পুস্তক পরিচয় ১

ছোটদের দুনিয়ার সাতরঙা রামধনু

কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত লেখক–শিল্পীদের কলম-তুলিতে ঝলমলে ছোটদের নানা বার্ষিকীর পাশাপাশি জেলার ছোটদের শারদসংখ্যাগুলি ততটা দর্শনধারী না হলেও আন্তরিকতায় বোধহয় অনেক এগিয়ে। বহরমপুরের ইচ্ছে ফড়িং (সম্পা: অনুপমা বন্দ্যোপাধ্যায়) ছোটদের অনেক ভাল লেখা ছেপেছে, সঙ্গে বড়দের লেখা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১

ইচ্ছে ফড়িং একটা ইচ্ছের কথা তোমাদের বলতে চায়।... এসো বন্ধু আমরা এবারের পুজোয় এই প্রতিজ্ঞা করি, আমরা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া বন্ধুকে সাহায্য করব। (‘আমাদের কথা’, ইচ্ছে ফড়িং শারদ সংখ্যা ১৪২২)।

বন্যার কারণে যারা পুজোর আনন্দে মেতে উঠতে পারলে না তাদের সঙ্গে আমরা দুঃখ ভাগ করে নিতে চাই। (‘সম্পাদকীয়’, সঞ্চিতা শারদ সংখ্যা ১৪২২)

Advertisement

কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত লেখক–শিল্পীদের কলম-তুলিতে ঝলমলে ছোটদের নানা বার্ষিকীর পাশাপাশি জেলার ছোটদের শারদসংখ্যাগুলি ততটা দর্শনধারী না হলেও আন্তরিকতায় বোধহয় অনেক এগিয়ে। বহরমপুরের ইচ্ছে ফড়িং (সম্পা: অনুপমা বন্দ্যোপাধ্যায়) ছোটদের অনেক ভাল লেখা ছেপেছে, সঙ্গে বড়দের লেখা। জয়ন্ত ঘোষের বড় গল্প ‘ফ্রেজার সাহেবের ট্রেজার’, সৌম্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’, চল্লিশটিরও বেশি ছোটগল্পের অনেকগুলি ভাল লাগে। মুর্শিদাবাদেরই আজিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত কাকলি-র (সম্পা: সুজিতকুমার পাত্র) শুরুতেই মন ভাল করা গৌর বৈরাগীর ‘জলখাবারে পান্তা’ বা শিশির বিশ্বাসের ‘রূপকথা নয়’। সমুদ্র বসু সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখালিখির কথা শুনিয়েছেন। মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামীর কলমে উজ্জ্বল বিস্মৃত শিশুসাহিত্যিক হরেন ঘটক। পুরুলিয়া-র সঞ্চিতা (সম্পা: তরুণকুমার সরখেল) সংকলন করেছে ছোটদের জন্য গল্প-কবিতা-ছড়া। সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত গল্প ‘আদিত্য বর্ধনের আবিষ্কার’ শেষ করার চেষ্টা, সুচিত চক্রবর্তীর ‘সবাই বলে পড়ো’ আকর্ষণীয়। নদিয়ার ধুবুলিয়া-র ছোটদের নীল আকাশ (সম্পা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও রমেন্দ্রনারায়ণ বিশ্বাস), আর নদিয়ার বগুলা-র গল্পের ফেরিওয়ালা (দোলনা-৯, সম্পা: দেবদুলাল কুণ্ডু), আয়তনে ছোট হলেও উজ্জ্বল। প্রথমটিতে পার্থসারথী চক্রবর্তী লিখেছেন তাঁর বাবা, প্রয়াত বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ননীগোপাল চক্রবর্তীর কথা। দ্বিতীয়টিতে নজর টানে মধুসূদন ঘাটীর ‘চোর পড়ানো অঙ্কস্যার।’ পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া-র টাপুরটুপুর (সম্পা: মধুসূদন ঘাটী) ৩৬ বর্ষে পা দিল। সম্পাদক লিখেছেন, ‘‘যদি ছোটদের পত্রিকার ইতিহাসে ‘সখা’কে প্রথম পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়, তবে এখন কেন আমরা এলোমেলো ছাপা, প্রতিটি লেখায় ছবি ছাড়া এমনকি রঙিন প্রচ্ছদ ছাড়া ছোটদের হাতে তুলে দেব কোনও পত্রিকা?’’ খুব সত্যি কথা। অনেক যত্নে টাপুরটুপুর তৈরি হয়েছে। লেখার সঙ্গে চমৎকার অলংকরণ। রতনতনু ঘাটীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, সুখলতা রাওয়ের কথা (মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামী), মধুসূদন ঘাটীর উপন্যাস ‘ঘুম-পুতুলের দেশে’, দীপান্বিতা রায়ের ‘শুঁয়োপোকার সমস্যা’, বাণীব্রত চক্রবর্তীর ‘সিন্দুকের গল্প’ পড়তে ভাল লাগে।

৪৩ বর্ষে শতদ্রু (সম্পা: লোকেশ হোম রায়) স্মরণ করেছে যোগীন্দ্রনাথ সরকারকে। অমল করের ‘চা’, সিদ্ধার্থ সিংহের ‘ইটালি’ ছাড়াও আছে নানা স্বাদের গল্প-কবিতা। খেলা আর গল্প-এর (সম্পা: উৎপল চৌধুরী) শুরুতেই পবিত্র সরকারের বিশেষ রচনা ‘ভাষা ব্যাপারটা কী’: ‘মানুষের ভাষার মূল খেলা— ধ্বনি জুড়ে জুড়ে কথা, কথা জুড়ে জুড়ে বাক্য।’ জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘বন্ধু’, শৈবাল চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলা’ সংকলনটিকে অভীষ্ট মাত্রা দিয়েছে। দুরন্তের হৈচৈ-এ (সম্পা: বুলবুল ভট্টাচার্য) গল্প-ছড়ার সঙ্গে জানবার কথা। সোনালি স্বপ্ন (সম্পা: সুবল চন্দ্র নস্কর) ভরে আছে অজস্র ছড়া-কবিতায়, আছে ছোট ছোট গল্প, ভ্রমণকাহিনি। কিচিরমিচির (সম্পা: সুদীপ্ত চক্রবর্তী) উৎসব সংখ্যার শুরুতেই শৈলেন্দ্রনাথ হালদারের ৩০টি ‘পাখির ছড়া’: ‘ভোর না হতেই হাজির কারা/রান্নাঘরের চালে?/ নয়তো বসে রোদ পোহাবেন/ ছোট্টো গাছের ডালে?’ (শালিক)। হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের নিয়ে অনন্যা দাশের ‘নিরুদ্দেশের সন্ধানে’ নাড়া দেয়। তেমনই জমাট রহস্যকাহিনি জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘ভূতুড়ে কান্না রহস্য’, আর দোয়েল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানবিক গল্প ‘বুদ্ধির গাছ’। সমুদ্র বসু সংগ্রহ করেছেন সমরেশ বসুর ‘গোয়েন্দা গোগোল’-এর যাবতীয় কীর্তিকাহিনি। চাঁদের হাসি (সম্পা: ছন্দা চট্টোপাধ্যায়) শারদ সংখ্যায় ছোট ছোট নানা স্বাদের গল্পের সঙ্গে জাগলার অভয় মিত্রের লেখা ‘শরীর ও মন গঠনে জাগলিং’। ছোটদের কচিপাতা-য় (সম্পা: সমর পাল) ভূতের গল্প, ইতিহাসের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, মজার গল্প, রূপকথার গল্পের সঙ্গে শিশুমনের গল্প, পরিবেশের গল্প, সুন্দরবনের গল্প আলাদা বিভাগে চোখে পড়ে। এ পি জে আবদুল কালামকে নিয়ে ‘মিসাইল ম্যান’ রচনায় পরমাণু শক্তি নিয়ে তাঁর বিতর্কিত ভূমিকার কথা বাদ দেননি শ্যামল চক্রবর্তী। অনন্যা দাশের ‘ঈশানের বদলে যাওয়া’ আজকের মোবাইল গেমসে ব্যস্ত ছোটদের জন্য। অবি সরকারের ‘এক ভৌতিক লেখকের মৃত্যু’ কি ভূতের গল্পের লেখকদের জন্য চেতাবনী? অমিতাভ পালের ‘পৌষ পার্বণের অতিথি’ মন কেমন করা গল্প।

নির্মল বুক এজেন্সি-র ছুটির ছুটি-তে (সম্পা: ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়) খেলার মাঠ বাঁচানোর গল্প লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলন (‘শুভদের খেলার মাঠ’)। আছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনি আর রাজার কথা’: সুনির্মল চক্রবর্তীর নাট্য রূপান্তরে। তাপস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কিশোর দুনিয়া-য় মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামীর আলোচনা ‘ঘনশ্যাম দাসের স্রষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্র’। মহাভারত-এর প্রথম বাংলা অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বরের কথা লিখেছেন মানসরঞ্জন গুপ্ত। উপেন্দ্রকিশোরের ‘দুষ্টু বাঘ’ নাট্য রূপান্তরিত করেছেন সুনির্মল চক্রবর্তী। কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান (সম্পা: সোমনাথ বল) পা দিল ৩৫ বর্ষে। এর পাতায় বাড়তি নজর বিজ্ঞান-কল্পবিজ্ঞান-প্রকৃতি-পরিবেশ প্রসঙ্গে। মঙ্গলগ্রহে রোবট-পুরোহিতের সরস্বতী পুজোর গল্প লিখেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (‘দু নম্বর পুরুত’)। শান্তনু বসুর বিজ্ঞানভিত্তিক রহস্য উপন্যাস ‘পানাগড়ের জঙ্গলে’ আকর্ষণীয়। কৃত্রিম সূর্য বা সোনা-টানা চুম্বক নিয়ে কল্পবিজ্ঞানের গল্প ছাড়াও আছে শ্যামল চক্রবর্তীর অনুবাদে জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকারের প্রবন্ধ।

ঝালাপালা (সম্পা: অশোককুমার মিত্র) তিন যুগ পেরিয়েও টগবগে। নতুন লেখার সঙ্গে ক্রোড়পত্র ‘ফিরে দেখা-১৩৮৭-১৪১১’: ঝালাপালা-র প্রথম পঁচিশ বছরের গল্প-কবিতা-নাটক-ভ্রমণ-স্মৃতিকথা-প্রবন্ধের সংকলন। কে নেই লেখক তালিকায়: প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী, অদ্রীশ বর্ধন, পরিতোষ সেন, অজেয় রায়, সিদ্ধার্থ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, নবনীতা দেবসেন— এক কথায় গত শতকের আশি-নব্বই দশকে ছোটদের জন্য সেরা কলমচিদের লেখা এক সঙ্গে পাওয়া এ বারের পুজোর অন্যতম সেরা উপহার।

শারদীয় শুকতারা (সম্পা: অরুণচন্দ্র মজুমদার) উপন্যাস, নানা স্বাদের গল্প-কবিতা এবং কমিকস নিয়ে সেজে উঠেছে। বিখ্যাত লেখকরা আছেন তবে সকলেই স্বমহিমায় নন। ডা. শ্যামল চক্রবর্তীর ‘সময়স্যারের ঘড়ি’ এক আশ্চর্য শিক্ষকের আখ্যান। হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তর ‘অক্টোপাসের লাল মুক্তো’, সুভাষ ধরের ‘একটি বিলম্বিত তদন্ত’, কার্তিক ঘোষের ‘সৃজার আঁকা ছবি’, অভিজিৎ তরফদারের ‘চিল্কাপাড়ের গহ্বরে’ ছোটদের ভাল লাগবে।

দেবাশিস বসু সম্পাদিত আমপাতা জামপাতা প্রায় ছ’শো পাতার সংকলন। সযত্ন অলংকরণে সাজানো এমন পূজাবার্ষিকী পুরনো দিনের কথা মনে পড়ায়। বিশেষ রচনা ‘ছোটদের বার্ষিকী’ (অশোককুমার মিত্র), ‘সন্দেশের অলংকরণ— প্রথম পর্যায়’ (দেবাশিস সেন) জরুরি তথ্যায়ন। শৈলেন ঘোষের ‘ছায়া’ মন টানে। ছোট্ট বাঘের গল্পে হেমেন্দুশেখর জানা নাড়া দেন অনেক গভীরে (‘এক ছিল বাঘ বাঘৈ’)। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘উট চলেছে মুখটি তুলে’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘রহস্যময়’ আকর্ষণীয়। তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘুড়িয়াল’ শুকতারা আর আমপাতা জামপাতা দুটি পত্রিকাতেই হুবহু এক গল্প, এ ভারি আশ্চর্য!

শিশুমেলা (সম্পা: অরুণ চট্টোপাধ্যায়) প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৬১ থেকে। একটু ছোটদের জন্য বড় হরফে প্রচুর ছবি সহ ঝকঝকে ছাপায় ধারাবাহিকতা অটুট। মন ভাল করে দেয় দীপান্বিতা রায়ের ‘পথ হারানো মেঘবালক’, পঞ্চানন মালাকরের ‘ভাইফোঁটা’, শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যর ‘রুপু আর টিপু’। প্রকৃতি, জীবজগৎ আর ছোটদের ছোট্ট পৃথিবীর ছোট ছোট গল্প সাজিয়ে চমৎকার ফুলের ডালি।

কিশোরবাহিনীর পত্রিকা রঙবেরঙ (সম্পা: চন্দন নাথ) ‘আমাদের কথা’য় প্রশ্ন তুলেছে, ‘যখন বন্যায় ভাসছে বেশ কিছু গ্রাম... কাগজের পাতায়, টিভির খবরে তখন থেকেই শুরু হয়েছে পুজো নিয়ে এক আজব লড়াই।... আন্তরিকতাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে দেখনদারিটাই কি বড়ো হয়ে উঠছে ক্রমশ?’ সাধনা মুখোপাধ্যায়ের ‘জন্মদিনের নেমন্তন্ন’, সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ‘যারা মেঘ কিনত’, হেমেন্দুশেখর জানার ‘মুকুল’, রামধনুর রঙ ছড়িয়ে দেয়।

কিশোর ভারতী (সম্পা: ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়) এবার ৪৮-এ পড়ল। জনপ্রিয় এই পূজাবার্ষিকী গল্প-উপন্যাস-রঙিন কমিকস-ছড়া কবিতায় এ বারেও যথেষ্ট জমকালো। অনীশ দেবের ‘সংঘর্ষ যদি হয়’ খুব চেনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় অন্য পথ দেখিয়েছে। ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিয়ারব্রুক রহস্য’ জগুমামা-টুকলুর রহস্যভেদ, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তর ‘এলাপুর ভাস্কর’ তুলে এনেছে ইলোরার কথা, সঞ্জীব চৌধুরীর ‘একের পর এক’ এক অদ্ভুত রহস্য-উন্মোচন।

হৈ হৈ-তে (সম্পা: দেবব্রত নিয়োগী) সম্পাদকের সরস গল্প ‘গাব্বু এখন’-এর সঙ্গে বাংলার নদী, প্রয়াত আবদুল কালামকে নিয়ে নিবন্ধ মনের খোরাক জোগাবে।

বাংলা ভাষায় প্রথম ছোটদের বার্ষিকী নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত পার্বণী (১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। ১৩২৭-এ দ্বিতীয় তথা শেষ বার প্রকাশ পায় এটি। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ১৪০৯ বঙ্গাব্দে অত্যন্ত দুর্লভ এই সংকলন দুটি উদ্ধার করে একত্রে প্রকাশিত হয় পত্রভারতী থেকে। মূল প্রচ্ছদ ও লেখক-পরিচিতি, অনেকের ছবি সহ ছিল একটি প্রয়োজনীয় ভূমিকাও। এ বার পুজোয় আবার চতুর্থ পরিমার্জিত সংস্করণে সুলভ হল পার্বণী।

আরও পড়ুন
Advertisement