পুস্তক পরিচয় ২

‘কাজের মধ্যে তিনি হৃদয় দিয়েছেন’

উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে নিশ্চয়ই সে সময়টা উঠে এসেছে, তবে আরও বেশি উঠে এসেছে তাঁর পত্রাবলিতে। প্রিয়নাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী-তে (পত্রপরিচিতি ও টীকা: জ্যোতির্ময় সেন। অলকানন্দা পাবলিশার্স, ২০০.০০) তাই সমকাল ও পরবর্তী কালের বহু ঘটনা সমাজ-সম্পৃক্ত মহর্ষির জীবনটাকে অনেকটাই উন্মোচিত করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১

উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে নিশ্চয়ই সে সময়টা উঠে এসেছে, তবে আরও বেশি উঠে এসেছে তাঁর পত্রাবলিতে। প্রিয়নাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী-তে (পত্রপরিচিতি ও টীকা: জ্যোতির্ময় সেন। অলকানন্দা পাবলিশার্স, ২০০.০০) তাই সমকাল ও পরবর্তী কালের বহু ঘটনা সমাজ-সম্পৃক্ত মহর্ষির জীবনটাকে অনেকটাই উন্মোচিত করে। ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট মানুষজনকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে তাঁদের নীতি, কর্মধারা, সামাজিক অবস্থানের একটা চেহারা উঠে আসে। বন্ধু সুহৃদ নিকটজনদের এই চিঠিগুলি লেখা হয়েছিল কলকাতা, শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, অমৃতসর, সিমলা, বা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে। এই পত্রাদি সংগ্রহ করে একদা প্রকাশ (১৯০৯) করেন মহর্ষির পার্ষদ প্রিয়নাথ শাস্ত্রী। বর্তমান সংস্করণে টীকাসহ পত্র-পরিচিতি সংযোজিত।

‘বিদ্যাবুদ্ধির সম্বল অনেকেরই থাকে, সাহিত্যে বিজ্ঞানে কীর্তিলাভ করতেও পারেন অনেকে, কিন্তু জগদানন্দের সেই দুর্লভ গুণ ছিল যার প্রেরণায় কাজের মধ্যে তিনি হৃদয় দিয়েছেন। তাঁর কাজ আনন্দের কাজ ছিল, শুধুই কেবল কর্তব্যের নয়। তার প্রধান কারণ, তাঁর হৃদয় ছিল সরস, তিনি ভালোবাসতে পারতেন।’— রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন জগদানন্দ রায় (১৮৬৯-১৯৩৭) সম্পর্কে। সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে পরিচয়, পরে আশ্রমের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের শিক্ষকও হন। সম্প্রতি সুবিমল মিশ্রের সম্পাদনায় প্রকাশ পেল শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়: জগদানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ (পরি: দে বুক, দে’জ, ৩৫০.০০)। তাঁকে লেখা কবির চিঠিপত্রের সঙ্গে আছে তাঁর লেখালেখি সংক্রান্ত তথ্য, তাঁর গ্রন্থ ও রচনাপঞ্জি, রচিত বইপত্রের ভূমিকা। আছে তাঁকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী নন্দলাল বসু প্রমুখের রচনাদিও। আর আছে তাঁর নিজের স্মৃতি, তাতে জগদানন্দ লিখছেন: ‘একবার আমাদের মধ্যে স্থির হইল, সাধারণ বাক্যালাপে ইংরাজি শব্দ একেবারে ব্যবহার করা হইবে না; ব্যবহার করিলে প্রত্যেক শব্দের জন্য এক পয়সা করিয়া জরিমানা দিতে হইবে। গুরুদেবও এই খেলায় যোগ দিয়াছিলেন। তাঁহাকে কিন্তু জরিমানা দিতে হয় নাই।’

Advertisement

বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্র থেকে রতনকুমার নন্দী ও পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বেরল বঙ্কিম অভিধান (প্রবন্ধ খণ্ড। ২৫০.০০)। অভিধানের প্রথম খণ্ডে ছিল উপন্যাস। বঙ্কিম-ভবন-এর অধ্যক্ষ পিনাকেশচন্দ্র সরকারের মতে ‘বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ রচনার বিষয়গত বৈচিত্র্যের কথা মনে রেখেই বর্তমান খণ্ডের পরিকল্পনা।’ বঙ্কিমচন্দ্রের জ্ঞানরাজ্যের অতলস্পর্শী গভীরতা উপন্যাসসমূহের মতো তাঁর লেখা বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধাদিতেও। পড়তে-পড়তে মনে হতেই পারে সেগুলি সটীক হলে ভাল হত। সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করেছেন সম্পাদকদ্বয়, তাঁরা জানিয়েছেন ‘অভিধানে শব্দ-সংকলন (এন্ট্রি) হিসাবে ব্যক্তিনাম, স্থাননাম, ঐতিহাসিক চরিত্র, গ্রন্থনাম, পৌরাণিক চরিত্র, পৌরাণিক প্রসঙ্গ, বিশেষ ঘটনা, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা জ্যোতিষ সম্পর্কিত বিষয় যেমন এসেছে, তেমনই চয়ন করা হয়েছে বর্তমানে অপ্রচলিত বেশ কিছু শব্দ। আর এর পাশাপাশি এসেছে অজস্র সংস্কৃত শব্দ ও শ্লোক।’

নতুন করে প্রকাশ পেল শ্যামলী চক্রবর্তীর বঙ্কিমচন্দ্রের শিল্প ও সঙ্গীতের জগৎ (অক্ষর, ২৫০.০০)। সূচনা-য় নিজের কাজের হদিশ দিয়েছেন শ্যামলী: ‘বঙ্কিমের উপন্যাসের অনেক ঘটনা ও চরিত্রের পুনর্মূল্যায়ন হয়েছে অবশ্যম্ভাবী। উপন্যাসে ব্যবহৃত শিল্পবিষয় শিল্পপ্রসঙ্গ গান ও গানের প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা বিচার বিশ্লেষণের আলোয় বঙ্কিম ও তাঁর সৃষ্টির জগৎ নতুন রূপে ও তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়েছে।’ আর মুখপাত-এ সুধীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন ‘বঙ্কিমচন্দ্রের সংগীতের জগৎ তাঁর সারস্বত সাধনারই অন্তর্গত ছিল।... একজন গীতিকার একটি মাত্র গান রচনা করে স্পর্শ করে গেলেন চরম সংগীতের গভীরতা এবং হয়ে থাকলেন এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব এমন সংঘটন আগে দেখা যায়নি।’

অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বড়োদাদামশায়’ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছিলেন দেশ পত্রিকায়। সেটি গগনেন্দ্রনাথ নামে বই হয়ে প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৩-এ। সে বইয়ের ভূমিকা-য় সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘কিউবিজম্কে তার নক্শা সর্বস্ব আড়ষ্টতা থেকে উদ্ধার করে গগনেন্দ্রনাথ তাকে ভাব-ধর্মী ও আবেগ-ধর্মী করে তুললেন।’ বইটি পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় দে’জ (১৫০.০০) থেকে পুনরায় প্রকাশ পেল। যোগ হয়েছে গগনেন্দ্রনাথকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, প্রাসঙ্গিক তথ্য; রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের মাধুর্যময় সম্পর্কের বিবরণ; গগনেন্দ্রনাথের গ্রন্থ ও চিত্রপঞ্জি, বংশলতিকা; সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়; সঙ্গে মোহনলাল ও তাঁর রচনা সম্পর্কিত তথ্যাদি-আলোচনা।

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত: ইতিহাসবোধ ও রাষ্ট্রচিন্তা-র (অনুষ্টুপ, ১৫০.০০) নতুন পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ পেল। এই সংস্করণটির ভূমিকা-য় লেখক জানিয়েছেন ‘যোগ হয়েছে অনেক... প্রাক্তন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের মহাফেজখানা গবেষকদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তথা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ সম্পর্কে অনেক দলিলপত্র এর ফলে পাওয়া গেল।’ ভূপেন্দ্রনাথের (১৮৮০-১৯৬১) জীবনী নয়, তাঁর সমকালে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে ও রাজনৈতিক চিন্তাজগতে তাঁর অবদান নিয়েই লিখেছেন রামকৃষ্ণ। তাঁর মতে, দু’টি বড় কৃতিত্বের দাবিদার ভূপেন্দ্রনাথ—

এক, এ দেশের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে তিনিই প্রথম শ্রেণিসংগ্রাম ও সমাজবাদের কথা তোলেন।

দুই, প্রাচীন ভারতের সামাজিক ইতিহাস আলোচনায় তিনিই প্রথম মার্কসবাদ প্রয়োগ করেন।

আরও পড়ুন
Advertisement