পুস্তক পরিচয় ১

দারোগার বয়ানে ভাল ডাকাতের কথা নেই

ব ছর তিরিশেক আগেও মফস্‌সলের কিশোর-কিশোরীরা ইস্কুলের গরমের ছুটির অলস দুপুরে চোর-পুলিশ নামে একটি কাগুজে খেলা খেলত। চারখানি কাগজে লেখা থাকত দারোগা, পুলিশ, ডাকাত, চোর। কাগজগুলি সমান ভাঁজ করে লুডোর ছক্কা ফেলার মতো একজন ফেলত।

Advertisement
বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
সেকালের গোয়েন্দা কাহিনি। সম্পা. অরিন্দম দাশগুপ্ত। আনন্দ, ৫০০.০০

সেকালের গোয়েন্দা কাহিনি। সম্পা. অরিন্দম দাশগুপ্ত। আনন্দ, ৫০০.০০

ব ছর তিরিশেক আগেও মফস্‌সলের কিশোর-কিশোরীরা ইস্কুলের গরমের ছুটির অলস দুপুরে চোর-পুলিশ নামে একটি কাগুজে খেলা খেলত। চারখানি কাগজে লেখা থাকত দারোগা, পুলিশ, ডাকাত, চোর। কাগজগুলি সমান ভাঁজ করে লুডোর ছক্কা ফেলার মতো একজন ফেলত। চার খেলুড়ে তুলে নিত চারখানি কাগজ, দারোগা আর পুলিশ সগর্বে আত্মপরিচয় দিত। বাকি দুজন চুপ। দারোগা বাঙালির হিন্দিতে আদেশ করত পুলিশকে ‘চোর কো পাকড়াও’ কিম্বা ‘ডাকাত কো লে আও।’ বাকি দুজনের কে ডাকাত কে চোর ‘অনুমান’ করে বেচারি পুলিশ সেই মতো তাদের চিহ্নিত করত। ঠিক হলে পুলিশের জিত, ভুল হলে হার। তার ওপর নির্ভর করত কে কত পয়েন্ট পাবে। পরের দানেই ভূমিকা যেত বদলে— চোর হয়তো হল পুলিশ, ডাকাত দারোগা। অলস দুপুর কেটে যেত ভূমিকা বদলের ভাগ্য-দোলায়। কে উঠছে, কে পড়ছে!

চোর চতুর্দশী, সেকালের দারোগার কাহিনী, সেকালের গোয়েন্দা কাহিনি এই বই তিনটি ছেলেবেলার সেই কাগুজে খেলার কথা মনে করিয়ে দিল। কেন ? সে কথা পরে। চোর আর গোয়েন্দা সংক্রান্ত বইদুটি একদিক থেকে সমগোত্রীয়। দুটিই নানা রচনার সংকলন। সেকালের দারোগার কাহিনী নিতান্ত গল্পকথা নয়। গিরিশচন্দ্র বসু ১৮৫৩-’৬০ নবদ্বীপ-শান্তিপুর-কৃষ্ণনগর অঞ্চলে পুলিশের দারোগা ছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এ লেখায়। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দারোগার দপ্তর যেমন বহুক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ বিবরণ, গিরিশচন্দ্রের কাহিনী-ও তেমন। প্রিয়নাথ অবশ্য গিরিশচন্দ্রের পরবর্তী, ১৮৭৮-এ পুলিশে যোগ দিয়ে তিনি অবসর নেন ১৯১১-এ। প্রসঙ্গত বাঁকাউল্লার দপ্তর বইটির কথাও মনে পড়বে। মোদ্দা কথা হল ঔপনিবেশিকতার শর্ত ও স্বার্থ মেনে যে আধুনিক ‘ক্রাইম’ দমনের ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল তাতে হিন্দু-মুসলমান বাঙালি সরকারি দমনব্যবস্থার পক্ষে চাকরি নিচ্ছিলেন। সেই চাকরিলব্ধ অভিজ্ঞতার ভালমন্দ প্রকাশ করছিলেন ইংরেজি-বাংলা লেখায়। সে-সব লেখা উনিশ শতকে গড়ে ওঠা বাঙালি পাঠককুলের মনোরঞ্জন করছিল। বঙ্কিমী কৃষ্ণকান্তের উইল-এর ক্রাইমকাহিনি, বা রাজসিংহ উপন্যাসের ডাকাত মাণিকলালের চাইতে এসব অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তববৃত্তান্তের চাহিদা কিছু কম ছিল না।

Advertisement

ঔপনিবেশিক পর্বে যখন আধুনিক পুলিশি আর ডিটেকটিভ পুলিশি ব্যবস্থা পোক্ত হচ্ছিল তখনই বাংলা গদ্য সাহিত্যে কাল্পনিক ‘ডিটেকটিভ’দের ক্রমবিস্তার। এর অর্থ এই নয় ডিটেকটিভদের প্রাগাধুনিক কোনও ভারতীয় অথবা বঙ্গীয় রূপ ছিল না। ক্রাইম কাহিনির কালক্রান্তি-র লেখক সুকুমার সেনের গল্পের গোয়েন্দার নাম তো কালিদাস, কালটিও রাজা বিক্রমাদিত্যের। ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর রসিক পাঠক মাত্রেই জানেন সেই কোটালের কথা। মেয়ে বিদ্যার বিবাহপূর্ব গর্ভসঞ্চারের সংবাদে রাজার মাথায় হাত। ‘হারামজাদা’ ‘গোবরগণেশ’ কোটালের প্রাণ যায় আর কী! শেষে ‘কূটবুদ্ধি’ কোটাল জাসুসি করে ‘পালঙ্ক ঠেলিতে’ বিদ্যার শয়নকক্ষের মধ্যে দেখতে পেল সুন্দরের আসা যাওয়ার সুড়ঙ্গ। গোপন যৌনলীলা তো ক্রাইমকাহিনির অন্যতম উপাদান– নানা রকম গুপ্তকথার বাজার আছে। সেকালের গোয়েন্দা কাহিনি-র সম্পাদক অরিন্দম দাশগুপ্ত তাঁর সুলিখিত ভূমিকায় উনিশ-বিশ শতকের গোয়েন্দা কাহিনির পাঠকরম্যতার ইতিবৃত্তটি

সতথ্য তুলে ধরেছেন। তাঁর সংকলনে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, শরচ্চন্দ্র সরকার, দীনেন্দ্রকুমার রায়, ক্ষেত্রমোহন ঘোষ, পাঁচকড়ি দে ও ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রচনা সংকলিত। প্রত্যেকেরই পাঠকপ্রিয়তা ছিল। এর মধ্যে পাঁচকড়ি দে পাঠকপ্রিয়তা বজায় রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সে কালে পাড়ার সাধারণ দোকানেও পাঁচকড়ি দের উপন্যাসের ফর্মা আলাদা করে বিক্রি হত। পাঁচকড়ি কিন্তু যথেষ্ট সচেতন লেখক, শার্লক হোমসের বাঙালি সংস্করণ তাঁর গোবিন্দরাম। পড়লে বোঝা যায় ‘কন্সালটিং ডিটেকটিভ’ গোবিন্দরাম শুধু পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণের পাশ্চাত্যপদ্ধতিরই অনুসারী নন, ভারতীয় ন্যায়দর্শনের অনুমান পদ্ধতিরও খবর রাখেন। গোয়েন্দাকাহিনির বিলিতিয়ানার মধ্যে স্বাদেশিকতা মিশে যাচ্ছে, বাঙালি গোয়েন্দা পরাধীন বাঙালিজাতির বুদ্ধি-বীরত্বের প্রতীক এই বোধ পরে অনেক ক্ষেত্রেই গোয়েন্দা ও অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিতে নিহিত অথবা প্রকাশ্য। বাঙালি শার্লক গোবিন্দরামের কাছে সরকারি পুলিশ নিষ্প্রভ, অবশ্য বাস্তবে পুলিশের বাঙালি দারোগারা সবাই অপদার্থ ছিলেন না। দারোগা গিরিশচন্দ্র বসুর লেখায় আছে ডাকাতি মালের মজুতদার মনোহর ঘোষকে ধরার বৃত্তান্ত। দস্যু মনোহর নানা সময় পুলিশকে কম নাজেহাল করেনি। শেষে গিরিশচন্দ্রের হাতে ধরা পড়ার পর রামকুমার চৌকিদারের আনন্দ আর দেখে কে! ‘এক ছিলাম গাঁজা টানিয়া আসিয়া’ গিরিশচন্দ্রকে ‘বলপূর্ব্বক তাহার স্কন্ধে উঠাইয়া’ ‘ওমা দিগম্বরী নাচো গো’ গান ধরলে। ইতিহাসবিদ হবসবম তাঁর ব্যানডিটস বইতে সামাজিক ও প্রতিরোধী দস্যুবৃত্তির যে প্রকল্প নিয়ে পর্যালোচনা করেছিলেন বাঙালি দারোগাদের বয়ানে সেই ‘উন্নতচিত্ত’ দস্যুদের কথা উঠে আসে না। তারা ভাল ডাকাত নয়, খারাপ ডাকাত— সাধারণ মানুষকে খুন করে, লুণ্ঠিত সম্পদ নিজের ভোগে ব্যবহার করে, নিষ্ঠুরতা তাদের প্রবৃত্তি। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর বাঙলার ডাকাত বইতে বিশ্বনাথের মতো যে ‘ডাকাত ছেলে’র বিবরণ দিয়েছিলেন তাদের কথা লিখতে হলে গিরিশচন্দ্রের মতো শিক্ষিত বাঙালির চাকরি করা সম্ভব হত না। গিরিশচন্দ্র তো আর মিয়াজান দারোগা নন। ১৮৬৯-এ ইংরেজিতে যখন দ্য কনফেসন অব মিয়াজান দারোগা অব পোলিশ ছাপা হয়েছিল তখন ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ কবুল করেছিল নেটিভ পুলিশের পদোন্নতির কারণ নিকট আত্মীয়-রমণীর বড়কর্তাভোগ্য রূপ। রানির আমলে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। গিরিশচন্দ্রদের সময় অবস্থা খানিক বদলেছে। গিরিশচন্দ্র ভাল দারোগা— খারাপ দস্যুদের দমন করে রানির অধীন দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠা তাঁর কাজ।

দারোগা-পুলিশ-গোয়েন্দা তিনের উত্থানে ভাল ডাকাতদের দিন শেষ। খারাপ ডাকাতরা জেলবন্দি। আর ছোটবেলার খেলার সেই চোরেরা? তাদের কী হল? প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত চোর চতুর্দশী সেই চোরদের খবর দিয়েছে। চোরের নানা গোত্র। তারা বুদ্ধিমান, কৌশলী, খারাপ ডাকাতের মতো খুব বেশি ক্ষতি তারা করে না। যেটুকু ক্ষতি করে তার পেছনে সামাজিক প্রশ্রয় আছে। উপেন্দ্রকিশোরের ঝানু চোর চানু যে ভাবে রাজাকে বলে কয়ে বুদ্ধি করে ঠকিয়ে রাজকন্যে লাভ করল তা

আমবাঙালি ভাল চোখেই দেখে। দারোগা গিরিশচন্দ্রের বয়ানে পাওয়া যাচ্ছে এক চোরের কথা। সে রান্নাঘরের খাবার সাফ করে দারোগার সামনে দিয়েই প্রায় কালিঝুলি মেখে ভূত সেজে কেটে পড়ল। চোরের উপস্থিত বুদ্ধি দারোগার থেকেও বেশি। খারাপ ডাকাতের থেকে বুদ্ধিমান চোরের প্রতি সামাজিকের প্রশ্রয় বেশি, আবার চালাক চোরের চাইতে রবিনহুড মার্কা ডাকাতেরা সমাজে বেশি আদৃত। সামাজিক আদর অনাদরের ওপরেই তো চোর-ডাকাতের পয়েন্ট পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে। তারা গোয়েন্দা বা পুলিশের কাছে ধরা পড়বে কি না, পড়লেও সামাজিক মানুষের সমর্থন পাবে কি না সবই নির্ভর করে তাদের ভূমিকার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর। সেই যে খেলায় দারোগা ডাকাত চোর পুলিশের ভূমিকা বদলে যেত সে কি আর এমনি এমনি!

ঔপনিবেশিক পর্বের ক্রাইমের চরিত্র, পুলিশিব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অরুণ মুখোপাধ্যায়, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। বয়ানভেদে বাঙালি চোর-ডাকাত-পুলিশের মন-মানসিকতা-সামাজিকতার ইতিহাস রচনার কাজ এখনও অনেকটাই বাকি। একাজ করার আগে বয়ানগুলি পাঠকের কাছে উঠে আসা চাই। অলোক রায় অশোক উপাধ্যায় তাঁদের সম্পাদিত সেকালের দারোগার কাহিনী বইটিতে তথ্যনিষ্ঠ সুসম্পাদনার যে মডেল অনুসরণ করেছেন তা একদিক থেকে আদর্শ হতেই পারে। এ জাতীয় সুসম্পাদিত গ্রন্থ যত বেশি প্রকাশিত হয় তত ভাল।

আরও পড়ুন
Advertisement