চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

চিহ্ন ও প্রতীকে বিপন্ন বাস্তবতার প্রকাশ

স্টুডিও ২১-এ চলছে তিনজন তরুণ শিল্পীর কাজ নিয়ে ‘আউটলায়ার্স’ শীর্ষক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।স্টুডিও ২১-এ চলছে তিনজন তরুণ শিল্পীর কাজ নিয়ে ‘আউটলায়ার্স’ শীর্ষক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১

চিহ্নই চেনায়। মানুষের ভাষা অজস্র চিহ্নের সমষ্টি। আমাদের লেখার বা পড়ার ভাষা কতগুলি দৃষ্টিগ্রাহ্য চিহ্ন। আর বলার ভাষা শ্রুতিগম্য চিহ্ন। শিল্পকলাও গড়ে ওঠে চিহ্নেরই সমবায়ে। চিহ্নের বিভিন্ন বিন্যাসে একজন শিল্পী তৈরি করেন প্রতিমাকল্প। প্রতিমাই বৃহত্তর তাৎপর্য পেয়ে প্রতীকের উৎসারণ ঘটায়। দৃশ্যকলার কাজ সেই প্রতিমা বা প্রতীককে তার আপাত-অর্থের নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বের করে এনে বৃহত্তর তাৎপর্যে প্রতিস্থাপন করা।

পিকাসোর ‘আঁভিনিওর নারীরা’ বা রামকিঙ্করের ভাস্কর্য ‘ধানঝাড়াই’ বা গণেশ পাইনের ছবি ‘দ্য অ্যাসাসিন’ তাদের চিহ্ন-সমবায় বা দৃশ্যপ্রতিমার দৃষ্টিগ্রাহ্য সীমাকে ছাড়িয়ে এক বৃহত্তর আখ্যানের ইঙ্গিত আনে, যে আখ্যানের মধ্যে মানুষের আত্মিক ও সামাজিক সত্য ও বাস্তবতার বৃহত্তর তাৎপর্য আভাসিত থাকে।

Advertisement

সভ্যতা যত অগ্রসর হয়, মানুষের প্রকাশভঙ্গিও প্রযুক্তির সাহচর্যে ও প্রতিক্রিয়ায় তত জটিলতর হয়। চিহ্নের প্রকাশ-ক্ষমতা ও ধারণক্ষমতায়ও তখন রূপান্তর আসে। অনেক সময় তা আমূল পাল্টেও যায়। বাইজান্টাইন শিল্পের রূপাবলি থেকে রেনেসাঁ-শিল্প আলাদা। কিউবিজম আবার তা থেকে সরে গেছে অনেক দূরে।

আজকে আমাদের দেশে যে তরুণ শিল্পীরা কাজ করছেন, তাঁরা বিশ্বায়িত সন্ত্রাস-অধ্যুষিত বিপন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রকাশভঙ্গি নিয়ে নতুন ভাবে ভাবছেন। পরিচিত চিহ্নের ভিতর নতুন তাৎপর্য খুঁজছেন।

এরকমই তিনজন তরুণ-তরুণী শিল্পীর কাজ নিয়ে প্রদর্শনী চলছে স্টুডিও ২১-এ। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘আউটলায়ার্স’। ৯ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী।

তিন শিল্পী ঈশিতা চক্রবর্তী, নীলাঞ্জন দাস ও অনির্বাণ ঘোষ চেষ্টা করেছেন চিহ্নকে তার পরিচিত আখ্যানের অনুষঙ্গ থেকে বের করে এনে আজকের নতুন বাস্তবতায় প্রতিস্থাপিত করতে।

ঈশিতা চক্রবর্তী কাজ করেছেন মূলত বিজ্ঞাপনের চিহ্ন-প্রতীক ভিত্তি করে। বিজ্ঞাপন সব সময়ই সমাজের অন্তর্লীন অভীপ্সাকে উন্মীলিত করে। তার প্রবণতা দিয়েই তাকে নতুনভাবে উদ্দীপিত করতে চায়।

আজকের বাস্তবতায় বিজ্ঞাপনের সমাজতত্ত্ব অনেক জটিল হয়েছে। ঈশিতা সেই জটিলতার ভিতর থেকে সরল, আপাত নিরীহ রূপটিকে বের করে আনেন। তারপর তাকেই তার প্রসঙ্গ বর্হির্ভূতভাবে উপস্থাপন করে ভিন্নতর এক তাৎপর্যে অন্বিত করেন।

খুবই আপাত-সরল ভাষায় কৌতুকদীপ্তভাবে তিনি ছোট ছোট প্রতিমাকল্প তৈরি করেছেন। সেই চিহ্ন-প্রতীক দিয়ে আজকে সময়ের নানা তাৎপর্যের ঈঙ্গিত তুলে এনেছেন। একটি ছাগমুণ্ড স্থাপিত একটি তাকের উপরে। এটুকুই মাত্র দৃশ্য।

কিন্তু এই একটি প্রতীক কি খুব সন্তর্পণে আজকের পশুহত্যা নিবারণী আন্দোলনের উপর এক ঝলক আলো ফেলে না? অথবা একটি মাত্র পেয়াঁজ, জলরঙে আঁকা। আর কিছু নেই। এটাকেই কি তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন আজকের অপ্রয়োজনীয় মূল্যবৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে? এরকমই সহজ চিহ্নে তিনি কিছু গভীর ইঙ্গিত আনতে চেয়েছেন।

নীলাঞ্জন দাস দু’ধরনের সংকেত নিয়ে কাজ করেছেন। প্রথমটির নাম দিয়েছেন ‘যদি...’। এখানে তিনি সুকুমার রায়ের ‘আবোল-তাবোল’-এর প্রতিমাকল্পগুলোকে নিজের মতো করে এঁকেছেন – হাতিমি, হাসজারু, বকচ্ছপ ইত্যাদি।

এই অসম্ভবের কৌতুক দিয়ে আজকের বাস্তবতার নিহিত কল্পরূপকে বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর দ্বিতীয় চিত্রমালার শিরোনাম ‘আমেরিকান সুপারহিরোজ’। অতিনায়করা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের চিন্তাচেতনা ও বাস্তবতা, তারই কিছু দৃষ্টান্ত তিনি তুলে ধরেছেন আলোকচিত্রীয় উপস্থাপনায়।

অনির্বাণ ঘোষ কাজ করেছেন আজকের নিরামিষাশীদের আন্দোলন নিয়ে। তাঁর রচনাগুলির শিরোনাম: ‘ওয়াচ আউট ফর ভেজিটারিয়ান জিলটস’।

একটি পর্যায়ে তিনি এঁকেছেন বোরখা-পরা মানবীদের হাতে ধরা এক একটি সবজি নিয়ে। কখনও বা এঁকেছেন শুধুই একটি লঙ্কা বা আধখানা ক্যাপসিকাম।

তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়টি আলোকচিত্রের। সবজি বাজারের দৃশ্য। দোকানে রয়েছে আলুর স্তূপ। মুখঢাকা এক সন্ত্রাসবাদী স্টেনগান উঁচিয়ে আছে সেদিকে। শাকাহারও হয়ে উঠেছে আজ সন্ত্রাসের কারণ, এমনই এক বাস্তবতা আজ।

আরও পড়ুন
Advertisement