ব্যাখ্যার সঙ্গে সমালোচনাও জরুরি ছিল

চল্লিশ বছর আগে এক নিঃসঙ্গ পুরুষ তার কাঠিন্যের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এক মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের সঙ্গে দাম্পত্য তৈরি করেছিল, বাঁচার শেষ দিনগুলি যদি তার আনন্দে কাটে, সেই সদিচ্ছায়।

Advertisement
শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০০

চল্লিশ বছর আগে এক নিঃসঙ্গ পুরুষ তার কাঠিন্যের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এক মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের সঙ্গে দাম্পত্য তৈরি করেছিল, বাঁচার শেষ দিনগুলি যদি তার আনন্দে কাটে, সেই সদিচ্ছায়। বাইরে থেকে পুরুষটিকে অসামাজিক বা আত্মকেন্দ্রিক বলে ঠাহর হত, সে-ও নিজেকে ‘দুষ্ট্‌ রাক্ষস’ বলে চিহ্নিত করত, কিন্তু কোমল একটি হৃদয় ছিল তার। সে হৃদয়ের স্পর্শ পেয়েই মেয়েটি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও নতুন করে বাঁচার তাগিদ ফিরে পেয়েছিল।

বাস্তবে কতটা ঘটে জানি না, তবে সিনেমায় এমন হয়, বিশেষত হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে। উল্লেখিত ছবিটি ‘মিলি’ (১৯৭৫), তবে এটি উদাহরণ মাত্র, তাঁর প্রায় সব ছবিতেই ‘আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে’-র মতো বিষয় ঘুরেফিরে আসে। আর আসে মানুষ কতটা ভাল হতে পারে, সে ধারণাটাও। ব্যক্তিগত জীবনে হৃষীকেশ এমন বিশ্বাসের বশবর্তী ছিলেন কিনা বলা মুশকিল, তবে একের পর এক ছবিতে তেমন বিশ্বাসের জগৎই বুনে গিয়েছেন তিনি।

Advertisement

তাঁকে নিয়ে, বরং বলা ভাল, তাঁর ছবি নিয়ে যে নতুন বইটি রচনা করেছেন জয় অর্জুন সিংহ, তার একটি অধ্যায়ের নামই ‘অ্যান অ্যাবসেন্স অব ব্যাড মেন’। সত্যপ্রিয়— তাঁর ‘সত্যকাম’ (১৯৬৯) ছবির মূল চরিত্র, সৎ মূল্যবোধের মানুষ, কী ভাবে আদ্যোপান্ত ছেয়ে থাকত হৃষীকেশের মন, সেই আদর্শই যে তাঁর ছবি তৈরির মনোভূমি হয়ে উঠেছিল, আলোচনা করেছেন অর্জুন। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত আর তার কোনও নাগরিককে এ ভাবেই নিজের ছবিতে প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসতেন পরিচালক, মনে হয়েছে লেখকের। আপাত ভাবে যাকে খারাপ বলে মনে হয়, তার ভিতরেও আসলে একটি ভালমানুষের বসবাস, হৃষীকেশের ছবিগুলিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলে এই প্রতিপাদ্যটিই বড় হয়ে ওঠে। বা আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, খারাপ মানুষের অনুপস্থিতিটাই একটু যেন প্রকট হয়ে ওঠে।

কলকাতায় যে আড্ডা হৃষীকেশকে পরিচালক হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছিল, সেই আড্ডায় থাকতেন মৃণাল সেন-ও। আমৃত্যু হৃষীকেশ বন্ধুও ছিলেন তাঁর, পঞ্চাশের দশকের মধ্যপর্বে মাত্র দু’-বছরের ব্যবধানে দুজনের পরিচালক-জীবনের শুরু। কিন্তু আয়নার সামনে মধ্যবিত্ত চরিত্রগুলিকে চুল ধরে টেনে এনে তাদের ভিতরকার ‘ছোট আমি’-টাকে বেআব্রু করে দিতেন মৃণাল সেন। এ ভাবে মধ্যবিত্তকে দেখা একেবারেই পছন্দের ছিল না হৃষীকেশের। অতি-পছন্দের পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও সত্যজিতের ‘জনঅরণ্য’ (১৯৭৫) ভাল লাগেনি তাঁর। অভিযোগ করেছিলেন: মধ্যবিত্তের ‘প্রকৃত’ মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করতে পারেননি সত্যজিৎ। ‘জনঅরণ্য’-এ সোমনাথের মতো মধ্যবিত্ত তরুণ প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে, কিন্তু স্বপ্নেও কখনও বন্ধুর বোনকে ‘ভেট’ দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না!

একঘেয়ে জীবনীর বদলে অর্জুন এ ভাবে হৃষীকেশের নানা ভাবনার এত অনুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন, তাঁর পরিচালক-জীবন আর তাঁর ছবিগুলির তন্নিষ্ঠ পাঠ থেকে সারাংশ-সহ পঞ্জি অবধি এমন ভাবে তৈরি করে দিয়েছেন যে, নতুন করে ফিরে দেখার দরজা খুলে দেয় বইটি। তবে লেখক ব্যাখ্যাতেই ক্ষান্ত রেখেছেন নিজেকে, সমালোচক হয়ে উঠতে চাননি।

হালফিল প্রজন্মের ভারতীয় পরিচালকদের চেনার জন্যে এমনই আরেকটি দরকারি বই ডিরেক্টরস ডায়রিজ। রাকেশ আনন্দ বক্‌শি, হিন্দি ছবির বিশিষ্ট গীতিকার আনন্দ বক্‌শির পুত্র, তাঁর নির্বাচিত বেশ কিছু ছবি-করিয়ে আর তাঁদের প্রথম ছবি নিয়ে সাক্ষাৎকারের একটি সংগ্রহ তৈরি করেছেন। প্রতিটি সাক্ষাৎকারের শুরুতে সেই পরিচালকের জীবনপঞ্জি ও ফিল্মপঞ্জি পেশ করেছেন লেখক। তারপর শুরু হয়েছে কথাবার্তা।

ফিল্ম একান্ত ভাবে যে পরিচালকের মাধ্যম— এই বাক্যটিকে শিরোধার্য মেনে, কী ভাবে প্রথম ছবি করার সময় হাজার ঝামেলা আর যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিল প্রত্যেক পরিচালককে, অথচ ‘দে লাভড দেয়ার জার্নি থ্রু এভরি ফিল্ম’, সেটা নিজের লেখনীতে তুলে এনেছেন রাকেশ।

অনুরাগ বসু, আশুতোষ গোয়ারিকার, ইমতিয়াজ আলি, তিগমাংশু ধুলিয়া, বিশাল ভরদ্বাজ, বা জোয়া আখতারের মতো নবীন প্রজন্ম এবং তাঁদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের গোবিন্দ নিহালানি, মহেশ ভট্ট, প্রকাশ ঝা, বা সন্তোষ শিভনের মতো পরিচালকের ছবি করার প্রেরণা, পশ্চাদভূমি, রীতিনীতি, ধরন-ধারণ সবিস্তারে জানতে পারা যায় এ বইতে। অনুপস্থিত যেটি, সেটি হল, এই সমস্ত পরিচালকের মননভূমি।

দ্য ওয়ার্ল্ড অব হৃষীকেশ মুখার্জি/
দ্য ফিল্মমেকার এভরিওয়ান লাভস,
জয় অর্জুন সিংহ। পেঙ্গুইন/ ভাইকিং, ৫৯৯.০০
ডিরেক্টরস ডায়রিজ/ দ্য রোড টু দেয়ার ফার্স্ট ফিল্ম, রাকেশ আনন্দ বক্‌শি।
হার্পার কলিন্স, ৩৫০.০০

আরও পড়ুন
Advertisement