চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

ছবিতে ভাবনা ও রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ‘স্বীকৃতি’ শীর্ষক বিড়লা অ্যাকাডেমির বার্ষিক অনুষ্ঠান। দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষবিড়লা অ্যাকাডেমিতে প্রতি বছর বার্ষিক প্রদর্শনীতে যাঁরা পুরস্কৃত হন তাঁদের কাজ নিয়ে ‘স্বীকৃতি’ শিরোনামে একটি সম্মেলক প্রদর্শনী হয়। এ বারেও হয়েছে। অংশ নিয়েছিলেন পুরস্কৃতরা। তরুণ শিল্পীদের প্রকাশের অভিমুখ যে অনেকটাই পাল্টাচ্ছে, এ বারের প্রদর্শনীতে তা খুবই স্পষ্ট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে প্রতি বছর বার্ষিক প্রদর্শনীতে যাঁরা পুরস্কৃত হন তাঁদের কাজ নিয়ে ‘স্বীকৃতি’ শিরোনামে একটি সম্মেলক প্রদর্শনী হয়। এ বারেও হয়েছে। অংশ নিয়েছিলেন পুরস্কৃতরা। তরুণ শিল্পীদের প্রকাশের অভিমুখ যে অনেকটাই পাল্টাচ্ছে, এ বারের প্রদর্শনীতে তা খুবই স্পষ্ট।

বিড়লার বার্ষিকীতে ঐতিহ্যগত প্রকাশভঙ্গির উপর অনেকটা গুরুত্ব ছিল কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। পুরস্কারের ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন থাকত। এ বারের প্রদর্শনী সেই ধারাবাহিকতা থেকে একেবারেই আলাদা।

Advertisement

আজকের তরুণ শিল্পীরা যে প্রথাগত রূপরীতি থেকে সরে এসে ‘বিকল্প রূপকল্প’-কেই প্রাধান্য দিতে চাইছেন, এ বারের প্রদর্শনী সেই বার্তাই বহন করে। সমাজ-বাস্তবতার জটিল পরিস্থিতিই এর কারণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ভাবনা ও প্রকাশের মধ্যে সমন্বয় ঘটে না। অভাব ঘটে দক্ষতার ক্ষেত্রে। প্রদর্শনীকে তা যথেষ্ট ভারাক্রান্ত করে। তবে এবারে প্রদর্শনীটি সাজিয়ে তোলার মধ্যে যথেষ্ট ভাবনা ও রুচিবোধের পরিচয় রয়েছে যা নজরে পড়ে।

দুর্বানন্দ জানা বিশ্বভারতী থেকে ২০১৩-য় স্নাতকোত্তর করেছেন। তাঁর ইনস্টলেশন ও ভিডিও নির্ভর রচনাগুলি আজকের সামাজিক রাজনৈতিক সংকটকে প্রকৃষ্ট ভাবে প্রতিফলিত করেছে।

মাইগ্রেশন’ শীর্ষক রচনায় শিল্পী দেখিয়েছেন কেমন করে অসমে সুগন্ধি ধূপ তৈরি করে যে সব তরুণ শ্রমিক তারা দুবাইতে অভিবাসিত হয়ে সেখানেই জীবন কাটায় উচ্চতর পারিশ্রমিক ও প্রতিষ্ঠার আশায়। তারপর সামগ্রিক এক মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। এর সঙ্গে শিল্পী উপস্থাপিত করেছেন একটি ‘অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি প্রজেক্ট’, যাতে দেখা যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ উপেক্ষা করে উপরের দিকে ক্রমাগত উঠে যাচ্ছে একটি গড়িয়ে যাওয়া চক্র।

একে তিনি দেখিয়েছেন নিম্নতর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উচ্চতর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে অভিবাসনের প্রতীক হিসেবে। ‘ফরগেটফুলনেস’ শীর্ষক ভিডিও-ইনস্টলেশনে শিল্পী দেখিয়েছেন কলকাতায় বড় বড় অগ্নিকাণ্ডে কী ভাবে প্রকট হয়ে ওঠে নানাবিধ দুর্নীতি ও অনাচার। আজকের দৃশ্যকলা সামাজিক বিপর্যয়কে সামগ্রিক ভাবে তুলে ধরতে চায় বলে প্রথাগত রূপভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে ‘বিকল্প রূপকল্প’ নিয়ে নিবিষ্ট চর্চা করছে।

মল্লিকা দাস সুতার ‘সেল্ফ মেমোরাইজিং’ চিত্রধর্মী রচনায় সমাজবাস্তবতাকে বিমূর্তায়িত করে ভিন্ন ধারার রূপরীতি তৈরি করেছেন, যা তাঁর এতদিনকার প্রকাশভঙ্গি থেকে আলাদা ভাবে প্রকাশ পায়।

অমিত দেবনাথ তাঁর ভাস্কর্যধর্মী রচনায় প্রেসার কুকারকে ব্যবহার করেছেন সমাজের অন্তর্নিহিত চাপের প্রতীক হিসেবে। বরোদার অভিজিত্‌ সিংহ অ্যাক্রিলিক ও কোলাজের ড্রয়িংধর্মী রচনায় রূপাবয়বকে বিশ্লিষ্ট করে নাগরিক বিপর্যয়ের প্রতীক করে তুলেছেন। দক্ষ অঙ্কনের মধ্য দিয়ে তিনি প্রথাগত রূপভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে বলিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপকল্প তৈরি করেছেন, যা গভীর এক শূন্যতাকে অভিব্যক্ত করে।

সুরজিত্‌ সরকার কাচের ভাস্কর্য করেছেন। স্বচ্ছতার বিশেষ মাত্রাকে ব্যবহার করে রিক্ততাকে মেলে ধরতে চেয়েছেন। রাজাপ্পা রায়ের কালি-কলম ও কন্টির রচনাগুলি ড্রয়িংধর্মী। নীলাঞ্জন দাস ব্যক্তির হতাশা ও মানসিক বিপর্যয়কে স্বাভাবিকতাবাদী রূপের বিন্যাসে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন।

মণীশ কিশোরও এচিং মাধ্যমে অন্ধকার ও আলোর দ্বৈতে বিমূর্ত রূপাবয়বে বদ্ধতা ও স্বাধীনতার সংঘাতকে উন্মীলিত করতে চেয়েছেন। শিবাশিস দাসের ‘দ্য ব্ল্যাকলাইট’ ডিজিটোগ্রাফির রচনাগুলিতেও আলো-অন্ধকারের দ্বৈতে আত্মিক সংকট প্রতীকায়িত হয়েছে।

বিশ্বভারতীর প্রশিক্ষিত পল্লবী দাস আলোকচিত্রের সুচারু ব্যবহারে বাস্তবতার গভীর সংকটকে অত্যন্ত প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাবে উন্মীলিত করেছেন। আধুনিকতাবাদী মননের সঙ্গে উত্তর-আধুনিক প্রত্যয়কে মিলিয়ে নেওয়ার সফল দৃষ্টান্ত তাঁর রচনাগুলি।

আই স্ট্যান্ড অ্যালোন’ রচনায় ব্যাপ্ত শূন্য পরিসরে একটি নির্জন চেয়ারকে দিয়ে অনেক কথা বলাতে পেরেছেন তিনি। এখানেই শিল্পীর সার্থকতা ধরা পড়ে।

আরও পড়ুন
Advertisement