পুস্তক পরিচয় ২

জনজীবনের সাংস্কৃতিক অন্বেষণ

বাংলার বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদান জনজীবনের আঞ্চলিকতায় বিশিষ্টতা পেয়েছে। রূপবৈচিত্রের প্রবহমান ধারা আঞ্চলিক জীবন ও সংস্কৃতিকে বৈভবশালীও করেছে। যেমন, আঠারো ভাটির দেশ-পরিচয়ে সুন্দরবনের দুর্গমতা ও দারিদ্রমেশা জনজীবনের সাংস্কৃতিক অন্বেষণ নানা প্রসঙ্গেই আগ্রহের বিষয়। বসবাসের দৈনন্দিনতার মাঝে সুজিত সুর মাটিতে পা রেখে (পাঠশালা প্রোডাকশন্স, ৩০০.০০) বইতে লোকজীবন ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেছেন তাঁর দেখা আর অভিজ্ঞতার নিরিখে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

বাংলার বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদান জনজীবনের আঞ্চলিকতায় বিশিষ্টতা পেয়েছে। রূপবৈচিত্রের প্রবহমান ধারা আঞ্চলিক জীবন ও সংস্কৃতিকে বৈভবশালীও করেছে। যেমন, আঠারো ভাটির দেশ-পরিচয়ে সুন্দরবনের দুর্গমতা ও দারিদ্রমেশা জনজীবনের সাংস্কৃতিক অন্বেষণ নানা প্রসঙ্গেই আগ্রহের বিষয়। বসবাসের দৈনন্দিনতার মাঝে সুজিত সুর মাটিতে পা রেখে (পাঠশালা প্রোডাকশন্স, ৩০০.০০) বইতে লোকজীবন ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেছেন তাঁর দেখা আর অভিজ্ঞতার নিরিখে। ইতিহাসের পাঠ আর প্রবহমান কাহিনির উল্লেখে এখানে আছে বনবিবির উৎস সন্ধানে নতুন আলোকপাত।

বাঙালির জীবন-সংস্কৃতিতে ধান অবিচ্ছেদ্য পরম্পরার অংশ। আর এই সংস্কৃতি বিশ্বজনীন। বেঁচে থাকার মূল খাদ্য-উপকরণ হিসাবে, আবার রীতি-আচার-পুজো-পার্বণ-উৎসবের বৈচিেত্র ধানের কথা শেষ হওয়ার নয়। সূর্যমণি, পর্বতজিরা, মতিশাল, পক্ষীরাজ, লক্ষ্মীবিড়াল, বেগুনবিচি— এমন শত শত প্রজাতির ধানের চাল বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। লীনা চাকীর সম্পাদনায় বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি (পুনশ্চ, ২৫০.০০) নিয়ে এই বই সার্বিক চর্চার প্রয়াস।

Advertisement

মুসলমান সমাজ-সংস্কৃতিতে আচার-অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক নিয়মনিষ্ঠতা এবং চান্দ্রমাসের অনুসরণে উৎসবের প্রাণময়তা নিয়ে হাসির মল্লিক লিখেছেন মুসলমান আচার অনুষ্ঠান-উৎসব (বটতলা, ৩০০.০০)। কোষগ্রন্থের ধাঁচে আলোচনার বিস্তার হলেও জীবন-ধর্মের সূক্ষ্ম জিজ্ঞাসার উদ্‌ঘাটন হয়েছে, ধর্মীয় মনের মহত্তর আঙিনায় তৈরি হয়েছে তথ্য ও তত্ত্বের পরিসর।

দিলীপকুমার গোস্বামীর সীমান্ত রাঢ়ের লোকসংস্কৃতি (পারিজাত প্রকাশনী, ১৫০.০০) পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূমের লোকায়ত সংস্কৃতি চর্চা। ভাদু, টুসু, আহিরা, ঝুমুর গানের আলোচনার সঙ্গে ছো, দাসাই, জাওয়া-করমের নাচ-গান, ইঁদ ও ছাতা পরবের কথা নতুন তথ্য-বিন্যাসে পরিবেশিত।

বাউল সাধক ও শিল্পীর নিজস্ব রচনায় স্বতন্ত্র বিষয়ভিত্তি গড়ে ওঠে। গূঢ় অন্তরস্পর্শী পদগুলি প্রশ্নোত্তরী রীতিতে লিখেছেন বাউলসাধক তরণীসেন মহান্ত প্রশ্নোত্তরে বাউল গান (লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১২০.০০) বইয়ে। প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষিতের সূত্রে, মতাদর্শের লোেকদের মধ্যে দু’জনের গায়কী প্রশ্নোত্তর আলোচনার ঢঙে জীবনদর্পণ ও সাধনার নানা দিক আলোকিত করেছে। এই কেন্দ্র প্রকাশ করেছে বাউলশিল্পী মণিমোহন দাস রচিত গ্রামীণ সংগীতের ডালি (১৫০.০০)। বাউল সংগীতকে ভিত্তি করে প্রার্থনা, আত্মনিবেদন, মনশিক্ষার পর্যায়ধারা লেখকের রচনায় প্রকাশ পেয়েছে।

বাউল-ফকিরির প্রথাগত ধর্মবিমুক্ত উদারতায় যে কট্টরপন্থী আঘাত আসে তা কোনও ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হলেও বহু অন্তরালে থেকে যায়। প্রায় চার দশক যাবৎ শক্তিনাথ ঝা লোকধর্ম গবেষণার পাশাপাশি এ সব সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছেন সংশ্লিষ্ট মানুষজনকে। বাউল ফকির ধ্বংস-আন্দোলনের ইতিবৃত্ত (মনফকিরা, ২৫০.০০) তাত্ত্বিক বর্ণনা নয়, তথ্য-প্রতিবেদনে বাউল ফকিরদের ওপর অত্যাচারের নানা ঘটনাবিন্যাস। মূলত মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার প্রসঙ্গ থাকলেও সার্বিক সমস্যার ইঙ্গিত মেলে।

পুরাণ চর্চায় ধর্মীয় অনুষঙ্গের বহুবর্ণী বর্ণনা থাকে। অন্য দিকে, লোকপুরাণের বিশ্বজনীন সত্তায় সমাজবিজ্ঞানের ধারাপথ সুস্পষ্ট। বিদ্যাশৃঙ্খলায় লোকপুরাণ বা মিথের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষিতে উৎস, বিবর্তন, সৃষ্টি ও ধ্বংস বিষয়ক লোকপুরাণের পরিকাঠামো অন্বেষণ, তুলনামূলক বিচার ও বিশ্লেষণে মাধুরী সরকার আলোচনা করেছেন লোকপুরাণে সৃষ্টি-প্রলয়ের তত্ত্ব (অক্ষর প্রকাশনী, ২৫০.০০)।

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল ও জাদুশক্তির ধারণা নিয়ে মন্ত্রের যে প্রচলন-ধারা, তা দেশ-বিদেশের চর্চার নিরিখে আলোচনা করেছেন বরুণকুমার চক্রবর্তী তাঁর লৌকিক মন্ত্র (পুস্তক বিপণি, ১৪০.০০) বইতে। বাংলার প্রেক্ষিতে লৌকিক মন্ত্র ও গুনিনের কথা, মন্ত্রের প্রয়োগ ও ফলাফল, সর্পবিদ্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা।

মাটির পুতুলের সঙ্গে বঙ্গজীবনের যে সরল ও সহজাত একাত্মতা, তা আজ বহুলাংশে ক্ষীয়মাণ। তবু গ্রামগ্রামান্তরে আজও তা টিকে আছে— মূলত মেলা-উৎসবের উপলক্ষে। বিধান বিশ্বাস বাংলার মাটির পুতুল (টেরাকোটা, ১২৫.০০) লেখায় সে সবেরই সূত্রসন্ধান দিয়েছেন। মেয়েলি পুতুলের কথায়, কারিগর, জেলাভিত্তিক পুতুল তৈরির কেন্দ্র ও বিক্রয়কেন্দ্রের কথা এবং ব্যবহারের ভবিষ্যৎ দিশা নিয়ে আছে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত।

কোল ভাষার উৎস চারিত (কোল সমাজ হায়াম সানাগম সোসাইটি, ৪০০.০০) কার্তিকচন্দ্র বাআঁদা রচিত এক বিশেষ প্রয়াস। কোল বা হো জনগোষ্ঠীর এক জন নিজেরই ভাষা চর্চার ঐতিহ্য পরম্পরাকে প্রকাশ করেছেন। কোল জাতির ইতিহাস ও ভাষার উদ্ভব, আড়াঙ-চিতি লিপি বর্ণনার সঙ্গে কোল শব্দ ও ধ্বনির অর্থ, উৎপত্তি, ব্যবহার ও বিন্যাসের পরিশ্রমী তথ্য সংকলন করেছেন। প্রাসঙ্গিক প্রাককথন লিখেছেন সুহৃদকুমার ভৌমিক।

ভাষাবৈশিষ্ট্যে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রের সঙ্গে একাত্ম। বাংলা ভাষার আঞ্চলিক ও নৃগোষ্ঠীগত উপভাষা ছাড়াও নেপালি, হিন্দি, সাঁওতালি, মুন্ডারি, মেচ, রাভা, ভুটিয়া, লেপচা, তিব্বতি ইত্যাদি নানা ভাষাভাষী মানুষ উত্তরবঙ্গকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রমোদ নাথ রচিত উত্তরবঙ্গের ভাষাসমীক্ষা (দি সী বুক এজেন্সি, ১০০.০০) জেলাভিত্তিক আলোচনায় বিবিধ জনগোষ্ঠী ও ভাষার স্বরূপ সন্ধানের সংক্ষিপ্ত পরিচায়িকা।

আরও পড়ুন
Advertisement