পুস্তক পরিচয় ২

যাঁরা দ্বারস্থ হন না, ক্ষতিটা তাঁদেরই

প্রবীণ রবীন্দ্ররসবেত্তা উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের অধুনাকালে লেখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন রবীন্দ্রনাথ/ তুমিই আকাশ, তুমিই নীড় (গাঙচিল, ৩২৫.০০)। তাঁর নিজের কথায় ‘রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রতিভার অনিঃশেষ বৈচিত্রকে খানিকটা ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা এই সংকলনে রইল।’ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বা গীতাঞ্জলি-র শতবর্ষ উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধগুলির যোগে এই সংকলন। প্রবন্ধকার ভারী-ভারী তত্ত্বকথার জালে আটকা পড়েননি, যে বিষয়ই বেছে নিন, যেন তিনি তাঁর আলোটি জ্বালিয়ে নিয়ে শান্ত পায়ে পাঠককে সঙ্গী করে রবীন্দ্রমানসের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০০:০১

প্রবীণ রবীন্দ্ররসবেত্তা উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের অধুনাকালে লেখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন রবীন্দ্রনাথ/ তুমিই আকাশ, তুমিই নীড় (গাঙচিল, ৩২৫.০০)। তাঁর নিজের কথায় ‘রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রতিভার অনিঃশেষ বৈচিত্রকে খানিকটা ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা এই সংকলনে রইল।’ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বা গীতাঞ্জলি-র শতবর্ষ উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধগুলির যোগে এই সংকলন। প্রবন্ধকার ভারী-ভারী তত্ত্বকথার জালে আটকা পড়েননি, যে বিষয়ই বেছে নিন, যেন তিনি তাঁর আলোটি জ্বালিয়ে নিয়ে শান্ত পায়ে পাঠককে সঙ্গী করে রবীন্দ্রমানসের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। বিষয় বৈচিত্রও পাঠককে টানে। ‘রবীন্দ্রনাথ: পরিবেশ ভাবনার অগ্রদূত’ প্রবন্ধটি শিরোনামের চেনা অর্থ ছাপিয়ে এমন করে বহু দূরের প্রেক্ষাপটে আলোচ্য প্রসঙ্গকে প্রতিষ্ঠিত করে, যা ভাবায়।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু জুটেছিল আমিয়েলস্ জার্নাল। অবসর সময়ে পড়তে পড়তে মনে হত যেন এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন মুখোমুখি বসে। কখনও সেই বন্ধুর স্মৃতির ছোঁয়া রয়ে গেল রবীন্দ্রসাহিত্যে, কখনও কবির আলাপচারিতায়। ছিন্নপত্রাবলী পড়তে গিয়ে এই ফরাসি বইটি আকৃষ্ট করে শ্রুতিনাথ চক্রবর্তীকে। সেই সাগ্রহ পাঠ এ বার রূপ নিয়েছে আমিয়েল ও রবীন্দ্রনাথ (একুশ শতক, ১৭৫.০০)। আমিয়েলস্ জার্নাল প্রকাশিত হয় ১৮৮২-তে, লেখকের মৃত্যুর পরে। ইংরেজি অনুবাদ ১৮৮৫-তে। রবীন্দ্রনাথের হাতে এসেছিল দ্বিতীয় সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ (১৮৮৯)। শ্রুতিনাথ আরম্ভ করেছেন আমিয়েলের জীবনপরিচয় ও জার্নালের আয়নায় দেখা তাঁর অন্তর্লোকের পরিচয় দিয়ে। সমান্তরালে কবির অন্তর্লোকের উদ্ঘাটন দুই আপাত পৃথক সত্তার সমভাবাপন্ন আত্মপ্রকাশের দুনিয়া থেকে বিচিত্র রত্ন আহরণে তাঁকে নিবিষ্ট করেছে।

Advertisement

গোপালচন্দ্র রায়ের ছিন্নপত্রাবলীর রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে কিছু তথ্যের হদিশ মিলেছিল, মধুরা চক্রবর্তী সম্পাদিত ছিন্নপত্রের তথ্যকোষ (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ৪০০.০০) গ্রন্থে বিস্তৃত টীকাযোগে বিপুল তথ্য আহৃত হল, ব্যাখ্যা পাওয়া গেল বিবিধ প্রসঙ্গের। অজানা তথ্য ও অনুক্ত পত্র-ধৃত ব্যক্তিনাম যথেষ্ট নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে উদ্ধার করেছেন মধুরা। কিন্তু অনেক সময় বাহুল্য কথন বা কোথাও ছিন্নপত্রকারের সরস মন্তব্যের সূত্রে সুগম্ভীর তথ্যবিন্যাসের প্রবণতা রসাভাস ঘটিয়েছে। অযথা দীর্ঘ উদ্ধৃতিও বৃথাভার বাড়িয়েছে। প্রতি চিঠির অন্তে টীকায় একই গ্রন্থনাম উল্লেখ করতে হলেও, লেখক ও প্রকাশকনামের সংযোজন কেন। এমনকী রবীন্দ্ররচনাবলী-র পাশেও লেখকনাম ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’! তথ্যভার জমেছে অনেক, তার আপন মূল্য যা-ই হোক, সেই মূল্যের দ্বারা ছিন্নপত্র-র আসল মেজাজটাকে ধরা যায় না।

শহর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ (পত্রলেখা, ২০০.০০) লেখক তুহিনশুভ্র ভট্টাচার্য গোড়াতেই জানিয়েছেন, এ বইয়ের উদ্দেশ্য রবীন্দ্রস্মৃতি-বিজড়িত ঐতিহ্যপূর্ণ বাড়িগুলির পরিচয় দেওয়া। কয়েকটি বাড়ির ঠিকানা-সহ রবীন্দ্রযোগের কিছু উল্লেখ পাওয়া গেল। বাড়িগুলির পরিচয় বলতে অবশ্য তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, প্রশ্ন ওঠে। প্রথম দিকটায় বিষয়-উপস্থাপনের ধরনটা অনেকটাই রবিজীবনী-র মতো, বিভিন্ন খণ্ডগুলি থেকে সাহায্যও পেয়েছেন। পরে রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্তই কলকাতার সঙ্গে তাঁর পথ চলার বিবরণ কিছু কিছু এল, তথ্য সমাবেশ খুব কম নয়। তবে স্থানগত প্রেক্ষিতটাই শুধু শহর কলকাতা দিয়েছে, ক্যানভাসের বাকি সবটাই সেই মানুষটির দখলে।

পিনাকী ভাদুড়ীর রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে (প্রয়াগ প্রকাশনী, ২৪০.০০) গ্রন্থটি প্রবন্ধগুচ্ছে নানা রবীন্দ্রনাথের মালা গাঁথা। প্রাবন্ধিকের ব্যক্তি অনুভবে জারিত ‘একটি কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা’। জীবনীর ফাঁক ভরানোর দায় থাকেই, তবে রবীন্দ্রনাথের কোন বয়সে কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বর বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে শিলাইদহ যাওয়া, এ সব আর অজানা নয়।

কয়েকটি প্রবন্ধ, কয়েকজন লেখক। নানা জনে ভাবছেন নানা দিক থেকে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে দেখছেন: মননে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা রীণা কর (দত্ত) ও রঞ্জিনী বসু (পুস্তক বিপণি, ১০০.০০)। প্রবন্ধগুলি তথ্যনির্ভর, সুলিখিত।

নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেকগুলি প্রবন্ধের সমাহার জ্যোতির কনকপদ্ম (কারিগর, ৩৫০.০০)। প্রচ্ছদ পরিচয়ে প্রবীণ এই বিশিষ্ট রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞকে ‘রবীন্দ্রবিদূষক আখ্যাত’ বলা হয়েছে। রবীন্দ্রপাঠমুগ্ধ কোনও লেখকের পরিচয় দিতে কি ‘রবীন্দ্রস্তাবক’ বলা হয়? অত্যুক্তি হবে না যদি বলা যায়, এই গ্রন্থের অনতিদীর্ঘ প্রবন্ধগুলি রবীন্দ্রনাথের চেনা জীবন, চেনা সাহিত্য, চেনা ভাবনার অঙ্গন থেকে যাত্রা করে নতুনের পথকে যে-ভাবে আলোকিত করে তোলে, ‘হিসাব কোথাও তার কিছু নেই’। বহু বৈচিত্র গ্রন্থ জুড়ে। ‘হিন্দুত্ব কী’ প্রবন্ধের শুরু গোরা-য় পরেশবাবুর একটি মন্তব্য দিয়ে, প্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রবন্ধকারকে ১৯৪৭ সালের অপরিহার্য বাংলা বিভাজনের তথ্যবহুল বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত করেছে। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘জ্যোতির কনকপদ্ম’। সেই কবে থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতার বিচার চলে আসছে। আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ কেন প্রাসঙ্গিক, সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন লেখক। কোথায় কেন তিনি প্রাসঙ্গিক নন, সে-সব কথা এল। নেতির দিকটা ভারী যথেষ্ট। শেষে বললেন, ‘সংক্ষুব্ধ সংসারের আন্দোলন থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য, জ্যোতির কনকপদ্মটির ক্ষণিক দর্শন পাওয়ার আশায় আমরা এখনও রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হই। যাঁরা হন না, ক্ষতিটা তাঁদেরই।’ কয়েকটি মুদ্রণত্রুটি চোখে পড়ল, সর্বোপরি সরলা ঠাকুর কী করে এল!

আরও পড়ুন
Advertisement