চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

নিয়ম ভেঙেই তমসার অভিমুখ সন্ধানে শিল্পী

সম্প্রতি এক্সপেরিমেন্টার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষরেখা চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু কেবল রেখা দিয়েই কি ভাস্কর্য করা সম্ভব? কেননা গাণিতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী রেখার কেবল দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ থাকার কথা নয়। তাহলে ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিকতায় রেখা কীভাবে রূপায়িত হবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১

রেখা চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু কেবল রেখা দিয়েই কি ভাস্কর্য করা সম্ভব? কেননা গাণিতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী রেখার কেবল দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ থাকার কথা নয়। তাহলে ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিকতায় রেখা কীভাবে রূপায়িত হবে? এরকম একটি আপাত অসম্ভব প্রয়াসই আমরা দেখি এক্সপেরিমেন্টার আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে। প্রায় বারো ফুট দৈর্ঘ্যের বা তার বেশিও হতে পারে, একটি রেখা সর্পিল গতিতে আলুলায়িত হতে হতে শূন্যের উপর বিস্তৃত হয়ে আছে। এই রেখা লাল বর্ণের। একটি তেপায়ার উপর স্থাপিত। তারপর গ্যালারিকক্ষের ভিতর অনেকটা কোনাকুনি তীর্যক ভাবে প্রসারিত। জ্যামিতিক সংজ্ঞায় একে অবশ্য রেখা বলা সমীচীন নয়। কেননা এর আয়তন রয়েছে। বৃত্তাকার প্রস্থচ্ছেদ মাঝামাঝি অবস্থানে সবচেয়ে ঘনত্বময়। তারপর দুপাশে সরু হতে হতে বিন্দুতে মিলিয়ে গেছে। একটি দীর্ঘ দণ্ডের যতই ঘনত্ব থাক, তার দৈর্ঘ্য যদি বাড়ানো যায়, তাহলে তার ঋজুতা কমে আসে। সরু রেখার মতো সে নমনীয় হয়ে যায়। তার গতিকে প্রয়োজন মতো সর্পিল করে তোলা যায়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই শিল্পী রেখাকে ভাস্কর্যে রূপায়িত করেছেন। এই লাল রেখার পরিপূরক বা একই সঙ্গে ‘কাউন্টার পয়েন্ট’ হিসেবে এরকম একটি কালোর রেখার ভাস্কর্যও সংস্থাপিত হয়েছে একটু দূরে। সেটি স্থাপিত হয়েছে বহুভূজ-ইনস্টলেশন, যার শিরোনাম ‘আণ্ডার দ্য স্কিন ১ এবং ২’।

Advertisement

গ্যালারিতে প্রবেশ পথের একটু ভিতরে আয়তাকার দুই তলের একটি খাদ আছে। প্রদর্শবস্তুর বিন্যাসে সেটাকে নানা ভাবে কাজে লাগানো হয়। তারপর কক্ষটি দেয়ালের বিন্যাসে তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এই তিনটি অংশ সংযুক্ত হয়েও পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন। এই সংযুক্তি ও বিচ্ছিন্নতা প্রদর্শবস্তুর বিন্যাসে নানা রকম নান্দনিক আবহ সৃষ্টি করে।

এই প্রদর্শনীতে লাল রঙের প্রথম ভাস্কর্য-ইনস্টলেশনটি ওই খাদের মধ্যে অবস্থিত থেকে কৌনিক ভাবে দুপাশে ছড়িয়ে গেছে।

আর কৃষ্ণ-বর্ণের রচনাটি দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে সংস্থাপিত। এই বিপ্রতীপ বর্ণের দুটি রেখার ভাস্কর্য পারস্পরিক সংযোগে ও বিচ্ছিন্নতায় একটি অসংজ্ঞায়িত রহস্যময় পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। যাকে দর্শক নিজের মতো করে যে কোনও অর্থে অর্থান্বিত করে নিতে পারেন। এই রচনা দুটি ছাড়া প্রদর্শনীতে চার-পাঁচটি দেয়ালে আরও বেশ কিছু বিমূর্ত চিত্র এবং একটি ছোট ইনস্টলেশনও রয়েছে।

শিল্পীর নাম জুলিয়েন সেগার্ড। জন্ম ফ্রান্সে ১৯৮০ সালে। প্যারিসে তিনি শিল্পকলায় স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিয়েছেন।

তাঁর আলোচ্য এই এককটির শিরোনাম ‘এনিহোয়ার বাট হিয়ার’। উত্তর-আধুনিকতা উত্তর বিশ্বের সম্ভবত এটাই একটা বৈশিষ্ট্য যে বিশ্বগত বিস্তারকে ব্যক্তিগত পরিসরে একাত্ম করে নেওয়া যায়। শিল্পী সেই চেষ্টাই করেছেন। এই প্রদর্শনীর একটি রচনারও শিরোনাম ‘এনিহোয়ার বাট হিয়ার’।

লিনেনের উপর চারকোলে আঁকা এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে চতুর্ভুজাকার চিত্রতল। কিন্তু এই চতুর্ভুজের একটি কোণ সমকোণ হলেও বাকি তিনটি কোণ স্থূল ও সূক্ষ্ম কোণ।

এই তীর্যক চিত্রক্ষেত্রটি ঋজুরেখার বিস্তারে কালো ও বাদামি দুটি সমতল বর্ণক্রমে বিন্যস্ত। ফ্রেমের গতানুগতিক নিয়মানুবর্তিতাকে ভেঙে শিল্পী যেন তমসার অভিমুখ সন্ধান করতে চেয়েছেন, যে তমসা আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র যেমন পরিব্যাপ্ত, তেমনি আত্মতার ভিতরেও।

প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে সেগার্ড-এর এই শিল্পপ্রয়াসকে ১৯৬০-এর দশকের ইতালীয় ‘আর্ট পোভেরা’ আন্দোলনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বলা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে জেনোয়ায় জারমানো কেলাল্ট নামে এক তরুণ শিল্পবেত্তার পরিকল্পিত একটি প্রদর্শনীতে এই আন্দলনের সূচনা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল পরিচিত পপ-আর্টের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প শিল্পরীতির উদ্ভাবন, যেখানে শিল্পসৃষ্টিতে যন্ত্রে তৈরি উপাদানের থেকে প্রাকৃতিক ও জৈব-উদ্ভাবিত বস্তুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। আজকে জীবনেরও কোনও ঐতিহ্য-সীমায়িত নির্দিষ্টতা নেই।

এই অপরিচিতির ভিতর থেকেই শিল্পী আত্মপরিচয়ের নির্মাণের প্রয়াস করেছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement