পুস্তক পরিচয় ২

নাম অঙ্গাঙ্গি হলেও প্রকৃতি আলাদা

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্বাসনস্থল হিসেবে কুখ্যাত, এ কালে পর্যটকদের প্রিয় জায়গা আন্দামান-নিকোবর। মায়ানমার থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত প্রায় আটশো কিলোমিটার বিস্তৃত একটি পর্বতের দৃশ্যমান অংশই হল এই দ্বীপপুঞ্জ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্বাসনস্থল হিসেবে কুখ্যাত, এ কালে পর্যটকদের প্রিয় জায়গা আন্দামান-নিকোবর। মায়ানমার থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত প্রায় আটশো কিলোমিটার বিস্তৃত একটি পর্বতের দৃশ্যমান অংশই হল এই দ্বীপপুঞ্জ। ২৪০টি দ্বীপ আর সঙ্গে কিছু মাথা উঁচু পাথর, মোট ৫৭২টি ভূখণ্ড নিয়ে আন্দামান-নিকোবরের অবস্থান। দুটো নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হয় বটে কিন্তু দুটি দ্বীপ প্রাকৃতিক ভাবে একেবারেই আলাদা ‘টেন ডিগ্রি চ্যানেল’ নামে একটি জলরেখা দিয়ে। চারশো ফ্যাদম গভীর এই অস্থির সমুদ্রাঞ্চলটি নব্বই মাইল বিস্তৃত একটি প্রাকৃতিক বিভেদরেখা। ফলে এই দুটি অঞ্চলের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্রও একেবারে আলাদা। আন্দামানে যেমন রয়েছে মায়ানমারের প্রভাব, নিকোবর তেমনই জাভা-সুমাত্রার প্রভাবযুক্ত। অষ্টাদশ শতকের পর ব্রিটিশ আধিপত্য এই অঞ্চলকে পরিচিত করে তুলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। যে কারণে এখানকার অঞ্চল নামেও সেই প্রভাব এখনও রয়েছে। কয়েকটি জনজাতির অবস্থান রয়েছে এই দুই ভূখণ্ডে। আন্দামানে যেমন নেগ্রিটো, নিকোবরে তেমনই মঙ্গোলয়েড। আর রয়েছে আন্দামানি, সেন্টিনেল, ওঙ্গি, শোম্পেন এবং তথাকথিত সভ্য সমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন নেগ্রিটো জারোয়ারা। ব্রিটিশদের ভয় এবং অনুসন্ধিৎসা প্রবল ছিল এই শেষোক্তদের ঘিরে। মেজর মোয়াট ১৮৫৮-য় এঁদেরই একজনকে খাঁচায় পুরে প্লুটো নামক জাহাজে চাপিয়ে এনেছিলেন খাস কলকাতায়। ‘জ্যাক আন্দামান’ নামে অভিহিত সেই হতভাগ্যকে সেদিন দেখতে এসেছিলেন সস্ত্রীক লর্ড ক্যানিংও। ব্রিটিশ প্রভাব শেষ হলে এখানে মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক মানুষ আসতে থাকেন। ততদিনে বেশ কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী ওখানে সাজিয়ে নিয়েছেন নিজেদের সংসার। ফলে আন্দামান কালক্রমে হয়ে উঠেছে এক মিশ্র সংস্কৃতির কেন্দ্র। বহুবিধ লোককাহিিন সম্পৃক্ত করেছে এই ভূখণ্ডকে। নিরক্ষরেখার কোল ঘেঁষে এই বৃষ্টিধৌত ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে গাছগাছালির বাড়বাড়ন্তই স্থানীয় মানুষজনের একমাত্র অর্থনৈতিক অবলম্বন। সেলুলার জেল তৈরির সময় নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছিল এখানকার প্রবাল প্রাচীর। ২০০৪-এর সুনামিতে বিধস্ত হয় এই ভূখণ্ড, কিন্তু আবার তা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৯ সালে এখানে সরকারি ডাক্তার হিসেবে এসেছিলেন তিলকরঞ্জন বেরা। দৈনন্দিন কাজের রুটিনে আটকে থাকেননি তিনি, বরং কলম আর ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের সন্ধানে। তারই ফসল সম্প্রতি দুই মলাটে প্রকাশ পেল আন্দামান আইল্যান্ডস/ ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এবং নিকোবর আইল্যান্ডস/ ইন নেচার’স কিংডম (নিয়োগী বুকস, ১৭৫০.০০ এবং ১৯৯৫.০০) শিরোনামের দুটি বইতে। লেখক এবং আলোকচিত্রী— এই দুই ভূমিকাতেই সফল তিনি। এই দুই ভূখণ্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং ভৌগোলিক নানাবিধ বিষয় তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে তুলে ধরেছেন। সুনামির পরে পরেই তিনি আবার ফিরে গিয়েছেন সেই সব অঞ্চলে। ফলে লেখকের চোখে ধরা পড়েছে একই অঞ্চলের দুই রূপ। তবে, এই দুটি বইতে স্থানীয় জনজাতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশি। এখানকার অন্য শ্রেণির মানুষদের সংস্কৃতির কথা আরও একটু স্থান পেলে বইটি সম্পূর্ণতা পেত। আন্দামানের পতঙ্গ, প্রজাপতি বা পাখিদের কথা আরও একটু বিস্তারের দাবি রাখে। আন্দামানের বইটির প্রচ্ছদে পাখিটিকে জোর করে না ঢোকালেই ভাল হত, সমুদ্রের ঢেউতে তো পাখির ছায়া দেখা যাওয়ার কথা নয়! এই সামান্য বিষয় বাদে লেখকের এই কাজ পর্যটক, ইতিহাস অনুসন্ধানী এবং সাধারণ পাঠক— সকলের কাছেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

রাজস্থানে সারিস্কা জাতীয় উদ্যানের ফিল্ড ডিরেক্টর (১৯৯১-৯৬, ২০০৮-১০) হিসেবে সুনয়ন শর্মা বাঘকে দেখেছেন অত্যন্ত নিবিড় ভাবে। সারিস্কা এমন একটি অরণ্য যাকে ঘিরে রয়েছে প্রায় ৩০০টি জনপদ। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়েছে ১৩ এবং ২৯এ— দুটি স্টেট হাইওয়ে। জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ মন্দির, যেখানে সারা বছর বহু ভক্তের সমাগম ঘটে। এই জঙ্গলে এক সময় চোরাশিকারিদের জন্য বাঘ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রোজেক্ট টাইগার-এর দৌলতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে, কিছু জনপদ অন্যত্র স্থানান্তরিত করে, হাইওয়েতে যান নিয়ন্ত্রণ করে এবং জঙ্গলের ভেতরের নিরাপত্তা বাড়িয়ে বা মিষ্টি জলের জোগান ও খাদ্যশৃঙ্খল সঠিক করে সারিস্কা এখন ফিরে এসেছে তার পুরনো গৌরবের জায়গায়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জঙ্গলের ভেতরের পাথর খাদান। সুনয়নবাবু এই কর্মকাণ্ডের শরিক ছিলেন, ফলে তাঁর চোখে ধরা পড়েছে এই জঙ্গলের এক অন্তরঙ্গ চিত্র। সেটাই তিনি বিবৃত করেছেন সারিস্কা: দ্য টাইগার রিজার্ভ রোরস এগেইন (নিয়োগী বুকস, ৬৫০.০০) শীর্ষক বইটিতে। অসাধারণ ছবি সহযোগে বইটি পড়তে পড়তে এক রকম মানস ভ্রমণও হয়ে যায়। এখানকার গাছপালা, স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পাখিদের বিজ্ঞানসম্মত এবং স্থানীয় নাম সহযোগে পরিশেষে যে তালিকা সংযুক্ত হয়েছে তা মূল্যবান। ভারতের সমস্ত অরণ্য নিয়ে এই ধরনের বই দরকার।

Advertisement
আরও পড়ুন
Advertisement