চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

কল্পরূপের ছায়ায় উন্মোচিত বাস্তবের তমসা

আকৃতি গ্যালারিতে চলছে বিকাশ ভট্টাচার্যের একক। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষসময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর দায়বোধের চরিত্র পাল্টায়। ব্যক্তি প্রতিভার সঙ্গেও দায়বোধের একটা সম্পর্ক থাকে। রবি বর্মার দায়বোধ আর অবনীন্দ্রনাথের দায়বোধ এক নয়। তেমনই অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে নন্দলালের দায়বোধের পার্থক্যও অনেকটা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০১

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর দায়বোধের চরিত্র পাল্টায়। ব্যক্তি প্রতিভার সঙ্গেও দায়বোধের একটা সম্পর্ক থাকে। রবি বর্মার দায়বোধ আর অবনীন্দ্রনাথের দায়বোধ এক নয়। তেমনই অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে নন্দলালের দায়বোধের পার্থক্যও অনেকটা। ১৯৬০-এর দশকে এই বাংলায় সব শিল্পীর কাছেই সময়ের বাতাবরণ প্রায় একই রকম ছিল। তবু গণেশ পাইন বা বিকাশ ভট্টাচার্যের প্রকাশভঙ্গিতে কী বিপুল পার্থক্য! ব্যক্তি প্রতিভার ভিন্নতার পাশাপাশি শিল্পীর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান এবং ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নটিও আসে।

বিকাশ ভট্টাচার্যের (১৯৪০-২০০৬) প্রথম পর্বের কিছু ড্রয়িং ভিত্তিক ছবি নিয়ে সম্প্রতি প্রদর্শনীটি চলছে আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে। শিরোনাম ‘হিউম্যান ফেস অ্যান্ড আরবান স্পেস’। কিছু নিসর্গ, কিছু মানুষের মুখ, অবয়ব আর নগ্নিকার অনুশীলনমূলক ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। ছবিগুলি ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকের রচনা। শিল্পী তখনও ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের ছাত্র। কিছু হয়তো ওই দশকেরই আর একটু পরের রচনা। ছবিগুলি এসেছে শিল্পীর পারিবারিক সংগ্রহ থেকে।

Advertisement

এই ছবিগুলিতে অবশ্য শিল্পীর পরিণত পর্বের দায়বোধের পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু কোন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে সেই দায়বোধ তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ১৯৭০-এর দশক থেকে তাঁর শিল্পী ব্যক্তিত্বের যে আলোকিত উদ্ভাস, তাঁর মূলে রয়েছে ষাটের দশকের গোড়ায় তাঁর অনুশীলনের এই ধরন।

ষাটের দশকের প্রধান শিল্পী যাঁরা, চিত্রকলায় ভারতীয় আত্মপরিচয়ের দৃঢ় ভিত্তি রচিত হয়েছিল যাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে, তাঁদের অনেকেই দৃঢ় এক সামাজিক দায়বোধ ও কালচেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন।

কিন্তু সেই দায়বোধের প্রকাশ এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম ছিল। গণেশ পাইনের কথা উঠেছিল প্রসঙ্গক্রমে। তাঁর প্রকাশভঙ্গির দিকে তাকালে দেখি, বিকাশের সঙ্গে তাঁর বিপুল ব্যবধান। এই পার্থক্যের মূল নিহিত আছে আমাদের আধুনিকতা বিকাশের দুটি ভিন্ন পথ ও আঙ্গিক প্রস্থানের উপর।

প্রস্তুতি পর্বে বিকাশ তাঁর অনুশীলনকে দৃঢ় করেছিলেন ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার তন্নিষ্ঠ চর্চার উপর। সামাজিক পরিস্থিতিও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। অন্য দিকে গণেশের অন্তর্মুখীনতা ছিল সুদূর সঞ্চারী, মগ্নচেতনা ও দূরতর পুরাণকল্পের জগতে সম্পৃক্ত। সেই কল্পিত অতীতের মূল্যবোধ দিয়ে তিনি বর্তমানকে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর দায়বোধ ছিল অবনীন্দ্রনাথ ও নব্য-ভারতীয় ঘরানার মূল্যবোধে সংবদ্ধ।

বিকাশ বাস্তবকে কল্পরূপায়িত করেছেন স্বাভাবিকতাবাদের দৃঢ় ভিত্তির উপর। রূপ কখনও স্বাভাবিকতায় স্থিত থেকে কল্পরূপের দিকে গেছে। কখনও বিশ্লিষ্ট হয়ে সুররিয়ালিজমের পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবের তমসা বা গহন শূন্যতাকে উন্মীলিত করা।

বিকাশের ১৯৬৮-র ‘অ্যান্ড থ্রি হ্যান্ডস’ বা ‘গোল্ডেন মাস্কড ফ্যামিলি’, ১৯৬৯-এর ‘কাউন্ট’ ও ‘কাউন্টেস’ – এসব ছবিতে রয়েছে তাঁর নিজস্ব তত্ত্ববিশ্বের পরিচয়।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭২-এর মধ্যে কলকাতা যখন নকশালবাড়ি আন্দোলনে উত্তাল, তখন রচিত হল তাঁর ‘ডল সিরিজে’র ছবিগুলি। এই যেমন সমাজবাস্তবতার এক দিক, তেমনি নারীর আত্মপরিচয়গত আর এক সংকটের উন্মোচন ঘটল ১৯৯০-এ তাঁর ‘দুর্গা’ চিত্রমালায়।

এইভাবে তিনি অস্তিত্বের সংকটকে নানাভাবে রূপায়িত করেছেন।

এরই প্রস্তুতি পর্বে ছিল তাঁর যে অনুশীলন, তারই কিছু দৃষ্টান্ত দেখি আমরা এই প্রদর্শনীতে। প্যাস্টেল, পেনসিল ও জলরঙে আঁকা ছবিগুলি।

তাঁর ঋজু রেখার সংহত শক্তি, বিভিন্ন বর্ণের ছায়াতপের পারস্পরিক সহাবস্থানে বাস্তবতার ভিতর মগ্নতার প্রতিফলন। জলরঙে আঁকা বেশ কয়েকটি নাগরিক ও নগর-প্রান্তিক নিসর্গচিত্র রয়েছে এই প্রদর্শনীতে।

সেখানে তিনি ব্রিটিশ ঘরানার জলরঙের প্রকরণকে ছাড়িয়ে প্রতিচ্ছায়াবাদী প্রয়োগের দিকে যেতে চেষ্টা করছেন, যেটা তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে তাঁর বন্ধু-প্রতিম শিক্ষক অরুণ বসুর কাছে আয়ত্ত করেছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement