পুস্তক পরিচয় ১

বাঙালির মানসিকতা কি আদৌ পাল্টাল

উনিশ শতকের শেষ থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে নারীর আদর্শ আচরণ, স্ত্রীশিক্ষা, মেয়েদের কর্তব্য এবং কিঞ্চিৎ হলেও, অধিকার বিষয়ে ভদ্রলোকরা ভেবেছিলেন বিস্তর, যার ছাপ রয়ে গিয়েছিল তাঁদের লেখাপত্রে।

Advertisement
অপরাজিতা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
প্রবাসীতে নারী। সংকলন ও সম্পাদনা: ভারতী রায়। আনন্দ, ৬০০.০০

প্রবাসীতে নারী। সংকলন ও সম্পাদনা: ভারতী রায়। আনন্দ, ৬০০.০০

উনিশ শতকের শেষ থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে নারীর আদর্শ আচরণ, স্ত্রীশিক্ষা, মেয়েদের কর্তব্য এবং কিঞ্চিৎ হলেও, অধিকার বিষয়ে ভদ্রলোকরা ভেবেছিলেন বিস্তর, যার ছাপ রয়ে গিয়েছিল তাঁদের লেখাপত্রে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক, যাঁর সমাজসংস্কারের তাগিদ থেকে ‘দাসী’ এবং পরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সূত্রপাত। ‘প্রবাসী’-র মাধ্যমে শুধু ভাষা-ই নয়, সামাজিক শুদ্ধি এবং সংস্কৃত ও মার্জিত পাঠরুচি গড়ে তোলার কাজে রামানন্দ আজীবন যুক্ত ছিলেন। সভাপতি ছিলেন ‘সুনীতি সঙ্ঘ’-এরও, যার লক্ষ্যই ছিল ‘অসৎ সাহিত্য’ ও ‘মনের বৈকল্য’ উদ্রেককারী অভিনয় বন্ধ করা। এই দায়বদ্ধতা থেকেই রামানন্দ গিরিশচন্দ্রের নাটক দেখেননি এবং হয়তো সেই কারণেই, রামানন্দের সম্পাদনার চার দশকে ‘প্রবাসী’-তে লেখার ‘সৌভাগ্য’ শরৎচন্দ্রের কখনও হয়নি। পাঠকদের সুস্থ রুচি গড়ে তোলার প্রতি এই তন্নিষ্ঠ দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখেই সংকলনটির আলোচনা করতে হবে।

বৃহৎকলেবর বইটি ‘প্রবাসী’-র জন্মলগ্ন ১৯০১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত শতাধিক প্রবন্ধের সংকলন, যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘শুধুমাত্র পুরুষরচিত নারী-ভাবনা সংক্রান্ত প্রবন্ধাবলী এবং নারী লিখিত যাবতীয় প্রবন্ধ’। লেখাগুলির উপস্থাপনা বিষয়ভিত্তিক না হওয়ার দরুন গবেষকের পক্ষে এত বিচিত্র বিষয় থেকে কয়েকটি সাধারণ থিম চিহ্নিত করা দুরূহ। দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর ধরে সম্পাদকের নিজের মানসিকতা একই রকম থেকে গিয়েছিল কি? রামানন্দের কন্যা শান্তা দেবী জানিয়েছেন, ‘প্রবাসীতে কোন আদর্শের লেখা বাহির হইবে... এ বিষয়ে তাঁহার (রামানন্দের) বাঁধা নিয়ম ছিল’ (৫৩৯)। সংকলনের প্রথম প্রবন্ধেই (অবিনাশচন্দ্র দাস, ‘গৃহ’) বলা হয়েছে নারীর ‘পরাধীনতা’ তার জয়, কেননা, সে ‘সংসারের রাজ্ঞীর পদে প্রতিষ্ঠিত’। অতএব ‘মানবজাতির জননী’ হিসেবে এই ‘পদগৌরব ও শক্তি’ হৃদয়ঙ্গম করে নারীর কর্তব্য স্বকর্তব্যসাধনে অগ্রসর হওয়া। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় নারীর জন্য এই দেবীত্বের ছকে রামানন্দের সম্পূর্ণ সায় ছিল। সম্পাদকীয় ছাড়াও তিনি এই পত্রিকায় স্বনামেও অনেক বার কলম ধরেছেন। যেমন ‘মাতৃত্বের কার্য্যক্ষেত্র’ নামক প্রবন্ধে পরিবারই যে নারীর সর্বপ্রধান বিচরণক্ষেত্র, তা তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, আলোচনা করেছিলেন নারীর হৃদয় ও শক্তিকে মাতৃত্বে জাগরিত করার কথাও। পরিতাপের বিষয়, সংকলনে এত জন পুরুষের লেখা সংকলিত হলেও স্থান সংকুলান হয়নি রামানন্দের নিজের একটি রচনারও। তাই, ‘প্রবাসী’ সম্পাদকের নারীভাবনার বিষয় সরাসরি জানার কোনও উপায় এখানে নেই।

Advertisement

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত প্রবাসী বাংলার জনপ্রিয়তম পত্রিকা। কিন্তু বিশ-তিরিশের দশকে বাঙালি পাঠকের রুচিবোধের উপর এই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল নিশ্চয়ই, যখন অন্যতর জীবনদর্শন ও সাংস্কৃতিক রুচিকে ভর করে জন্ম নেয় আরও অসংখ্য পত্রিকা। এই প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে ‘প্রবাসী’তেও যুক্ত হয় ‘মা লক্ষ্মীদের’ মনোরঞ্জনের জন্য বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে সর্বদা এই পত্রিকার অগ্রগণ্য ভূমিকা তো ছিলই, এমনকী স্বাবলম্বনের জন্য নারীর উপার্জনের ক্ষেত্রের উন্মোচনের প্রস্তাবকেও সমর্থন দেওয়া হয়েছিল সেখানে, আর ১৯২১ সালের পর থেকে নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলনকেও। এ সবের পিছনে ছিল কি বিপণনের কোনও কূটকৌশল? এ সম্পর্কে দু-চার কথা থাকলে সংকলনের ভূমিকাটি আরও উপভোগ্য হত।

নারীর ‘নারীত্ব’ কোনও ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কোনও কাজ কদাপি সমর্থন করেননি রামানন্দ। লক্ষণীয় যে, ‘দাসী’ পত্রিকার ক্ষেত্রে তিনি যদিও বা নিম্নবর্গের মেয়েদের কথা ভেবেছেন, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর ‘উন্নতি’র প্রকল্প শুধু উচ্চকোটির শিক্ষিত মেয়েদের জন্য নিবেদিত। কিন্তু, বস্তুত ভূমিকায় ‘দাসী’-র উল্লেখমাত্র নেই। অসামান্যা নারীর রূপকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে ‘প্রবাসী’-তে সযত্নে বাদ পড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ বা বারবনিতাবৃত্তি-দমনের মতো বিষয়, যেগুলি কিন্তু নিতান্ত অবহেলার ছিল না, বরং বিশের দশক থেকেই গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল ভারতীয় নারী-আন্দোলনের আলোচনা ও বিতর্কে। এই সময় থেকেই নারী স্বাধীনতার সপক্ষে বা নারীর সম্পর্কে ছাঁচে-ঢালা স্টিরিওটাইপিং-এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠতে থাকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ‘প্রবাসী’ যে বিতর্ক থেকে শত হস্ত দূরে ছিল। সোচ্চার নারীবাদী চিন্তা দূরে থাক, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের অনুমোদিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রেও যে ধরনের প্রকাশ্য মিটিং-মিছিলে বা গোপন বিপ্লবাত্মক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লে ‘ধৃত ও কারারুদ্ধ হইবার সম্ভাবনা আছে’ সেগুলি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মেয়েদের পরামর্শ দেয় এই পত্রিকা। আশ্চর্য এই যে, সংকলন-সম্পাদক ‘প্রবাসী’র এই নীরবতার বিষয়ে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন।

ভারতী রায় যথার্থই মন্তব্য করেছেন, স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে ‘প্রবাসী’-র ভূমিকা ছিল সবচেয়ে জোরালো। ঠিকই, কিন্তু ভূমিকায় যদি আর একটু সবিস্তার স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কিত বিবিধ বিতর্কের মূল্যায়ন করার চেষ্টা হত, তা হলে নারীদের উপযোগী শিক্ষা ও পাঠ্যবস্তুর বিষয়টি খানিক বিশদ ভাবে ভাবা যেত। একশো বছরের বিস্তৃত জাতীয়তাবাদী চিন্তায় পুরুষ বা নারী, কেউই প্রায় ভাবেননি যে, নারীদের শিক্ষায় পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট ধাঁচটিকেই অনুসরণ করা উচিত, বরং সহমত পোষণ করেছেন যে, নারীদের কর্তব্য এবং কর্মক্ষেত্র পুরুষদের থেকে আলাদা, ঠিক যেমন আলাদা তাঁদের ‘প্রকৃতি’ বা ‘স্বভাব’। ‘প্রবাসী’-র ক্ষেত্রে এই অভিমতের ধারাবাহিকতা অবশ্যই একটু বেশিই দৃশ্যমান। তবে ব্যতিক্রম একেবারে নেই, তা নয়। সম্পাদক-কন্যা শান্তাদেবী অনেক বেশি চলতি হাওয়ার পন্থী, ‘নারীসমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি এই স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রণালীর বাঁধা ছকটির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। স্বয়ং রামানন্দও প্রশ্ন তুলেছিলেন (১৩২৪): ‘স্ত্রীলোকেরা... পাচিকার কাজ করিলে তাহাতে আপত্তি হয় না, কিন্তু শিক্ষা পাইয়া বেশি রোজগার করিলেই অমনি নানা আপত্তি হয়, ইহা বড় অদ্ভুত ব্যাপার’। কিন্তু স্বয়ং সম্পাদক মশাইয়ের এই প্রবন্ধটি ভূমিকায় উল্লিখিত হয়েছে, মূল সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়নি, এটা আশ্চর্যের বইকী।

সংকলনের কিছু প্রবন্ধ থেকে বিশ শতকের গোড়ার নগরজীবনেও লোকায়ত ও কৌম সংস্কৃতির অনুরণন দেখতে পাই। আবার পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষিতে অনুরূপা দেবীর মতো কট্টর সনাতনপন্থীও সাবিত্রী ব্রতকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করেন। উঠে আসে নারী সমবায়, দেশবিদেশের উদাহরণযোগ্য নারীদের দৃষ্টান্ত। বাহুবল আর শরীরচর্চার প্রতি বাঙালির যে ঝোঁক বাড়ছিল, তারই পথ ধরে ‘প্রবাসী’-তে ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যচর্চা নিয়েও বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। চল্লিশের দশকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে যে ‘জনৈকা বাঙালি গৃহিণী’-র কলম মারফত এই পত্রিকায় ঢুকে পড়তে থাকে আয় ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য, রেশনিং ইত্যাকার নতুন বাস্তববিধির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ এক নব্য গার্হস্থ্যের কথা, তিনি ছিলেন জ্যোতির্ময়ী দেবীর কন্যা, সমাজকর্মী অশোকা গুপ্ত, যদিও সংকলনের ভূমিকায় তার কোনও উল্লেখ নেই। মেয়েদের ভোটাধিকারের সমর্থনে বা হিন্দু নারী ও প্রস্তাবিত হিন্দু উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অতি-প্রাসঙ্গিক কিছু লেখা জায়গা করে নেয় এই পত্রিকায়। কিন্তু দেখে আশ্চর্য লাগে যে, সমাজে পালাবদলের এই প্রবল হাওয়ার মাঝেও চল্লিশের দশকে এক দল লেখক অসীম অধ্যবসায়ে লিখে চলেছেন নারীর গোত্রান্তর, বৈদিক সংস্কারে নারী, অথবা উপনয়নে নারীর অধিকার নিয়ে গুরুগম্ভীর সব প্রবন্ধ— যা থেকে ধাঁধা লাগে, অর্ধশতাব্দী ধরে বাঙালির মানসিকতা কি তা হলে আদৌ পাল্টাল? আশ্চর্য লাগে যখন স্বাধীনতার জন্মলগ্নে পৌঁছেও দাঙ্গা, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে কোনও প্রবন্ধ চোখে পড়ে না। যে পত্রিকার লেখক-পাঠককুল মেয়েদের শিক্ষা, অধিকার, কর্মজগৎ নিয়ে এত সোচ্চার, তাঁরা চল্লিশের দশকে এই বহুধাবিস্তৃত সমস্যা নিয়ে প্রায় কোনও কথাই খরচ করলেন না! এই প্রশ্নটি ভূমিকায় আলোচিত হয়নি।

সব শেষে আরেকটি কথা। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, অবহেলিত নিম্নজাতির উন্নয়ন এবং সর্বোপরি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বার বার আলোচিত হয়েছে ‘প্রবাসী’-তে। এই রচনাগুলির সঠিক প্রেক্ষিতটি খুঁজে পাওয়ার জন্য অতীব জরুরি হিন্দু মহাসভার আবির্ভাব ও প্রসারের ইতিহাসের সঙ্গে এই ঝোঁকটিকে মিলিয়ে দেখা। মহাসভার সাধারণ কর্মসূচি ও লক্ষ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন বলেই রামানন্দ মহাসভার সুরাট অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এবং এর পরেও বহু বার বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে যোগ দেন। বিশ শতকের বহু ভদ্রলোকের মতো রামানন্দের বক্তব্যেও বার বার প্রতিধ্বনিত হয় হিন্দুদের ‘ক্রমক্ষীয়মাণ জনসংখ্যা’ বিষয়ে এক গভীর উদ্বেগ। মেয়েদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তাঁর কাছে যতটা জরুরি ছিল, ততটাই ছিল হিন্দু মেয়েরা যাতে ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্মের জনস্ফীতি না ঘটায়, তা সুনিশ্চিত করা। নারীর সুরক্ষা সম্পর্কে ‘প্রবাসী’-র ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ যে সময়ে মুখর, ঠিক সেই সময়েই হিন্দু নারীর ‘মর্যাদারক্ষা’র জন্য হিন্দু মহাসভাও অতি সক্রিয়, এ নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয়। বস্তুত, কলকাতার অ্যালবার্ট হলে মহাসভা-আহূত ‘হিন্দু নারীর নিগ্রহ সম্পর্কে হিন্দুদের সভা’-য় সভাপতিত্বও করেছিলেন রামানন্দ। সুতরাং, ইতিহাসের বৃহত্তর আখ্যানের বিবিধ পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ‘প্রবাসী’-র প্রবন্ধাবলিকে মিলিয়ে পড়তে পারলে ঔপনিবেশিক বাংলার শেষ অর্ধশতাব্দীর নারী-ভাবনাকে আরও বড় ক্যানভাসে হয়তো ধরা যেত। সংকলনটি সে কাজ অংশত সমাধা করেছে বটে, কিন্তু সব প্রশ্নের হদিশ দেয়নি। আরও প্রত্যাশা তাই থেকেই গেল।

আরও পড়ুন
Advertisement