পুস্তক পরিচয় ১

কবির নীরবতাকে তিনি সম্মান করেছেন

সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের শহিদ অভিজিৎ রায়। মৃত্যুর ক’দিন আগে তাঁর লেখা এই বইটি প্রকাশ পায়। অবশ্য এটির বিষয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতা নয়। এর বিষয় প্রায় একশো বছর আগের একটি বিশেষ চিত্তাকর্ষক মুহূর্ত, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আর্জেন্টিনার সাহিত্যপ্রেমী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা হয়েছিল।

Advertisement
মালবিকা ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০০:০১

সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের শহিদ অভিজিৎ রায়। মৃত্যুর ক’দিন আগে তাঁর লেখা এই বইটি প্রকাশ পায়। অবশ্য এটির বিষয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতা নয়। এর বিষয় প্রায় একশো বছর আগের একটি বিশেষ চিত্তাকর্ষক মুহূর্ত, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আর্জেন্টিনার সাহিত্যপ্রেমী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা হয়েছিল।

বইটির প্রথম কয়েক পৃষ্ঠাতেই অভিজিৎ রায় লিখেছেন, তিনি আর্জেন্টিনা গিয়েছিলেন ভ্রমণকারী হিসেবে। তখন তিনি বুয়েনোস আইরেস-এর নিকটবর্তী সান ইসিদরো নামক একটি ছোট শহরে উপস্থিত হন, সেখানেই রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে অতিথি রূপে প্রায় দুই মাস ছিলেন, ১৯২৪ সালে। অভিজিতের আগ্রহ জন্মায়, আরও অনেক বাঙালির মতো, রবীন্দ্রনাথের এই বিদেশিনী বান্ধবী সম্বন্ধে। সেই আগ্রহের তাড়নায় অভিজিৎ অন্বেষণ করেন এবং পড়তে শুরু করেন যাবতীয় লেখা যা পেয়েছিলেন কবি ও বিদেশিনী সম্বন্ধে। সেই অন্বেষণের ফসল সংগৃহীত হয়েছে আলোচ্য বইটিতে।

Advertisement

বর্তমান গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হল মূল কাহিনির হৃদয়গ্রাহী পরিবেশন। সাল ১৯২৪। পেরুর সরকার স্বাধীনতা লাভের শতবার্ষিকী উপলক্ষে বিরাট উৎসবের আয়োজন করেছে। প্রধান অতিথি ভারতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বার্ধক্যের প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে দক্ষিণ আমেরিকার উদ্দেশে সমুদ্রযাত্রা করলেন, মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবে আর্জেন্টিনা পৌঁছেছেন, তারপর আনডেস্ পর্বতমালা অতিক্রম করে সুদূর লিমা নগরীতে যেতে হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সেই যাত্রা নিরাপদ নয়, এই বিব্রত অবস্থায় কবির এক অনুরাগিনী, আর্জেন্টিনার অভিজাত বিত্তশালী মহিলা, কবিকে নিমন্ত্রণ করলেন। কবির সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্ট, যিনি শ্রীনিকেতনের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তিনিও শ্রীমতী ওকাম্পোর অতিথি। এই ভাবে দৈবাৎ, নিতান্ত ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার পরিচয় ঘটেছিল।

যেখানে ভিক্টোরিয়া অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেখানে গিয়ে অভিজিৎ রায় অনেক আলোকচিত্র নিয়েছেন এবং স্থানীয় সংগ্রহশালা থেকেও অনুরূপ ছবি এ বইতে তুলে ধরেছেন। কবির বাসগৃহ ছিল সান ইসিদরো শহরে ওকাম্পো পরিবারের পুরুষানুক্রমিক বাসস্থানের নিকটে ‘মিরালরিও’ নামে একটা বাড়িতে। এই বাড়ি রিও দে প্লাতা নদীর ধারে, তাই বাড়ির নাম ‘নদী-দর্শন’। সপ্তাহখানেক আর্জেন্টিনায় থাকবেন কবি স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য— এই প্রথমে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেই এক সপ্তাহ ডাক্তারদের নির্দেশে ক্রমে দুই মাস হয়ে দাঁড়ায়। রিও প্লাতার তীরে বিশ্রামাবাসের বারান্দায় আরাম কেদারায় কবি আনন্দে ছিলেন এবং এই সময়ে তিনি অনেকগুলি কবিতা রচনা করেন, যেন নতুন এক আনন্দে। পূরবী কাব্যগ্রন্থের এই সূচনা, অনুপ্রেরণা ‘বিজয়া’ অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া।

২৯ অক্টোবর ১৯২৫, রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে: ‘আমার বাংলা কবিতার বই একটি পাঠালাম, নিজে তোমার হাতে দিতে পারলে ভাল হত। এই বই উৎসর্গ করেছি তোমাকেই, যদিও তুমি কোনও দিন জানবে না কি এতে আছে। অনেক কবিতা এই বইতে আছে যেগুলি সান ইসিদরোতে যখন ছিলাম তখন লেখা। আমার পাঠকেরা কোনও দিন জানবে না কে বিজয়া, কবিতাগুলির সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কি? আমার আশা এই যে তোমার সঙ্গ যতটুকু এই বইটির লেখক পেয়েছিল, তার চাইতে বেশি দিন থাকবে তোমার সঙ্গে এই বইটি।’ ইংরেজিতে লেখা এই সুন্দর চিঠির অনুবাদ করলাম দ্বিধার সঙ্গে। প্রসঙ্গত, অভিজিৎ রায় কৃত অনুবাদে শেষ ছত্রটিতে একটু ভুল রয়ে গেছে। তবু তার দেওয়া রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর দীর্ঘ পত্রালাপের অনুবাদ বাঙালি পাঠকের পক্ষে একটি আকর্ষণীয় প্রাপ্তি। উল্লিখিত চিঠি লেখার কয়েক মাস আগে ২ অগস্ট কবি একই কথা লিখেছিলেন, এই কবিতাগুচ্ছ যাদের হাতে দিলাম, তাদের কয়জনই বা জানবে কবিতা রচনায় তোমার দান।

শিশু ভোলানাথ কবিতা সংগ্রহের দীর্ঘ পাঁচ বৎসর পরে বহু প্রত্যাশিত পূরবী গ্রন্থের সংস্করণে দক্ষিণ আমেরিকা বাস এবং সেই পথে যাত্রার সময়ে লেখা কবিতাগুলি ‘পথিক’ শীর্ষক একটি অংশে একত্রিত ছিল। কেবল কবিতা রচনা নয়, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে আর এক নতুন উদ্যম এনেছিল এই সান ইসিদরোর অবসর, অনুপ্রেরণা। কবি তাঁর পাণ্ডুলিপিতে নানা রেখার দ্বারা সংশোধন ও সংযোজনকে চিহ্নিত করতেন। অভিজিৎ তাঁর তৃতীয় পরিচ্ছেদে বলছেন যে, ভিক্টোরিয়া চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেন ওই সব পাণ্ডুলিপি দেখে। পাণ্ডুলিপিতে অসমাপ্ত চিত্র বা আঁকিবুকি দেখার পর ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন সেগুলিকে আরও বড় আকারে ক্যানভাসে চিত্রিত করতে। এর পর রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রবাহ শুরু হয়। ছয় বছর পর রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শনী হয় প্যারিস শহরে, ইউরোপে তাঁর প্রথম প্রদর্শনী। সেই উদ্যোগের মূলে ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্র-গবেষক কেতকী কুশারী ডাইসন-এর অভিমত। তারই অনুসরণে অভিজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথ অঙ্কিত ছবিগুলির মধ্যে একাধিক ছবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতিকৃতি বলে সাব্যস্ত করেছেন। এর মধ্যে ডার্টিংটন হল এবং রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত দু’টি ছবি অভিজিৎ এই বইতে দিয়েছেন, সাদৃশ্য সত্যিই আছে। বিজয়া কেবল কবিতায় নয়, রবীন্দ্রচিত্রেও উপস্থিত।

অভিজিৎ ‘রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা এবং ওকাম্পোর প্রভাব’ শীর্ষক এক পরিচ্ছেদে একটি মত প্রকাশ করেছেন, যার যাথার্থ্য বিতর্ক-সাপেক্ষ। ‘রবীন্দ্র-জীবনের আরেকটি জায়গায় ওকাম্পোর অবদানের খোঁজ পাওয়া যায়। খুব প্রচ্ছন্ন-ভাবে হলেও। সেটি হলো রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার ক্রমিক উন্নয়নে।’ এই একটি সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া শক্ত, প্রমাণাভাবে। সন্দেহ নেই যে ওকাম্পো নারীমুক্তি আন্দোলনের এক জন মুখ্য প্রবক্তা ছিলেন, বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনীয়ভাষী দেশগুলিতে তার প্রভাব দেখা যায়। অভিজিৎ সেই বিষয়ে আলোচনা করে এবং ওকাম্পোর লেখা ‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ (১৯৩৬) শীর্ষক প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ উপহার দিয়ে ওকাম্পো সংক্রান্ত বাংলা আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু ১৯২৪ সালে, অথবা তার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯৪০ পর্যন্ত পত্রাবলিতে, অভিজিৎ যে প্রভাবের কথা বলেছেন, তার সমর্থনে কোনও তথ্যপ্রমাণ, অথবা অনুমানের ভিত্তি দেখা যায় না। হয়তো এই অভাব বিষয়ে অভিজিৎ সচেতন ছিলেন, তাই বলেছেন প্রভাব ‘প্রচ্ছন্ন’। আমাদের মনে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে রবীন্দ্রনাথের নিষ্ক্রমণ হয়তো একটি আলাদা ইতিহাস।

যদিও বা আমরা মেনে নিই যে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার বিকাশ বা নারী-ভাবনার প্রগতিতে ওকাম্পোর প্রভাব দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে সেই সিদ্ধান্ত কতটা গুরুত্ব পাবে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্বন্ধের ইতিকথায়? রবীন্দ্রনাথের মনোজগতে তাঁর বিজয়ার উপস্থিতি প্রভাবের হিসেবের বাইরে, কার্যকারণের অনুমানের অতীত, অন্তরের অন্তঃস্থলে। সে বিষয়ে অনেক সময়ে কবির নীরবতা লক্ষণীয় এবং এই নীরবতাকে সম্মান করা কর্তব্য। অভিজিৎ রায় এই কথা মনে রেখেই বইটি লিখেছেন, নানা কাল্পনিক গল্প সৃষ্টি করেননি, এই জন্য প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য।

অভিজিৎ রায়ের এই প্রচেষ্টায় একটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তিনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে (ব্রাজিল বাদে) প্রচলিত স্পেনীয় ভাষা জানতেন না। ফলে অদম্য উৎসাহ সত্ত্বেও ওকাম্পোর স্মৃতিকথা, টেসটিমোনিওস তিনি পড়তে পারেননি। ভিক্টোরিয়ার লেখা টাগোরে এন লাস্ বারানকাস দে সান ইসিদরো (ফনডাসিওন সুর, বুয়েনোস আইরেস, ১৯৬১) বইটিও অভিজিতের নাগালের বাইরে ছিল।

স্পেনীয় ভাষায় লিখিত আকর গ্রন্থ ব্যবহার না করতে পারলেও অভিজিৎ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় যাবতীয় প্রাসঙ্গিক বই পড়েছিলেন, অনুবাদ যা পাওয়া যায় ব্যবহার করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য ডোরিস মেয়র-এর বিশাল গ্রন্থ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এগেনস্ট দি উইন্ড অ্যান্ড দ্য টাইড (১৯৭৯) এবং কেতকী কুশারী ডাইসন-এর ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন (১৯৮৮)। তা ছাড়া, বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ বই ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ লিখিত। এই সবই অভিজিৎ রায় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ইংরেজি একটি বই তাঁর নজরে পড়েনি বোধহয়, এটি আর্জেন্টিনার ভারতীয় দূতাবাস এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেনীয় ভাষা বিভাগ দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল: ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: অ্যান একসারসাইজ ইন ইন্দো-আর্জেন্টাইন রিলেশনশিপ (১৯৯২)। এই বইতে ওকাম্পোর কয়েক দশকের সচিব ও সহকারী ডঃ মারিয়া রেনে কুরা লিখেছিলেন অতি মূল্যবান নিবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া সম্পর্কে। অভিজিৎ রায় তাঁর গবেষণার পরিসর আরও বাড়াতে পারতেন, অকাল মৃত্যুতে সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে ভেবে দুঃখ হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেনীয় ভাষার শিক্ষক

আরও পড়ুন
Advertisement