চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

যান্ত্রিক কৌণিকতায় এক প্রবহমান জীবন

সম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল সতীশ গুজরালের একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষসম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল সতীশ গুজরালের একক প্রদর্শনী। নব্বই বছর বয়সে পদার্পণের প্রাক্কালে তাঁর প্রতি সম্মানার্থে আকৃতি গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল প্রদর্শনী: ‘সতীশ গুজরালের শিল্পের ভুবন’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১

১৯৪০-এর দশকের শিল্পকলার অনেকগুলি অভিমুখ আছে। কিন্তু তার মূল কেন্দ্র একটাই। ভাবনার দিক থেকে সামাজিক দায়বোধ। আঙ্গিকের দিক থেকে প্রাচ্য-ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্য-আধুনিকতার মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আত্মপরিচয় নির্মাণের প্রয়াস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তখন নানারকম আলোড়ন চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এদেশে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয় আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পরিণতি দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বাস্তুহারা উদ্বাস্তুর মিছিল। এইসব বিমানবিক বাস্তবতা রয়েছে চল্লিশের শিল্পীদের বিকাশের প্রেক্ষাপটে। এই বাংলায় যেমন, বাংলার বাইরেও। প্রেক্ষাপট ও সামাজিক দায়বোধের চরিত্র একই রকম ছিল। এই বাস্তবতাকে আত্মস্থ করেই উত্তর-ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতি-সম্পন্ন একজন শিল্পী সতীশ গুজরালের শিল্পের বিকাশ। নব্বই বছর বয়সে পদার্পণের প্রাক্কালে তাঁর প্রতি সম্মানার্থে আকৃতি গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল প্রদর্শনী: ‘সতীশ গুজরালের শিল্পের ভুবন’।

Advertisement

তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেশভাগ-পূর্ববর্তী পাঞ্জাবের ঝিলমে। পিতা অবতার নারায়ণ পেশায় আইনজীবী ছিলেন। মহাত্মা গাঁধীর পথ অনুসরণ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই পারিবারিক রাজনৈতিক আবহ থেকেই সতীশের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছিল সামাজিক সচেতনতা ও দায়বোধ। আট বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বধিরতা তার বাকশক্তিকেও নষ্ট করে। এই দ্বিমুখী প্রতিবন্ধকতা তাঁর সৃজনে বিশেষ কিছু মাত্রা সঞ্চারিত করেছে। দেশভাগের পর গুজরালও জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হলেন। সাম্প্রদায়িক হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করলেন। কৈশোরের এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা তাঁর চেতনায় যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তাই হয়ে উঠল তাঁর বিশ্বদৃষ্টির নিয়ন্ত্রক।

১৯৩৯-এ লাহৌরের মেয়ো স্কুল, ১৯৪৪-এ বম্বের জে.জে. স্কুল অব আর্টস। শারীরিক অসুস্থতায় আর্ট স্কুলের শিক্ষা শেষ হল না। ১৯৫২-তে স্কলারশিপ নিয়ে মেক্সিকো। এখানকার শিল্প তাঁকে আদিমতার উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সচেতন করল। এর সঙ্গে মিশল দেশীয় লৌকিক।

সতীশ গুজরাল একাধারে স্থপতি, ভিত্তিচিত্রকর, চিত্রী ও ভাস্কর। চল্লিশের দশক থেকে তাঁর কাজ নানাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। আলোচ্য প্রদর্শনীর কাজে তিনি যান্ত্রিকতার সঙ্গে লৌকিককে অসামান্য প্রজ্ঞায় মিলিয়েছেন। আধুনিক সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য যন্ত্র-নির্ভরতা। হয়তো সেই ভাবনা থেকেই তিনি মানুষ বা অন্য প্রাণীর অবয়বকে যান্ত্রিক ভাবে বিশ্লিষ্ট করেছেন। অবয়বগুলি আয়তমান। এই আয়তনকে বিশ্লিষ্ট করেছেন দুভাবে। লোককলার সারল্যের সঙ্গে কিউবিস্টিক জ্যামিতিক ও যান্ত্রিক কৌণিকতাকে সমন্বিত করেছেন। পৌরাণিক বিষয়কে যেমন এই সমন্বিত আঙ্গিকে রূপায়িত করেছেন, তেমনি সাধারণ জীবনের দৈনন্দিনতাকেও তুলে ধরেছেন। জীবনের ভিতর যে আনন্দের প্রবাহ বহমান, যান্ত্রিকতা সত্ত্বেও, বিপর্যয় সত্ত্বেও সেই আনন্দধারাই তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশের একটি লক্ষ্য।

এই প্রদর্শনীতে ছিল সাদা-কালো ড্রয়িং, বর্ণিল চিত্র ও কয়েকটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। একটি ড্রয়িং-এ শিল্পীত্রিমাত্রিক বিভ্রমের মধ্যে কৌতুকদীপ্তভাবে উপস্থাপিত করেছেন গণপতিকে। বর্ণিল চিত্রগুলিতে আনন্দের বিচ্ছুরণ আরও ব্যাপ্ত ও গভীর। লৌকিক, আদিমতা ও ঘনকবাদী জ্যামিতিকতার সমন্বয়ের দিক থেকেও এই রচনাগুলি অনবদ্য। একটি রচনায় গরুর পিঠে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে একজন গ্রামীণ মানুষ। গরুটির শরীর জ্যামিতিকভাবে বিশ্লিষ্ট। বাঁশিবাদনরত মানুষটিরও। বিষয়টি সম্পূর্ণ লৌকিক। এর সঙ্গে যেভাবে আধুনিকতাবাদী বিশ্লেষণাত্মক অনুষঙ্গকে সমন্বিত করেছেন, তাতেই এসেছে কল্পরূপের অসামান্য নিজস্বতা। আর একটি ছবিতে এক গ্রামীণ মানবীর বাঁ-হাতে উচু করে ধরা একটি লন্ঠন। এভাবেই একের পর এক প্রতিমাকল্প সৃজিত হয়েছে। তানপুরা বাজিয়ে সঙ্গীতে নিমগ্না এক মানবী। ক্ল্যারিওনেট ধরনের বাঁশি হাতে এক লালিমাময় যুবতী। পাশে বসে ধূসরাভ এক পুরুষ। হাতে একটি নীলাভ গোলাপ। ব্রোঞ্জের একটি বড় আয়তনের ভাস্কর্যে বিস্ময়-দৃষ্টি মেলে বসে থাকে এক পুরুষ। হাতের উপর বসে আছে একটি পাখি। ব্যক্তিক একাকীত্বের মধ্যে আকাশের স্বপ্ন জেগে থাকে।

আরও পড়ুন
Advertisement