চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

প্রদর্শিত সম্ভারে ফুটে ওঠে জীবনের আলেখ্য

সিমা-য় অনুষ্ঠিত ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষপ্রতি বছরের মতো এ বছরও শারদোৎসবের আগে সিমা গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী মূলত কারুশিল্পেরই প্রদর্শনী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১

কারুশিল্প ও চারুশিল্পের মধ্যে সাধারণ ভাবে যে বিভাজন করা হয় – তা হল, কারুশিল্পের সঙ্গে প্রয়োজনের একটা যোগ থাকে, আর চারুশিল্প প্রয়োজনাতীত। তা সত্ত্বেও দুইয়ের মধ্যে পরোক্ষ একটা ঐক্যও আছে। বস্তুকে দৃষ্টিনন্দন ‘রূপ’-এ উদ্ভাসিত করে তুলতে চায় দুজনেই। ‘রূপ’-এর ভিতর দিয়ে রূপাতীত কোনও অনুভবকে স্পন্দিত করতে চায়। এই রূপাতীত অনুভবের ভিতরই সৌন্দর্যের সারাৎসার লুকিয়ে থাকে। সেই সৌন্দর্য এক দিকে যেমন শিল্পীর চৈতন্যের প্রতিফলন, তেমনি দর্শকও নিজের মতো করে তার দেখা শিল্পবস্তু থেকে সৌন্দর্যের স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব এক অভিজ্ঞান তৈরি করে। এবং দৃশ্যকলার ভিতর সেই অভিজ্ঞান আরোপ করে। তাই অনেক সময়ই বলা হয়ে থাকে সৌন্দর্য শিল্পী ও দর্শক উভয়েরই সমবেত নির্মাণ। তবে কারুশিল্প যে সৌন্দর্যের উন্মীলন ঘটিয়ে আসছে মানবসভ্যতার আদি যুগ থেকে, আজকের উত্তর-আধুনিকোত্তর যুগেও সেই সন্ধানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য অপ্রয়োজনীয় হয়নি। মানুষ যে রূপের ভিতর দিয়ে রূপাতীতকে চায় তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ মানুষের কারুশিল্প।

Advertisement

প্রতি বছরের মতো এ বছরও শারদোৎসবের আগে সিমা গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী মূলত কারুশিল্পেরই প্রদর্শনী। তবু কারুতার ভিতর থেকে কেমন করে চারুতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং কারুকৃতিও কেমন করে ললিতশিল্প হয়ে ওঠে, তারও অসামান্য নিদর্শন ছড়িয়ে থাকে এই প্রদর্শনীতে।

এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক দৃষ্টান্ত, প্রায় একশ বছর আগের, বিংশ শতকের প্রথম দিকের পারস্যের একটি ‘ওয়াল-হ্যাঙ্গিং’। সুতোর বুননে গড়ে তোলা কার্পেট-সদৃশ এই ঝুলন্ত শিল্পবস্তুটি নিঃসন্দেহে কারুকৃতির উজ্জ্বল নিদর্শন। কারুতার চারুতায় উত্তরণের এটি একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। সুতোর বুননে এর ভিতর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা রকম বিমূর্ত ডিজাইন। তারই সঙ্গে এসেছে জীবনের নানা আলেখ্য। যাপনের নানাবিধ উদযাপন, যা পারস্যশিল্পে প্রবাহিত হয়ে এসেছে সুদূর অতীত থেকে। এর ভিতর যখন আমরা গতিচঞ্চল একটি কালো ড্রাগনের উপস্থিতি দেখি, তখন বোঝা যায় চিন কেমন করে পারস্যে প্রবেশ করেছে। শিল্পকলায় এভাবেই বসুধা একীকৃত হয়ে যায়। এর পাশেই ঝোলানো রয়েছে রাজস্থানের থর-মরুভূমির সাপুড়ে শ্রেণির উপজাতীয় মানুষের তাঁতে বোনা একটি কাঁথা। এর ভিতরের যে কারুকৃতি, তার সঙ্গে যদি বাংলার নকশি কাঁথার সুললিত অলঙ্করণের তুলনা করি, তাহলে দেখব দেশের দুই প্রান্তের লৌকিক চেতনা রূপের দুটি আলাদা অভিজ্ঞান উৎসারিত করে, যার ভিতর দিয়ে এই দুই অঞ্চলের জীবন ও প্রকৃতির ভিন্নতাকেও চিনে নিতে পারি। এভাবে জীবনকে চিনিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কারুশিল্পের অবদান চারুশিল্পের থেকে কিছু মাত্র কম নয়।

প্রতি বছরের মতো এ বছরও দর্শককে মুগ্ধ করেছে ডোকরা ভাস্কর্যের নিদর্শনগুলি। বাস্তার এবং বাংলার উপজাতীয় শিল্পীদের কাজে পার্থক্যের মধ্যেও রূপের সরলীকরণে যে মিল দেখা যায়, সেটা আদিম মানুষের নান্দনিক দর্শনের ঐক্যের জায়গা। যা সারা বিশ্বেই প্রায় এক। তবু অঞ্চল ভেদে অভিব্যক্তি প্রকাশের ধরন পাল্টে যায়। এই সরলীকরণ ও ভাঙন আধুনিকতাবাদী শিল্প অর্জন করেছে আদিমতার কাছ থেকে। বাস্তারের একটি ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে স্থূলকায় একটি ষাঁড় বসে আছে। গলায় ঘণ্টা। পিঠের উপর বসে আছে চার হাত বিশিষ্ট শিব। শরীরটি দীর্ঘায়ত। কিন্তু পা দুটি হ্রস্ব। অনুপাতকে ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়েই রূপের ভিতর অরূপের ইঙ্গিত আসে।

চারুকলার চারপাশে এই প্রদর্শনীতে ছড়ানো থাকে আজকের কারুকলার বিপুল-তরঙ্গ। শাড়ির ক্ষেত্রে দক্ষিণ-ভারতের উপর একটু বেশি আলো ফেলার চেষ্টা হয়েছে এ বার। তামিলনাড়ুর চেট্টিনাদ সুতির শাড়ির বৈচিত্রময় সম্ভার রয়েছে, যাকে বস্ত্র-শিল্পের এক স্বতন্ত্র ঘরানা বলে চিনে নেওয়া যায়। দেশের প্রায় সব অঞ্চলের শাড়ির পাশাপাশি রয়েছে নারী ও পুরুষের অঙ্গবস্ত্রের বিচিত্র সম্ভার এবং ঘর সাজাবার অফুরন্ত উপকরণ।

আরও পড়ুন
Advertisement