পুস্তক পরিচয় ২

চৈতন্য জীবনের সঙ্গে ফুটে ওঠে সমকাল

প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে বৃন্দাবনদাস লিখেছিলেন ‘অদ্যাপিহ সেই লীলা করেন গৌর রায়।’ (চৈতন্যভাগবত) কথাটি আক্ষরিক অর্থে ধরার দরকার নেই। তবে প্রতি বছরই চৈতন্যকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থ, নাটক দেখা যায়। এখনও চৈতন্য নানা জনের কাছে নানা রূপে প্রতিভাত হন। যেমন তুহিন মুখোপাধ্যায় লোকায়ত শ্রীচৈতন্য (গাঙচিল, ৬৫০.০০) গ্রন্থে চৈতন্যের মহাপ্রভু হয়ে ওঠার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০১

প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে বৃন্দাবনদাস লিখেছিলেন ‘অদ্যাপিহ সেই লীলা করেন গৌর রায়।’ (চৈতন্যভাগবত) কথাটি আক্ষরিক অর্থে ধরার দরকার নেই। তবে প্রতি বছরই চৈতন্যকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থ, নাটক দেখা যায়। এখনও চৈতন্য নানা জনের কাছে নানা রূপে প্রতিভাত হন।

যেমন তুহিন মুখোপাধ্যায় লোকায়ত শ্রীচৈতন্য (গাঙচিল, ৬৫০.০০) গ্রন্থে চৈতন্যের মহাপ্রভু হয়ে ওঠার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মত হল, চৈতন্যকে অবতার রূপে প্রতিষ্ঠা করার পিছনে ছিল সুচিন্তিত এবং জটিল একটি পরিকল্পনা। রূপকারদের মধ্যে ছিলেন মাধবেন্দ্র পুরী, অদ্বৈত আচার্য ও নিত্যানন্দও। নিমাইও সুচিন্তিত ভাবে এমন আচরণ করছিলেন, যাতে তিনি জনচিত্তে অবতার বলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন। লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর সন্ন্যাসও কি ‘কপট’ ছিল? সব ক্ষেত্রেই চরিতকাব্যগুলি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তবে তিনি এ কথাও বলছেন, দিব্যোন্মাদ শ্রীচৈতন্য হয়ে উঠে‌ছিলেন রাধাভাবের চরম দৃষ্টান্ত (পৃ ২৭১)। তবে একটি কথা এখানে ভাবা দরকার। চৈতন্যর জীবনকাল আর তাঁর চরিতকাব্যগুলির রচনাকাল পিঠোপিঠি হলেও দু’টি সময়ের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। চৈতন্য তুলনায় অনেক শান্ত সময়ের লোক। চরিতকারদের উপরে সময়ের এই প্রভাব পড়ে। তা ছাড়া, চরিতকারদের প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যও ছিল। তাঁদের তথ্য সূত্রে মিল যেমন ছিল, তেমন প্রভেদও ছিল।

Advertisement

দেবু গোস্বামী শ্রীচৈতন্যদেব: মানব প্রেমের উৎস সন্ধানে (পুস্তক বিপণি, ২৫০.০০) গ্রন্থে চৈতন্যকে বলেছেন ‘সংস্কৃতির পূর্ণিমা’। ইতিহাসে চৈতন্যদেব, বাঙালির সংস্কৃতি ও চৈতন্যদেব, রবীন্দ্রভাবনায় চৈতন্যদেব, কীর্তন ও গ্রামীণ কৃষ্টি ভাবনা, রাঢ় বাংলার সংস্কৃতি ও চৈতন্যদেব এবং বাংলা সাহিত্য বিকাশে চৈতন্যের অবদান নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘মানবপ্রেমের উৎস সন্ধানে’ আলোচনাটি ভূমিকার মতো। শেষ করেছেন বাংলার গণসংস্কৃতি ও গণ আন্দোলনে চৈতন্যর ভূমিকা বিশ্লেষণে। তাঁর মত, ‘চৈতন্যদেবের মানবতাবাদ, যদিও ধর্মীয়, তার ধারা বেয়েই, ... ঊনবিংশ শতাব্দীর মানবতাবাদ। এই মানবতাবাদ আবার পল্লবায়িত হয়ে বিংশ শতাব্দীতে বাম আন্দোলন বিকশিত হয়’ (পৃ ৩২৫)।

প্রবীর সেনের লেখা বাঙালির চৈতন্যলাভ (পাতাবাহার, ৭৫.০০) চৈতন্যের বিখ্যাত দু’টি চরিতকাব্য চৈতন্যভাগবত ও চৈতন্যচরিতামৃত অনুসরণ করে সংক্ষেপে ও সরল ভাষায় তাঁর জীবনের আলোচনা। তাতে সে কালের জীবনের ছবিও বেশ ফুটে ওঠে। অনেক বিতর্কিত মত অবশ্য তিনি নিঃসংশয়ে মেনে নিয়েছেন। এই বইটির প্রচ্ছদ ‘ভক্তি চৈতন্য চন্দ্রিকা’ থেকে গৃহীত পরিকরদের সঙ্গে চৈতন্যের ত্রৈলোক্যনাথ দেবের কাঠখোদাই চিত্র।

চৈতন্য ঝাড়খণ্ডের পথে বৃন্দাবন গিয়েছিলেন। সুহৃদকুমার ভৌমিকের ঝাড়খণ্ডে মহাপ্রভু (মনফকিরা, ১৬০.০০) এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে উপজাতিদের স্থান, ব্রজবুলির উৎস সন্ধানে ঝাড়খণ্ডের প্রধান কথ্য ভাষা সাদরির গুরুত্ব নির্ণয়, ঝুমুরের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলির সম্পর্ক থেকে শুরু করে দর্শনচর্চার নানা ক্ষেত্রে চৈতন্যের মতের প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে। রয়েছে বিরল কিছু ছবি ও এই এলাকা থেকে সংগৃহীত পদাবলিও। দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীচৈতন্য/ অনন্ত জীবনের অন্বেষণ (কমলিনী, ৩০০.০০) বইয়ে চৈতন্যের জীবনকাল, সে সময়ের রাজনীতি, বাংলার বৈষ্ণব ধারা, সমাজের নানা স্তরে চৈতন্যের প্রভাব ও তাঁকে নিয়ে চর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন লেখক। তাঁর কিছু মন্তব্য মেনে নেওয়া শক্ত। যেমন, চৈতন্যের জন্মকাল নিয়ে আলোচনার সময় লেখক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ‘কবিরাজ গোস্বামী চরিতামৃতের অন্তত আদিলীলা লেখার সময় কর্ণপুর, মুরারি গুপ্ত প্রমুখের বই পড়েননি’ (পৃ ২৭)।

সুকান্ত পাল ও সুব্রত রায়ের সম্পাদনায় নবজাগরণের প্রথম আলো শ্রীচৈতন্য (মিত্রম, ২০০.০০) গ্রন্থে অনিরুদ্ধ রায়ের প্রবন্ধটি চৈতন্য গবেষকদের কাছে মূল্যবান। পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, খড়দহ, কাটোয়া, ফুলিয়ার মতো ছোট ছোট শহর গড়ে উঠতে থাকে। তবে নবদ্বীপ তখন ছিল গঙ্গার পূর্ব পাড়ে। তখন গঙ্গায় নবদ্বীপ পর্যন্ত জোয়ার আসত। জীবনযাত্রার মানেও জোয়ার এসেছিল। সে সময়ে নবদ্বীপে উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা উভয়ই ছিল। নদীর পাড় ঘেঁসে প্রথম সারিতে ছিল সঞ্জয় মুকুন্দ, মুরারি গুপ্তের বাড়ি। দ্বিতীয় সমান্তরাল সারিতে থাকতেন কটক থেকে আসা লোকেরা। এঁদের সঙ্গে একবার বিশ্বম্ভরের গোলমাল হয়। তৃতীয় সারিটিতে থাকতেন শ্রীহট্ট থেকে আসা মানুষেরা। সেখানেই বাড়ি করেছিলেন জগন্নাথ মিশ্র। এই সংকলনে চৈতন্যের সমকালীন নদিয়ার নগর বিকাশ ও নাগরিক জীবন, বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়, উত্তরবঙ্গ ও অসমে বৈষ্ণব আন্দোলনের রূপ, বাংলার যাত্রা ও নাটকে চৈতন্যের অবদান, বাংলার নবজাগরণে তাঁর প্রভাব নিয়ে আলোচনা রয়েছে। শ্রীলা বসুর ‘বাংলার মন্দির ভাস্কর্যে চৈতন্যদেব’ নিবন্ধে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য মেলে। গঙ্গারাম ভাস্করের আঁকা চৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তিটির সঙ্গে তিনি গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের ফ্রেসকোর উল্লেখ করেছেন। এখানে চৈতন্যের ষড়ভুজের একটি হাত রামের সবুজ ও অন্য হাতটি কৃষ্ণের নীল রঙের। উল্লেখ্য, মুরারি গুপ্তের কাছে চৈতন্য রাম-লক্ষ্মণ-সীতা রূপ দেখিয়েছিলেন। ষড়ভুজ রূপ প্রকট করেছিলেন দু’বার। একবার দেখেছিলেন সার্বভৌম আর একবার নিত্যানন্দ।

আরও পড়ুন
Advertisement