পুস্তক পরিচয় ১

ঘরে বাইরে বাঙালি: ‘আত্ম’নির্মাণের আখ্যান

উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখাপড়়ায় ঘর তথা অবস্থান জিনিসটা একটা কেন্দ্রীয় বিষয়। অবস্থান এ ক্ষেত্রে আত্মচেতনা সচেতন ভাবে নির্মিত এক রকম আত্মপ্রকাশ। গত তিন দশকে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে পরিচিতি নির্মাণের চেনা কাঠামোগুলো সাধারণত জাতি, শ্রেণি, ধর্ম অথবা লিঙ্গভেদ সংক্রান্ত প্রাথমিক সূচককে ভিত্তি করে। বিয়িং বেঙ্গলি বইটি সেই দিক দিয়ে নতুনত্বের দাবি রাখে। প্রধানত ভাষার ভিত্তিতে চিহ্নিত একটি মানবগোষ্ঠীর সচেতন আত্মনির্মাণের ভিন্নতর কতগুলি মুহূর্তের অনুসন্ধান এখানে।

Advertisement
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখাপড়়ায় ঘর তথা অবস্থান জিনিসটা একটা কেন্দ্রীয় বিষয়। অবস্থান এ ক্ষেত্রে আত্মচেতনা সচেতন ভাবে নির্মিত এক রকম আত্মপ্রকাশ। গত তিন দশকে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে পরিচিতি নির্মাণের চেনা কাঠামোগুলো সাধারণত জাতি, শ্রেণি, ধর্ম অথবা লিঙ্গভেদ সংক্রান্ত প্রাথমিক সূচককে ভিত্তি করে। বিয়িং বেঙ্গলি বইটি সেই দিক দিয়ে নতুনত্বের দাবি রাখে। প্রধানত ভাষার ভিত্তিতে চিহ্নিত একটি মানবগোষ্ঠীর সচেতন আত্মনির্মাণের ভিন্নতর কতগুলি মুহূর্তের অনুসন্ধান এখানে। বেশির ভাগ রচনাই সমালোচনা-সাহিত্য তথা সংস্কৃতিবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঙালির অন্তর্জগতের নির্মাণ ও বিনির্মাণের পুনর্বিবেচনা।

এ ক্ষেত্রে সময় ও স্থান দুই-ই ভ্রাম্যমাণ। সুতরাং বাঙালি শব্দটি একটি কাল্পনিক ধারণা। বাংলা ভাষায় কথা বলেন, এবং বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিকে নিজের ভাবেন, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এই রকম সমস্ত মানুষের মনোজগৎ এবং সামাজিকতার যে বিভিন্ন কাল্পনিক বুনন, তা-ই এখানে বাঙালিত্ব। এই নির্মাণের একটা প্রধান প্রাক্শর্ত হল শারীরিক দূরত্ব ও ‘অপর’প্রসূত মানসিক উদ্বেগ। পেশার খাতিরে যে বাঙালি বাংলার মাটি থেকে আক্ষরিক অর্থেই অর্ধেক পৃথিবী দূরে তার বাঙালিয়ানা কি খাদ-মেশানো? মুদিয়ালির বাঙালি প্রাইমারি মাস্টারমশাই এবং মন্ট্রিয়লের প্রবাসী বাঙালি চাকুরে ঠিক কোন অর্থে নিজেদের বাঙালি মনে করেন? দুজনের মনে বাঙালিয়ানা কোথায় মেলে, আর কোথায়-ই বা অচেনা লাগে? এমনটাও কিন্তু হতে পারে যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জন্মভূমির এমন অনেক অন্তরঙ্গ হালহকিকত সেই প্রবাসীর নখদর্পণে যা কি না আজীবন বাংলাবাসী বহু মানুষের জানার ইচ্ছে, সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই।

Advertisement

বিশ্বায়িত পৃথিবীতে তথ্য, ধারণা এবং মানুষের প্রায় অবাধ বিচরণের কল্যাণে স্থানকালের গতানুগতিক বাঁধন অনেকটাই ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছে। বিকেন্দ্রীকৃত এই পৃথিবীতে বাঙালি ধারণাটাও কি আর অটল কোনও ভরকেন্দ্রে বেঁধে রাখা সম্ভব? বাংলা ও বাঙালি কি সে ক্ষেত্রে একাধারে গৃহহারা এবং চিরমুক্ত হয়ে গেল? বাঙালি হওয়া অর্থাৎ ‘বিয়িং বেঙ্গলি’-র বিষয়টা সহজাত মনে হলেও তার এই গঠনমূলক জটিলতাগুলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশই এই সংকলনের মূল উদ্দেশ্য। বিশ্লেষণী কাঠামো হিসেবে বাংলা এবং বাঙালি দুই-ই এখানে ‘নির্মিত’ এবং ‘কাল্পনিক’ হলেও তাদের বাস্তবতায় খামতি নেই এতটুকুও, কেবল প্রেক্ষিতটুকু ভিন্নতর।

গত কয়েক দশকে ‘আইডেনটিটি’ বা ‘পরিচিতি’ জিনিসটা আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার জগতে একটা বিশেষ ঘরানার লেখাপড়ার দ্যোতক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি তথা দর্শন এই বৃহত্তর ঘরানারই একটা অঙ্গ। যারপরনাই জটিল এই চিন্তাধারাটির মূল নির্যাস বোধ হয় এই যে মোটের ওপর ‘পশ্চিম’ তথা ‘মেট্রোপলিটান’ই একমাত্র সেই তর্কাতীত অবস্থান যেখান থেকে সর্বোত্কৃষ্ট, সর্বগ্রাহ্য এবং সর্বস্বীকৃত মতামত তথা জ্ঞান উত্পাদন সম্ভব, এই মতবাদকে চ্যালেঞ্জ জানানো। মনে রাখতে হবে যে ‘পশ্চিম’ মানে লেখাপড়া বা জ্ঞান চর্চার রাজনীতি প্রসঙ্গে আপেক্ষিক ‘অগ্রসরতা’ বিষয়ে একটা বিশেষ ধারণা। মোটের ওপর পশ্চিম মানে হল প্রশ্নাতীত অগ্রসরতা। পুবের বাসিন্দা অনেক মানুষই এ ক্ষেত্রে ‘পশ্চিমি’ সেনানায়ক হতে পারেন, আবার পশ্চিমের অনেকেই পূর্বিয়া সৈনিক।

আলোচ্য রচনাগুলির প্রতিটিই কোনও না কোনও ভাবে আধুনিকতার সঙ্গে বাঙালির কথোপকথনের আখ্যান। আধুনিকতা এখানে একটি ধারণা। সেই ধারণার মূল ভিত্তি হল অতীতের সঙ্গে একটা মৌলিক বিচ্ছেদের মুহূর্ত। মুহূর্ত এ ক্ষেত্রে একফালি সময়মাত্র নয়, বরং একটা ঘটনা। আধুনিকতার সঙ্গে বৃহত্তর বাঙালিসত্তার কথোপকথনের এক একটি উদাহরণ হিসেবে পাঠ করে বাঙালির সামাজিক আত্মনির্মাণের একটি বহুমুখী ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আগাগোড়া অপরিচিত এবং অপ্রত্যাশিত একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মুখোমুখি হলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেমন করে একটা সামাজিক-মানসিক ‘বাঙালি’ সত্তা নির্মিত হয় এবং বাংলার মূল ভূখণ্ডের ভিতরের এবং বাইরের বাঙালির জনজীবনে তারা কী ভাবে ছাপ রাখে তারই মানচিত্র রচনাগুলিতে।

মোটামুটি চার ধরনের রচনা। বিজয় মিশ্র এবং শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ধর্ম এবং জাত বিষয়ে। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং পৌলমী চক্রবর্তী লিখেছেন বাঙালি মহিলাদের সামাজিক রূপবদল বিষয়ে। ফকরুল আলম, সাদিয়া তুর এবং আলি রিয়াজের লেখার বিষয়বস্তু হল স্থানবিশেষে বাংলাভাষী মানুষের ভিন্নতর আত্মগঠনের জটিল গতিপ্রকৃতি। রণবীর সমাদ্দারের লেখাটির বিষয় হল বাঙালি আত্ম-নির্মাণের কিছু অসঙ্গতি এবং অনুপস্থিতি।

বিজয় মিশ্র, পৌলমী চক্রবর্তী এবং শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যথাক্রমে বিবেকানন্দ, সত্যজিৎ রায় ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। বিজয় মিশ্রর তাত্ত্বিক লেখায় বিবেকানন্দর চিন্তায় কী ভাবে আনুষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্ম এবং রোমান্টিক সাহিত্য, বিশেষত ওয়ার্ডসওয়ার্থের লেখার সঙ্গে ঔপনিষদীয় হিন্দুধর্মের সতত কথোপকথনে এক নতুন হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যান উঠে এল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ একটা আখ্যান। রামকৃষ্ণের ‘নিরাসক্ত’ হিন্দুধর্মকে বিবেকানন্দ কী ভাবে ‘জনকল্যাণমূলক’ একটি ‘মিশন’-এ অনুবাদ করলেন তার দার্শনিক অনুসন্ধান বেশ ভাবায়। পৌলমী চক্রবর্তীর বয়ানে সত্যজিতের ‘মহানগর’ পাঠ আর এক রূপান্তরের আখ্যান। পৌলমী দেখাচ্ছেন কী ভাবে সত্যজিৎ নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি মহিলাদের নিয়ন্ত্রিত বহির্গমনের একটা প্রতীকী উপস্থাপনা রেখেছেন। শুভজিতের বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথের লেখায় পুনর্গঠিত বাঙালি মহিলার মানসজগৎ। এ ক্ষেত্রে গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে বিবাহ-অতিরিক্ত তথা প্রণয়ের একটি ধারণা যেখানে অতীত-ভবিষ্যতের চিরাচরিত সম্পর্ক এক সময়াতীত প্রণয়ের প্রতিশ্রুতিতে বর্তমান। বিষয়টা কেবল মানুষ বা লেখক রবীন্দ্রনাথ নন, এই বিশেষ প্রণয়ের প্রতীকী প্রতিনিধি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের একরকম অতি-শরীরী উপস্থিতির কথাও চলে আসে। এই প্রসঙ্গে আসে ন হন্যতে উপন্যাসে রবীন্দ্র-চরিত্রের সময়াতীত উপস্থিতির উল্লেখ। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুদীর্ঘ রচনার বিষয় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক চিন্তাধারা। উনি দেখান, ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রীশিক্ষাবিষয়ক উদ্যোগগুলি আদতে পরিস্থিতির চাপে বাঙালি পুরুষতন্ত্রেরই খানিকটা স্ব-সংশোধন। কয়েকটি উদাহরণ বাদে মেয়েদের সক্রিয় ভূমিকা, অর্থাৎ আত্মনির্মাণের অবকাশ কাঠামোগত ভাবে নির্দিষ্ট।

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় এসেছে বাঙালির ‘জাতে’ ওঠার জটিলতা। উনি লিখছেন যে মোটের ওপর বাঙালির আধুনিকতা স্ববিরোধে ভরা। একই মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই কখনও কমিউনিস্ট এবং কখনও আচারসর্বস্ব হিন্দু হয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারেন। এই সংঘাতগুলোকে অমীমাংসিত রেখে দেওয়াই বাঙালির অসম্পূর্ণ আধুনিকতার একটা লক্ষণবিশেষ। খানিকটা একই রকম কথা ভেবেছেন রণবীর সমাদ্দার। বাঙালির অস্পষ্ট আধুনিকতার কথা প্রসঙ্গে উনি এসথেটিক আর পলিটিকাল এই দুটি স্বতন্ত্র চিন্তাকাঠামোর নির্বিচার এবং নিরন্তর মিলমিশের সমস্যাপ্রসূত বিভিন্ন সংকটের উদাহরণ দিয়েছেন।

আলি রিয়াজ ও নয়নিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখায় প্রবাসী বাঙালিদের অভ্যন্তরীণ বিভেদের প্রসঙ্গে ইতিহাস, ধর্ম এবং শ্রেিণবিভাগের মিলিত জটিলতাগুলির ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। ফকরুল আলমের কলমে উঠে এসেছে বাংলাদেশের পরিচিতি-বিন্যাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকী ভূমিকা। দেখা যাচ্ছে একেবারে গোড়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রনির্মাণে বাঙালি এবং মুসলিম এই দ্বিমুখী প্রভাবের টানাপড়েন চলেছে প্রতিনিয়ত। কখনও একটি প্রবণতা খানিক জোরালো হয়েছে তো কখনও অন্যটি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে এই টানাপড়েনের ছবিটা আবারও পরিষ্কার হয়।

সংকলনটি বহুমুখী। বাঙালি কে এবং কে নয় তার কোনও চটজলদি উত্তর এখানে পাওয়া যাবে না। বাঙালির মানসজীবনের কয়েকটি বাঁক এবং তার আত্ম-চিন্তার বহুমুখী প্রেক্ষিত এবং ধারাগুলি নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা অবশ্যই পাওয়া যাবে। আশার কথা হল এই জাতীয় সংকলনে কী নেই তার খোঁজে আরও অনেক সংকলন জন্ম নিতে পারে। তবে কি না যে অর্থে এই সংকলনে বাংলা ও বাঙালি কথাগুলি ব্যবহৃত হয়েছে এবং যে পর্যায়ের তাত্ত্বিক জটিলতায় রচনাগুলি সমৃদ্ধ, সেটা গবেষকগোষ্ঠীর বাইরে কতখানি পৌঁছবে সেই বিষয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। সম্পাদক এই বিষয়ে সচেতন। তিনি লিখেছেন যে এই বইটির সূত্রপাত আসলে তিন প্রবাসীর এক আলাপচারিতায়। কথাটা ভাবার মতো। যদি মাঝে মাঝে ভাবতে শুরু করি আমরা ঠিক কেন বাঙালি, এবং ভাষা ছাড়া আর কী কী আমাদের বাঁধে কিংবা আলাদা করে, তা হলেই বোধ হয় বইটির উদ্দেশ্য সাধিত হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement