নীতির প্রশ্নে তিনি মুখ খোলেননি

গ্রিন সিগনাল্স: ইকোলজি, গ্রোথ, অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি ইন ইন্ডিয়া, জয়রাম রমেশ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৮৫০.০০ ভা রতে পরিবেশ-আইন, সেগুলির প্রয়োগে সাফল্য ও সমস্যা, পরিবেশ সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলা প্রভৃতির আলোচনা ও বিবরণ দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু এক জন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীর জবানিতে তাঁর আমলের পরিবেশ-প্রশাসনের আখ্যান আগে পাওয়া যায়নি।

Advertisement
শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০০

ভা রতে পরিবেশ-আইন, সেগুলির প্রয়োগে সাফল্য ও সমস্যা, পরিবেশ সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলা প্রভৃতির আলোচনা ও বিবরণ দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু এক জন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীর জবানিতে তাঁর আমলের পরিবেশ-প্রশাসনের আখ্যান আগে পাওয়া যায়নি। তাই জয়রাম রমেশের আলোচ্য গ্রন্থটি একটি বিশেষ প্রাপ্তি।

জয়রাম জানিয়েছেন, তিনি প্রথমে এক জন পরিবেশ-সংশয়ী (এনভায়রো-অ্যাগনস্টিক) ছিলেন। কিন্তু দায়িত্বপালনের প্রক্রিয়ায় (২০০৯-১১) তাঁর সংশয় পরিবর্তিত হয় প্রত্যয়ে। ক্রমশ তাঁর কাজকর্মকে চালিত করতে থাকে কট্টর উন্নয়নপন্থা ও পরিবেশ সংরক্ষণের তাগিদ, এই দুই মনোজগতের মধ্যে সেতুবন্ধনের চেষ্টা।

Advertisement

জয়রাম লিখেছেন: যখনই কোনও একটি প্রস্তাবিত প্রকল্পের সঙ্গে পরিবেশের বিরোধের বিষয়টি সামনে আসে, তখন তিনটি অবস্থান তৈরি হয়— ‘হ্যাঁ’, ‘না’ এবং ‘হ্যাঁ, কিন্তু’। প্রথমটি প্রকল্পটির পক্ষে, দ্বিতীয়টি (পরিবেশবাদী অবস্থান থেকে) প্রকল্পের বিরুদ্ধে। এই দু’টিই সাধারণত সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়। অথচ, যে প্রকল্পগুলি সরকারি অনুমোদন পায়, সেগুলি সবই তৃতীয়, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ, কিন্তু’ বর্গে পড়ে। অর্থাৎ, প্রকল্প অনুমোদন পায় অনেকগুলি শর্তসাপেক্ষে— যে শর্তগুলিকে প্রকল্পটি চালু হওয়ার আগে এবং চালু থাকাকালীন মেনে চলতে হবে। এখানে বিচার্য ‘কিন্তু’ অংশটি, অর্থাৎ শর্তের চরিত্র এবং শর্ত মানা কতটা বাধ্যতামূলক হল। জয়রামের দাবি, তাঁর আমলে শর্তগুলিকে নৈর্ব্যক্তিক, পরিমাপযোগ্য, ন্যায্য ও বাস্তবসম্মত এবং সেগুলি মেনে চলা বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা হয়। অবশ্য, অল্প কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সপাটে ‘না’ বলা জরুরি। সে ক্ষেত্রে, যেখানে সব পক্ষের বক্তব্য বিচারের পর ‘না’ বলা হচ্ছে, সেখানে ‘না’-কে হতে হবে অমোঘ।

জয়রামের বেশ কিছু কথা পরিবেশকর্মীদের পছন্দ হবে। যেমন, প্রকল্পগুলির জনশুনানির নামে হামেশা যে প্রহসন হয়ে থাকে, জয়রাম তার নিন্দা করেছেন এবং মুক্তকণ্ঠে সাচ্চা জনশুনানির পক্ষে সওয়াল করেছেন। অভিযোগ করেছেন, পরিবেশ আইন লঙ্ঘিত হয় প্রতিনিয়ত, অসংখ্য ক্ষেত্রে। আরও বলেছেন, এই লঙ্ঘনের সমস্যাটি যতটা পরিবেশ সংরক্ষণের সমস্যা, ততটাই দেশের সাধারণ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা।

পরিবেশ সমস্যা সমাধানে জয়রামের প্রধান দাওয়াই সুবিবেচিত পরিবেশ-বিধির প্রণয়ন এবং (নিষ্ঠা সহকারে) পালন। মুশকিল হল, শুধু পরিবেশ-বিধির যথাযথ প্রয়োগ বা আরও কিছু কড়া আইন প্রণয়ন করে পরিবেশ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যেমন, পরিবহণের ক্ষেত্রে। ধরুন, ইঞ্জিন ও জ্বালানি সংক্রান্ত বিধিগুলি বলবৎ হল। পুরনো গাড়ি রাস্তা থেকে সরল, পরিবর্তিত জ্বালানি ও ইঞ্জিন ব্যবহৃত হল, অটো, ট্যাক্সি, বাস প্রভৃতি সিএনজি এলপিজি-তে চলল। যেখানে নিয়ম পালিত হল, দূষণ কমল। কিন্তু তার পর? দেখা গেল, বছর কয়েক পর পরিবহণজনিত দূষণ ফের বা়ড়তির পথে। কারণ, গাড়ি-পিছু দূষণ কমলেও গাড়ির সংখ্যা হই-হই করে বাড়ায় মোট দূষণ বাড়ছে। মজা হল, গাড়ি-পিছু দূষণ কমানোর পদ্ধতির একটি দিক হল ইঞ্জিনকে জ্বালানি-দহনে আরও দক্ষ করা। এতে জ্বালানির সদ্ব্যবহার হয়, খরচ কমে, ফলে গাড়ির ব্যবহার বাড়ে এবং আখেরে অর্থনীতিতে মোট জ্বালানির ব্যবহার বাড়ে। তাই তিলে কমলেই তালে কমে না, বরং কোনও ক্ষেত্রে তিলে কমার জন্যই তালে বাড়তে পারে— যে অর্থনীতিবিদ এটি প্রথম লক্ষ করেন, তাঁর নামেই এর নাম ‘জেভন্‌স প্যারাডক্স’। এর মানে এই নয় যে, মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার ও দূষণ কমানোর কথা ভাবব না। আলবত ভাবব। কিন্তু এই ভাবনা যথেষ্ট নয়। সর্বমোট নিয়ে ভাবতে হবে।

পরিবহণের ক্ষেত্রে কাম্য— গণপরিবহণের উন্নতি ও দূষণকারী যানের পরিকল্পিত হ্রাস। লোকে যত বেশি হারে গণপরিবহণ ব্যবহার করবে, মানুষ-পিছু জ্বালানির ও মোট জ্বালানির ব্যবহার দুই-ই কমবে। কমবে দূষণ (অবশ্য গণপরিবহণের ক্ষেত্রেও যথাযথ প্রযুক্তির মাধ্যমে যান-পিছু দূষণ কমানোর চেষ্টা চালাতে হবে)। এর সঙ্গে রয়েছে সাইকেলের মতো দূষণহীন যানের উপর জোর দেওয়া। আর এখানেই আমরা আইন থেকে নীতি ও পরিকল্পনার দিকে চলে আসি। এই বিষয়ে জয়রাম প্রধানত নীরব। বস্তুত, পরিবহণের প্রশ্নটি তাঁর বিশাল গ্রন্থে প্রায় অনুপস্থিত; অথচ আজকে, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে, প্রশ্নটি দারুণ জরুরি।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য হিসেব করার কথা বলেছেন জয়রাম। লিখেছেন, কী ভাবে তিনি এই জন্য ন্যাশনাল গ্রিন অ্যাকাউন্টিং নিয়ে উদ্যোগী হন। কিন্তু উৎপাদন ও অর্থনীতির সাধারণ প্রবণতা কী হবে? চাষি, ব্যবসাদার, শিল্পপতি, পরিবহণ দফতর, অর্থনীতিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা— কেউ পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের তোয়াক্কা করবেন না (সে দায় শুধু পরিবেশ-প্রশাসন, পরিবেশবিদ ও পরিবেশ কর্মীর); চাষের পদ্ধতি এমন হবে যে ভূগর্ভের জল ভয়ংকর ভাবে কমবে, ফ্লোরাইড ও আর্সেনিকের মাত্রা বাড়বে, মাটি হারাবে তার স্বাভাবিক প্রাণরস আর খাদ্যে ঢুকবে বিষ; শিল্পীয় উৎপাদনে ব্যবহৃত বস্তু ও কারিগরি এমন হবে যে উৎপাদিত দ্রব্য তার জীবনচক্রের শেষে বিপজ্জনক বর্জ্যে পরিণত হবে; ভোগের আদর্শ ও কাঠামো এমন হবে যে ধরিত্রীর পক্ষে তার ভার বহন করা কঠিন হবে। এই অবস্থায়, অর্থনীতি-ভাবনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে না এনে, ভাল আইন ও প্রাজ্ঞ প্রশাসন দিয়ে সমস্যার সুরাহা কতদূর হবে? জয়রাম এই মৌলিক প্রশ্নের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেননি। হয়তো বর্তমান ব্যবস্থায় যিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন, তাঁর ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক।

তবে, নজর কাড়ে গ্রন্থের নবম অধ্যায়, ‘এনার্জি ডিলেমাস’। এতে জয়রাম নবীকরণযোগ্য স্বল্প-কার্বন শক্তির পক্ষে সওয়াল করেছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা তাঁর চিঠি এবং ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা আরও দু’টি চিঠি উল্লেখ্য। তাতে তিনি ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (এ ই আর বি)-কে একটি স্বাধীন নজরদারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের উপর যথার্থ তদারকির পক্ষে বলেছেন। এই চিঠিগুলি কিন্তু চোখে পড়ে প্রধানত অন্য কারণে। এখানে লেখক বক্তব্য পেশ করছেন অতি সন্তর্পণে— তিনি জানেন অনেকগুলি প্রভাবশালী প্রাণীর লেজে পা দিচ্ছেন। আর এক জায়গায় জয়রাম বলেছেন, পরমাণু শক্তি পরিবেশ মন্ত্রকের এক্তিয়ারের বাইরে (দেশের আইন পরমাণু প্রযুক্তিজনিত দূষণের মূল ক্ষেত্র, অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়তাকে পরিবেশ-প্রশাসনের আওতায় না রেখে এ ই আর বি-র এক্তিয়ারে রেখেছে)। তবে পরিবেশ সংক্রান্ত অন্য বিষয়ে পরমাণু চুল্লিকে পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পেতে হয়। জয়িতাপুরে প্রস্তাবিত ৬টি পরমাণু চুল্লি সংবলিত ‘নিউক্লিয়ার পার্ক’-কে জয়রাম সেই ছাড়পত্র দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর অনুলিপি বইয়ে রয়েছে। নির্দেশটি জয়রামের ভাষায় ‘স্পিকিং অর্ডার’, অর্থাৎ নির্দেশের মধ্যেই তার কারণগুলি বিশদে উল্লিখিত। প্রকল্পটি ছাড় পায় অনেক শর্তসাপেক্ষে। নির্দেশটি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে, কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই।

জয়রাম রমেশ সক্রিয় প্রশাসক ছিলেন। বিটি-বেগুন, কোস্টাল রেগুলেশন জোন এবং ন্যাশনাল গ্রিন মিশন নিয়ে ‘পাবলিক কনসালটেশন’-এর মাধ্যমে তিনি জনমত জানার চেষ্টা করেন। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল চালু করেন। তটাঞ্চলীয় পরিবেশ-বিধি ভঙ্গকারী ‘আদর্শ হাউসিং’-এর বাড়ি ভাঙার নির্দেশ দেন। এ সবের বিস্তারিত বিবরণ বইয়ে আছে। এর অধিকাংশই জরুরি নথির সংকলন। যেমন পরিবেশমন্ত্রীর বিভিন্ন নির্দেশ, সংসদে পরিবেশ-প্রশাসনের নানা প্রশ্নে বাদানুবাদ, পরিবেশমন্ত্রী কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় সচিব এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে লেখা অজস্র চিঠি প্রভৃতি। এত জরুরি নথি দুই মলাটে পেতে অনেকেই আগ্রহী হবেন। নথিগুলির একটি সূচি থাকলে খুব সুবিধা হত। নির্ঘণ্টটি অবশ্য, সামান্য ভুল সত্ত্বেও, বেশ কাজের।

আরও পড়ুন
Advertisement