চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

যেখানে প্রতিভাত গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ

গ্যালারি আপস্টেয়ার্স-এ অনুষ্ঠিত একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষসমাজতন্ত্র অনেকটা ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর গণতন্ত্রকেই রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট এক উপায় বলে গণ্য করেন অনেকে। গণতন্ত্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভ— প্রশাসন, আইন প্রণয়ণ ও বিচারব্যবস্থা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০

সমাজতন্ত্র অনেকটা ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর গণতন্ত্রকেই রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট এক উপায় বলে গণ্য করেন অনেকে। গণতন্ত্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভ— প্রশাসন, আইন প্রণয়ণ ও বিচারব্যবস্থা। জনসাধারণের বৃহত্তম অংশের ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষার নিজস্ব সত্তা বলে কি কিছু আছে? বিচারব্যবস্থাই বা কতটা নিরপেক্ষ? রাজনীতি ও সমাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতায়ন, মৌলবাদ ও দুর্বৃত্তায়নের সম্পর্ক কী? এইসব প্রশ্ন নিয়ে নির্দিষ্ট পরিসর ভিত্তিক ইনস্টলেশন করেছেন মধুজা মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি গ্যালারি আপস্টেয়ার্স-এ অনুষ্ঠিত হয়েছে এই প্রদর্শনী। শিরোনাম: ‘শ্যাডো পাপেটস: ডেমোক্রেসি ল পিপল’।

মধুজা ফিল্ম-স্টাডিজ-এর গবেষক ও শিক্ষক। চলচ্চিত্রের ভিতর সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন, তাঁর গবেষণার বিষয়। এই শিল্পকর্মে তিনি সেটা ব্যবহার করেছেন। ইনস্টলেশন শিল্পচর্চা ও জ্ঞানচর্চার অনেকগুলি বিষয়কে একসঙ্গে মিলিয়ে বহুমাত্রিক উপস্থাপনায় ভাবনাকে তুলে ধরতে পারে। দ্বিমাত্রিক ছবি বা ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটিই মাত্র দৃষ্টিকোণের প্রয়োগ সম্ভব। আজকের সামাজিক জটিলতায় তা জীবনের সব দিককে প্রতিফলিত করতে পারে না। এই অভাবকে কাটিয়ে উঠতেই উত্তর-আধুনিক শিল্প প্রক্রিয়ায় বিকল্প রূপকল্পের সূচনা হয়েছে। ইনস্টলেশন তারই একটি। একটি নির্দিষ্ট স্থানের পরিসরগত বা পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে যে ইনস্টলেশন তৈরি হয়, তাকে বলে সাইট-স্পেসিফিক ইনস্টলেশন।

Advertisement

এই গ্যালারিটি মিড্লটন স্ট্রিটের একটি পুরনো বাড়িতে অবস্থিত। তাতে স্থাপত্যের কিছু ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে গ্যালারির পাশের কক্ষটিতে একজন প্রাক্তন আইনজীবীর অবস্থান ছিল এক সময়। সেখানে দেয়াল জুড়ে সাজানো রয়েছে বহু দিনের নানা মামলার নথিপত্র ও তথ্য। এই বিষয়টি শিল্পীকে আকর্ষণ করে। তাঁর মনে হয় আইনি ব্যবস্থার এই স্তব্ধ প্রতিবেদনপঞ্জিকে প্রেক্ষাপটে রেখে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের আইনি ব্যবস্থার বাস্তবের একটি দৃশ্য-শ্রাব্য প্রতিকল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই এই কাজটির সূচনা। সমগ্র প্রকল্পটি কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। গ্যালারির মূল কক্ষে শিল্পী গণতন্ত্র ও জনসাধারণের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছেন। জনসাধারণকে তিনি প্রতীকায়িত করতে চেয়েছেন তাদের নিরন্তর চলার অনুষঙ্গে। অজস্র জুতোর একত্রীভূত সমাবেশের মধ্য দিয়ে। ভ্যান গঘ যেমন জুতোকেই করে তুলেছিলেন একজন মানুষের গতিসত্তার নির্দেশক, জুতোর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষনের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন মানবিক যন্ত্রণা। সেই দৃষ্টান্তের প্রেরণাতেই শিল্পী এখানে অজস্র জুতোর সমাবেশের প্রতিকল্প গড়েছেন। তার এক প্রান্তে রেখেছেন ঝুলন্ত ও মেঝেতে প্রসারিত সুদীর্ঘ বস্ত্রখণ্ডের উপর অজস্র পদচিহ্ন। কিন্তু এই পুঞ্জীভূত মানব-মানবীর কোনও কণ্ঠস্বর নেই। এই স্তব্ধতার মধ্যেই গণতন্ত্র নানা ক্ষমতাকেন্দ্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশে সন্নিবেশিত হয়েছে বিভিন্ন বিচারপ্রার্থীর কণ্ঠস্বর। বিচারের তথ্যভাণ্ডারের প্রেক্ষাপটে শিল্পী রেখেছেন স্বাধীনতা-উত্তর তিনটি সিনেমা থেকে নেওয়া মানব-মানবীর কণ্ঠস্বর। ‘আন্দাজ’ (১৯৪৫), ‘আওয়ারা’ (১৯৫১), ‘কানুন’ (১৯৬০)। স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী সময়ে এই ফিল্মগুলি গণতন্ত্রের সঙ্গে এবং ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আইনিব্যবস্থার সম্পর্ক তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। এই ফিল্মগুলিরই কিছু নির্দিষ্ট ধ্বনি-প্রক্ষেপনের মধ্য দিয়ে শিল্পী আইনি ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে নির্দেশিত করেছেন। তৃতীয় অংশে গণতন্ত্রের সঙ্গে ক্ষমতায়ন ও দুর্বৃত্তায়নের সম্পর্ক বোঝাতে শিল্পী ফরাসি-বিপ্লবের সময়কালের শিল্প ইতিহাস থেকে তথ্য তুলে এনেছেন। আজকে আমাদের দেশে ও বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা ও ব্লগার হত্যার বাস্তবতাকে স্মরণ করায় এই প্রাক্তন ইতিহাস।

সমস্যা হল এই যে তিনটি স্বতন্ত্র অংশ এই প্রকল্পের, তার ভিতরের সম্পর্ককে স্বচ্ছভাবে নির্দেশিত করা যাবে কেমন করে। সেটা না হলে সাধারণের পক্ষে এর গভীরে প্রবেশ করা কঠিন।

আরও পড়ুন
Advertisement