চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...

ধ্রুপদী বোধকে তুলে ধরেছেন জ্যামিতিক বিন্যাসে

মায়া আর্ট স্পেস-এ অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষকলকাতার নতুন আর্ট গ্যালারি ‘মায়া আর্ট স্পেস’-এর প্রথম বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হল সম্মেলক প্রদর্শনী। ২৫ জন চিত্রী ও ভাস্করের কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘স্পেস উইদিন স্পেস’। একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ পরিসরের ভিতর কল্পনার নতুন এক পরিসর গড়ে তোলা এর ভিতরই পরিব্যাপ্ত হয় চিত্রের শিল্পিত ভুবন। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে শিল্পীর কল্পবিশ্বের বুনন চলে সেখানে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৪ ০০:৩০
শিল্পী: বিমল কুণ্ডু

শিল্পী: বিমল কুণ্ডু

কলকাতার নতুন আর্ট গ্যালারি ‘মায়া আর্ট স্পেস’-এর প্রথম বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হল সম্মেলক প্রদর্শনী। ২৫ জন চিত্রী ও ভাস্করের কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘স্পেস উইদিন স্পেস’। একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ পরিসরের ভিতর কল্পনার নতুন এক পরিসর গড়ে তোলা এর ভিতরই পরিব্যাপ্ত হয় চিত্রের শিল্পিত ভুবন। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে শিল্পীর কল্পবিশ্বের বুনন চলে সেখানে। সেই বুনন বহুমাত্রিক। তার হয়ে ওঠার বা সম্ভাবনার শেষ নেই কোনও। সেই সম্ভাবনা নতুন নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হতে থাকে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।

আলোচ্য প্রদর্শনীটি যে খুব সুপরিকল্পিত, তা নয়। ছবি বা ভাস্কর্যের নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট ভাবনা বা কনসেপ্ট-এর দায়বদ্ধতা ছিল না। প্রবীণ বা নবীন যাঁদের কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী, তাঁরা প্রায় সকলেই প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে এই সময়ের সামাজিক ও নান্দনিক পরিস্থিতির কিছু আভাস উঠে আসে। এই সময়ের অন্তর্লীন পরিসরের কিছু আভাস পাই আমরা। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিচিত রূপবন্ধের পুনরাবৃত্তি প্রদর্শনীর সামগ্রিক পরিসরকে একটু সংকুচিত করেছে।

Advertisement

প্রদর্শনীতে ভাস্কর ছিলেন পাঁচ জন। নিরঞ্জন প্রধানের ব্রোঞ্জ ‘ফলেন হর্স’ ও ‘লেডি উইথ বার্ড’ তাঁর পরিচিত আঙ্গিকের রচনা। ঘোড়ার আর্ত চিৎকারের মূর্তিটি জীবনের যন্ত্রণার প্রতীক। বিমল কুণ্ডুর ব্রোঞ্জ ‘দেবী’ ও ‘মেডিটেশন’ জ্যামিতিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী বোধকে ধরার প্রয়াস। গোপীনাথ রায়ের ব্রাসের রচনা ‘শি’ মানবীর বিষণ্ণ মগ্নতাকে রূপবদ্ধ করেছে। যদিও তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের দৃষ্টান্ত নয় এটি। গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে দুই তরুণ ভাস্করের। দেবাশিস দাসের সিরামিকস ‘ট্রু লাভ’ আঙ্গিকের নতুন নিরীক্ষায় উজ্জ্বল। ভঙ্গুর বিশ্বগোলকে মিশরীয় আঙ্গিকে অনুপ্রবিষ্ট করিয়েছেন মানব-মানবীর প্রেমের প্রতিমা। তাপস বিশ্বাস সরু তার জুড়ে জুড়ে পুরোনো গ্রামোফোনের প্রতীকী একটি চোঙ্ তৈরি করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘মাই সুইট মেমোরিজ’। বিকল্প রূপকল্পের চিন্তাদীপ্ত দৃষ্টান্ত তাঁর রচনাটি।

ছবিতে ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন দু’জন: গণেশ হালুই ও যোগেন চৌধুরী । গণেশ হালুই-এর ওয়াশ মাধ্যমের অনামা ছবিটি ২০১০ সালে আঁকা। এই বিমূর্তায়িত নিসর্গ তাঁর পরিচিত রূপকল্পেরই পুনরাবৃত্তি। যোগেন চৌধুরীর পাঁচটি ড্রয়িংধর্মী কাজ ছিল কালি-কলম এবং কালি ও প্যাস্টেলে আঁকা। ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী পার্থপ্রতিম দেবের দু’টি কাজের মধ্যে মিশ্রমাধ্যমের ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ শীর্ষক মিশ্রমাধ্যমের রচনাটি কৌতুক ও করুণার সম্মিলনে সামাজিক দায়বোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুভাপ্রসন্নের ২০০৮-এ আঁকা মিশ্রমাধ্যমের ‘বিড়াল’-এর রূপায়ণটির সন্দিগ্ধ লোভাতুর দৃষ্টির মধ্যেও গভীরতর এক সমাজবাস্তবতার তাৎপর্য প্রচ্ছন্ন থাকে।

১০৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে আদিত্য বসাকের টেম্পারা ও অ্যাক্রিলিকে আঁকা ‘গোল্ডেন টাইম’ শীর্ষক ক্যানভাসটিতে কলকাতা শহরের অতীত ও সাম্প্রতিক দু’টি কালপর্বের বিশ্লেষণাত্মক বিন্যাস ঘটেছে। সমীর আইচের অ্যাক্রিলিকে আঁকা বিড়ালের হিংস্রতার অভিব্যক্তি সামাজিক সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে ওঠে। মনোজ দত্তের টেম্পারায় আঁকা ফুলদানির সামনে ময়ূর ও কচুপাতার তলায় হাঁসের ডিম পাড়ার প্রতিমাকল্পমূলক রূপায়ণ দু’টি সাম্প্রতিক ছবিতে ঐতিহ্যগত আত্মপরিচয় সন্ধানের অসামান্য দৃষ্টান্ত। সুব্রত চৌধুরীর অনামা অ্যাক্রিলিকের রচনাটিতে এক পাশে রয়েছে শহরের বহুতল অট্টালিকা ও ঝুপড়ির বাস্তবতার সংঘাত, অন্য পাশে ‘ম্যানিকিন’ সদৃশ কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত এক মানবী প্রতিমা। প্রদীপ মৈত্রের নিসর্গরচনাটি তাঁর প্রজ্ঞাদীপ্ত দক্ষতার দৃষ্টান্ত।

সনাতন দিন্দা এঁকেছেন ভঙ্গুর এক নগ্নিকা যার কাঁধের উপর একটি রঙিন প্রজাপতির অবস্থান। অতনু ভট্টাচার্যের ‘সাবকনশাস রেড’ অভিব্যক্তিমূলক বিমূর্ততার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের ‘দ্য ক্লাউড’ ঘন মেঘের অন্ধকারে বিপন্ন নির্জন একটি প্রাণীর একলা দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। গভীরতর প্রতীকী তাৎপর্যে উজ্জ্বল। প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে এঁকেছেন একটি মুখ। শিরোনাম‘উইশ’ বা ইচ্ছা। এ ছাড়াও প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন অতীন বসাক, দেবনাথ বিশ্বাস, সন্দীপ রায়, সায়ক মিত্র ও সৌরভ জানা।

আরও পড়ুন
Advertisement