিংহ বিশ্বভারতী: প্রতিষ্ঠা প্রয়াসে সংসদ (এন ই পাবলিশার্স, ১৫০.০০)। সংসদের হাতে পড়ে বিশ্বভারতীর যে অবস্থা, একই অবস্থা দুই সিংহের গ্রন্থটিতে। পাতায় পাতায় বানান, শব্দ বিন্যাস, ব্যক্তিনাম ভুলের দগদগে আবরণ।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম আলাপ শান্তিনিকেতনে এক সমাজসেবক কর্মীদের সম্মেলনে। কর্মী-মুখপাত্র ছিলেন তারাশঙ্কর। লেখক তারাশঙ্করের রচনাকে রবীন্দ্রনাথ ভাল লাগার স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কবির পল্লিভাবনা আজীবন তারাশঙ্করকে নতুনের পথ দেখিয়েছে। বিশ্বভারতীতে দেওয়া তারাশঙ্করের বক্তৃতা (রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী, ১৯৭১) এবং ছড়ানো-ছিটানো বক্তৃতা ও লেখার সংকলন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে (দে’জ, ২০০.০০) সম্পাদনা করেছেন সুরজিৎ দাশগুপ্ত। রবীন্দ্র রচনার উদ্ধৃতিগুলি রবীন্দ্র রচনাবলি থেকে মিলিয়ে নিলে গ্রন্থটির মর্যাদা বাড়ত।

বিষয়বৈচিত্র তো বটেই, রবীন্দ্রগানের গড়নের ইতিবৃত্ত দীপান্বিতা সেনের অনুপুঙ্খ আলোচনায়। রবীন্দ্রসংগীতে তালবৈচিত্র, স্বরলিপি ও তার গায়কী, ধ্রুপদ-ধামার-খেয়াল-টপ্পা-ঠুংরি-কীর্তন-বাউল গানের প্রভাব, পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব ইত্যাদি আলোচনা রবীন্দ্রনাথের গানের ভুবন-এ (পরিবর্ধিত পারুল সং, ১৫০.০০)। কবির কবিতা থেকে গান, ভানুসিংহের পদাবলী, গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য নিয়েও তন্নিষ্ঠ আলোচনা। ‘রবীন্দ্রসংগীত-সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন’, এ-বই সম্পর্কে মন্তব্য সুবিনয় রায়ের। রসিক শ্রোতা থেকে শিক্ষার্থী বা গবেষক, সকলের কাছেই প্রয়োজনীয় এ-বই।

আরও পড়ুন
Advertisement