পুস্তক পরিচয় ২

বিস্মৃত পথিকৃতের রচনাসম্ভার

সমীক্ষণী গ্রন্থমালার অংশ হিসেবে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে চিত্তপট, প্রয়াত মনঃসমীক্ষক তরুণচন্দ্র সিংহের (১৯০৪-’৮৫) নিবন্ধরাজির প্রথম খণ্ড। মাধবেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পাদিত এই গ্রন্থমালার প্রথম প্রকাশনায় রয়েছে তরুণচন্দ্র সিংহের মন ও মনোবিদ্যা বিষয়ক প্রবন্ধসমূহ (প্রথম অধ্যায়), লুম্বিনী পার্ক হাসপাতাল সম্বন্ধে আলোচনা (দ্বিতীয় অধ্যায়), চরিত্র বিচিত্রা (তৃতীয় অধ্যায়) এবং ধৈষণা (চতুর্থ অধ্যায়, নানাবিধ সামাজিক সমস্যা বিষয়ে লেখকের চিন্তাধারা)।

Advertisement
সৌভিক রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ২২:২৭
চিত্তপট: ‘চিত্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ড. তরুণচন্দ্র সিংহ-র নিবন্ধসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড। সমীক্ষণী গ্রন্থমাল

চিত্তপট: ‘চিত্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ড. তরুণচন্দ্র সিংহ-র নিবন্ধসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড। সমীক্ষণী গ্রন্থমাল

সমীক্ষণী গ্রন্থমালার অংশ হিসেবে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে চিত্তপট, প্রয়াত মনঃসমীক্ষক তরুণচন্দ্র সিংহের (১৯০৪-’৮৫) নিবন্ধরাজির প্রথম খণ্ড। মাধবেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পাদিত এই গ্রন্থমালার প্রথম প্রকাশনায় রয়েছে তরুণচন্দ্র সিংহের মন ও মনোবিদ্যা বিষয়ক প্রবন্ধসমূহ (প্রথম অধ্যায়), লুম্বিনী পার্ক হাসপাতাল সম্বন্ধে আলোচনা (দ্বিতীয় অধ্যায়), চরিত্র বিচিত্রা (তৃতীয় অধ্যায়) এবং ধৈষণা (চতুর্থ অধ্যায়, নানাবিধ সামাজিক সমস্যা বিষয়ে লেখকের চিন্তাধারা)। সম্পাদকের নিবেদন, তরুণচন্দ্র সিংহের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি (মনোবিদ অধ্যাপক নীলাঞ্জনা সান্যাল প্রণীত) ও বনানী ঘোষ লিখিত পূর্বকথা রয়েছে মূল লেখাগুলির আগে, একদম গোড়ায়।

মনোরোগ-মনোচিকিৎসা-মনোবিদ্যা এখন অনেকটাই জনমানসে সুপ্রচলিত। কিন্তু ১৯৫৯-এর এপ্রিল মাসে যখন ‘চিত্ত’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা মুদ্রিত হয়, তখন মনোরোগ সম্পর্কে সাধারণের ধারণা ছিল ভাসাভাসা, অনেকটাই অস্বচ্ছ। অন্য যে কোনও শারীরিক রোগের মতো মানসিক পীড়াও যে অনিবার্য, স্বতঃসিদ্ধ— এই বোধ অত্যল্প মানুষজনই উপলব্ধি করতেন। এ জাতীয় রোগ তাই ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবমনে। এই সময়ে তরুণচন্দ্র সিংহের রচনাগুলি তাই দিগ্‌দর্শকের কাজ করেছিল। ‘চিত্ত’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন ‘কলাসৃষ্টি ও মন’ বিষয়ে। সৃজনশীলতা গবেষণা যখন আবিশ্বে প্রাথমিক স্তরে, তাঁর এই বিষয় নির্বাচন আমাদের চমকিত করে। তিনি একে একে লিখেছেন শিশুমনের জি়জ্ঞাসা নিয়ে, শক্তি, মৃত্যুভয়, সুখ-দুঃখ-বাস্তব, মুক্তি প্রসঙ্গেও। তাঁর মাধ্যম সাধুভাষা হলেও তা তরতরে গদ্য, সুখপাঠ্য ও গভীরতা-অন্বেষক। কার্ল গুস্তভ ইয়ুং-কেও তিনি পরিচিত করিয়েছেন বাঙালি পাঠকের কাছে।

Advertisement

দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাঠকের সামনে একাধারে মনোচিকিৎসক ও সংগঠক তরুণচন্দ্র সিংহের উপস্থিতি। লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালের সচিব হিসেবে তিনি মেলে ধরেছেন মানসিক রোগের চিকিৎসালয়ের অন্দরমহলের যাপনচিত্র। এ সম্পর্কে এখনও শিক্ষিত বাঙালি কতটা অবহিত, তা নিয়ে প্রভূত সংশয় আছে। ভারতীয় উন্মাদ আইন, দুরারোগ্য ব্যাধির সংকট মোচন, রজতজয়ন্তী বর্ষের অভিজ্ঞতা, সাহায্য ভিক্ষা ও সমস্যাবলি— কোনও কিছুই গোপন করেননি তিনি। তৃতীয় অধ্যায় ‘চরিত্র বিচিত্রা’-য় রয়েছে আত্মজীবনীর উপাদান— নানা বর্ণের, নানা বৈশিষ্ট্যের মানুষজনের কথা এখানে যে ভাবে ছবির মতো পরিস্ফুটিত হয়েছে যে, আক্ষেপ হয়, কেন তরুণচন্দ্র সিংহ আত্মকথা-রচনায় ব্রতী হলেন না। খাঁটি সাহিত্যরসে সিঞ্চিত এই লেখাগুলি আমাদের আবেগ-মনন দুইয়েরই গভীরে প্রবেশ করে। ‘ধৈষণা’ পর্বে আবার পাওয়া যায় এক চিন্তাবিদ, সমসাময়িক ঘটনার আবর্তে বিচলিত সমাজসচেতন দায়িত্ববান ব্যক্তিমানসকে। মনস্তাত্ত্বিককে যে পৃথিবীর সব খুঁটিনাটি আন্দোলনের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে, এই অধ্যায়ে তার যথেষ্ট নিদর্শন মেলে।

সমীক্ষণী সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে মন (চেতন, অচেতন, অবচেতন) সম্বন্ধে উৎসাহী বাঙালি পাঠক ঋদ্ধ ও ঋণী হয়ে রইলেন এই সংকলনের জন্যে। আপন আবাসকে যিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্যে (‘সমীক্ষণী’), সেই পুরোধা মানুষটির বৈচিত্রময় লেখনীর দ্বিতীয় খণ্ডের জন্যে এই আলোচক-সহ সব পাঠকই উন্মুখ থাকবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement