পুস্তক পরিচয় ১

ভারতীয় চিত্রকলার মানবিক মুখ

ব্রি টিশ মিউজিয়মের অধিকর্তা নিল ম্যাকগ্রেগর কয়েক বছর আগে প্রকাশ করেছিলেন এক অভিনব গ্রন্থ— আ হিস্টরি অব দ্য ওয়ার্লড ইন ১০০ অবজেক্টস— মিউজিয়মের বিশাল সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত একশোটি নিদর্শের মাধ্যমে মানবসভ্যতার অনেক ক’টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস।

Advertisement
গৌতম সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
পাহাড়ি চিত্রকলা: শিল্পী নয়নসুখ। আনু. ১৭৬০। ভারতীয় সংগ্রহশালা, কলকাতা

পাহাড়ি চিত্রকলা: শিল্পী নয়নসুখ। আনু. ১৭৬০। ভারতীয় সংগ্রহশালা, কলকাতা

ব্রি টিশ মিউজিয়মের অধিকর্তা নিল ম্যাকগ্রেগর কয়েক বছর আগে প্রকাশ করেছিলেন এক অভিনব গ্রন্থ— আ হিস্টরি অব দ্য ওয়ার্লড ইন ১০০ অবজেক্টস— মিউজিয়মের বিশাল সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত একশোটি নিদর্শের মাধ্যমে মানবসভ্যতার অনেক ক’টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। বিপুলকায় এই বইটির সময়ক্রম প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রসারিত— আদি মানবের গড়া পাথরের অস্ত্র থেকে আধুনিকতম জীবনযাত্রার উপকরণ— ইতিহাসের পর্বান্তরের বহুবিচিত্র দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপের সচিত্র টীকাভাষ্য, উৎসাহী দর্শক-পাঠকের জন্য স্বচ্ছন্দ গদ্যে লেখা।

বৃজেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রাগাধুনিক ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসের এক সুপরিচিত ভাষ্যকার। নগ্নজিতের চিত্রলক্ষ্মণ সম্পাদনা থেকে, মধ্যযুগের শিল্পীদের পরিচয় নির্ধারণ, মুঘল এবং শিখ চিত্রকলার বিশ্লেষণ, কয়েকটি বিশিষ্ট চিত্রসংগ্রহের ক্যাটালগ লেখা— চিত্রকলার বিস্তীর্ণ পরিসরে তাঁর বহু দশক ব্যাপ্ত স্বচ্ছন্দ বিচরণ। চণ্ডীগড়ের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বছর ধরে পড়িয়েছেন ভারতশিল্পের ইতিহাস। এ ধরনের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে অধ্যাপক গোস্বামী যখন ১০১টি অণুচিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় চিত্রকলার মূল ভাব রসিক পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দিতে প্রয়াসী হন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়ে যায় নিল ম্যাকগ্রেগরের বইটির কথা।

Advertisement

আলোচ্য বইটি, লেখকের নিজের ভাষায়, ১০১টি মহৎ নিদর্শের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ। বর্ণিত কালক্রমের গুরুত্ব পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন— ঐতিহাসিকরা যাকে আদি-মধ্যযুগ বলেন তার শেষ পর্যায় থেকে ঔপনিবেশিক পর্বের সুদৃঢ় ভিত্তিপ্রসার— আট শতকের বর্ণাঢ্য, জটিল, সমস্যাদীর্ণ সময়ের মনমেজাজ ধরা আছে এই ছবিগুলিতে। গ্রন্থকার বেছে নিয়েছেন অণুচিত্র পরম্পরা— নিশ্চিত ভাবে এই আটশো বছরের সবচেয়ে সৃজনশীল পরম্পরা হল অণুচিত্রের নিরবচ্ছিন্ন ধারা। পূর্ব ভারত, পশ্চিম ভারত, সুলতানি, মুঘল, দক্ষিণী, পাহাড়ি, রাজপুত, শিখ— বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন শৈলী। সংশয়ীরা অবশ্য প্রশ্ন করতেই পারেন, এই পর্ব জুড়ে ভিত্তিচিত্রের ধারাও সজীব থেকেছে নানা অঞ্চলে। তাঞ্জোরের ভাস্কর্যধর্মী ভিত্তিচিত্র আজও বৃহদীশ্বর মন্দিরে দেখা যাবে। রাজস্থান-গুজরাতের নানা শহরে গ্রামে ছড়িয়ে আছে ভিত্তিচিত্রের বহুতর নিদর্শন। ভারতীয় চিত্রকলার মূল ভাব অনুসন্ধানে তারা কি অপ্রাসঙ্গিক?

অধ্যাপক গোস্বামী রসিকজনের কথা ভেবে বেছে নিয়েছেন ১০১টি ছবি এবং লিখেছেন তার সুখপাঠ্য ভাষ্য। প্রারম্ভিক আলোচনার শীর্ষ নাম ‘স্তরবিন্যস্ত জগৎ’ (আ লেয়ার্ড ওয়ার্লড)— লেখকের সংগত বিশ্বাস ভারতীয় চিত্রকলার রস আস্বাদনের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করেই রসিক দর্শক সেই পর্যায়ে উপনীত হন, যেখানে রস এবং আনন্দ অভিন্ন। সাহিত্যতত্ত্ব এবং নাট্যশাস্ত্রের পথ ধরে অধ্যাপক গোস্বামী পাঠক/দর্শককে চিত্রের রসের জগতে পৌঁছে দিতে চান। প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে পড়েছে হিন্দি ভক্তি-সাহিত্য, ফার্সি এবং হিন্দুস্তানিতে লেখা সুফি গান এবং দোহা-র কথা। আরও আছে চিত্রকরের ভাবনা, পদ্ধতি এবং আত্মপরিচয়ের কাহিনি, অতীব কৌতূহলোদ্দীপক— হরিদ্বারের পাণ্ডার খাতায় শিল্পীর বিস্তৃত বংশপরিচয়। গোস্বামী মশাই আমাদের শুনিয়েছেন মুঘল সম্রাট এবং সভাসদদের চিত্র-আস্বাদনের কথা। এই সব টুকরো-টাকরা আখ্যান থেকেই ভারতীয় চিত্রকলার মানবিক মুখটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। অধ্যাপক গোস্বামী অণুচিত্র পরম্পরার বিচার বিশ্লেষণে অকুণ্ঠ ভাববাদী। আটশো বছরের অণুচিত্রের বিচিত্র, বর্ণাঢ্য নিদর্শনগুলি নির্বাচিত, আলোচিত এবং মুদ্রিত হয়েছে ঈর্ষণীয় দক্ষতায়। অণুচিত্রে রঙের মায়াবী প্রয়োগ, মৌল রঙগুলির ঔজ্জ্বল্য, অন্যান্য রঙের বহুতর টোন, কালো এবং নীলের অন্তহীন বৈচিত্র, রঙ এবং রেখার সুষম বিন্যাস, মানুষ-প্রকৃতি-জীবজগতের রূপের বিচিত্র উদ্ভাস— সব মিলিয়ে এক নয়নাভিরাম, ক্লান্তিহর জগৎ।

বিষয়বস্তু অনুসারে ১০১টি ছবির বাছাই কঠিন কাজ— গোস্বামী মশাই উদ্ধৃত করেছেন অতি-পরিচিত বাংলা প্রবাদ ‘বাঁশবনে ডোম কানা’। লেখকের অকপট স্বীকৃতি, ছবির নির্বাচন একান্তই ব্যক্তিগত রুচি-নির্ভর, এগুলি মহৎ শিল্পকর্ম এবং তাদের সঙ্গে লেখকের মানসিক সংযোগ অতি নিবিড়। চারটি ঈষৎ অসংবদ্ধ ভাগে ছবিগুলির পরিবেশনা— অন্তর্দৃষ্টি (ভিশন), পর্যবেক্ষণ (অবজার্ভেশন), আততি (প্যাশন), চিন্তন (কনটেমপ্লেশন)। প্রথম ভাগে আছে বিখ্যাত হিরণ্যগর্ভ, অষ্টাদশ শতকের পাহাড়ি শৈলীতে আঁকা সাদা ও ছাই রঙের পটভূমিকায় কালচে সোনালি রঙের ব্রহ্মাণ্ড। এই অংশের বিষয়বস্তু হল সমাজের চেতনায় বিধৃত প্রতীক এবং প্রতিমা। কৃষ্ণ-র গিরিগোবর্ধন ধারণ থেকে হামজার ড্রাগন বিজয় এই অংশে ঠাঁই পেয়েছে। পর্যবেক্ষণ অংশে কল্পনা এবং আদর্শায়িত রূপের সঙ্গে মিশে গেছে পার্থিব রূপ; অনেকগুলি প্রতিকৃতি চিত্র এবং ইতিহাস-নির্ভর বিষয়বস্তু। আততি-র ছবিগুলির অনুপ্রেরণা গীতগোবিন্দ, রসিকপ্রিয়া জাতীয় কাব্য এবং রাগরাগিণীর রূপ ও ভাব। চিন্তন-এর জগৎ নির্জন, শান্ত রসের জগৎ— আত্মস্থ সাধু, ফকির, সুফি সন্ত, দরবেশরা এই জগতের অধিবাসী। সাধারণ পাঠক/দর্শক অবশ্য ঈষৎ ধন্দে পড়বেন— এই চারটি ভাগ কি ছবিগুলিকে বোঝার পক্ষে খুব প্রাসঙ্গিক? অণুচিত্রের বিচিত্র জগৎকে কি এ রকম ছকে ফেলা যায়? বৃহত্তর সমাজ এবং ইতিহাসের জটিল টানাপড়েনকে সরিয়ে রেখে এই কল্পিত ছক ধরে কি ছবির অন্তর্জগতে পৌঁছনো সম্ভব? বইটি এই সব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভারতীয় অণুচিত্রের এই সহস্রাব্দ উদযাপিত হয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত শিল্প পত্রিকা ‘বার্তা’র সাম্প্রতিক সংখ্যায়— সম্পাদনা করেছেন বিশিষ্ট শিল্প-ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অশোককুমার দাস। সংখ্যাটি সব অর্থেই একটি সংগ্রহযোগ্য প্রকাশনা। ছবিগুলি অত্যন্ত যত্নে ছাপা হয়েছে, রঙের সৌকর্য ক্ষুণ্ণ হয়নি, ডিটেলসগুলি নিপুণ ভাবে ধরা পড়েছে। সর্বোপরি, প্রকাশনাটি সুলভ, শিল্প-উৎসাহী পাঠকের ধরাছোঁয়ার মধ্যে। আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত অণুচিত্র পরম্পরার আলোচকদের মধ্যে সম্পাদকই মূল লেখক। এ ছাড়া আছেন তারণকুমার বিশ্বাস, শ্রীধর আন্ধারে, রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়, বন্দনা প্রপন্না প্রমুখ পরিচিত নাম। প্রবন্ধগুলির পরিসর বিশদ আলোচনার পক্ষে যথেষ্ট নয়, তবে সাধারণ উৎসাহী পাঠক/ দর্শকের আগ্রহ উদ্দীপিত করার পক্ষে অত্যন্ত কার্যকর। লেখকদের নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে পাল পর্ব থেকে কোম্পানি আমল— অণুচিত্র পরম্পরার দীর্ঘ পরিক্রমার কাহিনি সুনিপুণ ভাবে পরিবেশিত হয়েছে সুনির্বাচিত, অতি-উৎকৃষ্ট প্রতিলিপির মাধ্যমে। এখানেও সম্পাদকের চিত্র নির্বাচন দক্ষতার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা উচিত। অধ্যাপক গোস্বামীর বইটির মতো এখানেও বহু স্বল্পজ্ঞাত বা প্রায় অজ্ঞাত ছবি মুদ্রিত হয়েছে। যেমন ১২৬-১২৭ পাতা জুড়ে ছাপা বশোলি-গুলের অঞ্চলের জতুগৃহ দহনের ছবি (অষ্টাদশ শতক) অতুলনীয়। আমরা অধ্যাপক দাসের কাছে কৃতজ্ঞ এমন একটি সংকলনের জন্য।

আরও পড়ুন
Advertisement