বিজ্ঞাপনের জগতে বা বাণিজ্যিক কলার অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছিল ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে। জাতীয়তাবোধ, ঐতিহ্যগত আঙ্গিকের উজ্জীবন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রূপবোধের সমন্বয়চেতনা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলির চর্চা ছিল এই পরিবর্তনের মূলে। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এই ধারাটা অব্যাহত ছিল। তখনও গ্রাফিক আর্ট ততটা কম্পিউটার নির্ভর হয়ে যায়নি। শিল্পীর নিজস্ব চিত্রশৈলী খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তখন। এই চিত্রশৈলীকে সঞ্জীবিত করার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ঐতিহ্যগত-আত্মপরিচয় সন্ধানী বিশেষ এক শিল্প-আন্দোলনের, নব্য-ভারতীয় ঘরানা নামে যা পরিচিত। ফলিত-কলার এই ধারায় বিশেষ অবদান রেখেছেন যাঁরা, রণেন আয়ান দত্ত তাঁদের অন্যতম। বিজ্ঞাপন-শিল্পে অবদানের জন্যই সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বিশেষ ভাবে পরিচিত। এ ছাড়াও স্থাপত্য, স্থাপত্যের অভ্যন্তর-পরিকল্পনা, ইংরেজিতে যাকে ‘ইন্টেরিয়র ডেকরেশন’ বলা হয়। পাশাপাশি ললিতকলাতেও তাঁর ধ্যান নিমগ্ন ছিল আজীবন। অজস্র ছবি এঁকেছেন, যার সঙ্গে অনেকেরই হয়তো সম্যক পরিচয় ছিল না।
গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার তাঁদের এ বারের বার্ষিক প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত করলেন রণেন আয়ান দত্তের সেই সৃজনের সম্ভার। ফলিত-কলার পাশাপাশি তাঁর অজস্র ললিত-চিত্র নিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল ইনস্টিটিউটের প্রদর্শনী কক্ষে।
ফলিত-কলার এই ঐতিহ্যগত উজ্জীবনের ক্ষেত্রে আরও কয়েকজন শিল্পীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সৃজনের একটা আবহই তৈরি হয়েছিল তখন, যে আবহকে প্রসারিত করেছিলেন রণেন আয়ানের মতো শিল্পী। সত্যজিৎ রায় ছিলেন এই ঘরানার প্রধান এক পথিকৃৎ। এ ছাড়াও কাজ করেছেন খালেদ চৌধুরী, রঘুনাথ গোস্বামী, পূর্ণেন্দু পত্রীর মতো শিল্পীরা। দুটি উত্তরাধিকার এই উজ্জীবনের প্রেক্ষাপটে কাজ করেছে। একটি হল নব্য-বঙ্গীয় ঘরানার স্বদেশচেতনা। অন্যটি বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনা। পূর্বোক্ত সব শিল্পীই এই দুটি আদর্শের সমীকরণের মধ্য দিয়ে নিজস্ব সৃজনপ্রতিভাকে বিকশিত করেছেন।
কেবল দেশীয় ঐতিহ্যগত চিত্ররীতির অনুশীলনেই তিনি তৃপ্ত থাকেননি। পাশাপাশি আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেছেন পাশ্চাত্যের আধুনিক চিত্র-আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্যগুলিকেও। বিশেষত ইম্প্রেশনিজম তাঁর অনেক ছবিতেই আঙ্গিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুই আঙ্গিকের সমন্বয়-প্রয়াসই তাঁর চিত্রসাধনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর দু-একটি ছবিতে নন্দলাল ঘরানার স্পষ্ট প্রতিফলন অনুভব করা যায়। একটি ছবিতে, একজন ঢাকির ঢাক বাজানোর প্রতিমাকল্প রূপায়িত করেছেন তিনি। রেখার ছন্দিত বিস্তার, সেই বিস্তারকে অলঙ্করণের আতিশয্যে ঝংকৃত করে তুলে উৎসবের আবহ তৈরি করা— এর মধ্যে নন্দলাল বসুর আঙ্গিকের প্রতিফলন খুবই স্পষ্ট।
রৈখিক অলঙ্করণের উপর এই দখল তাঁর ছবিকে বিশেষ ভাবে জঙ্গম করে তোলে। এই জঙ্গমতাকে তিনি নানা ভাবে ব্যবহার করেন। ৫.৩.১৯৮১ তারিখে আঁকা একটি ঘোড়ার ছবি আছে এই প্রদর্শনীতে। সম্পূর্ণ কালো প্রেক্ষাপটে বিচ্ছুরিত সাদা রেখায় তিনি ছুটন্ত একটি ঘোড়ার আলেখ্য এঁকেছেন। এই ঘোড়ার মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক চিত্রের সেই অন্তঃস্থ শক্তি সম্যক্ ভাবে পরিস্ফুট হয়েছে, চৈনিক শিল্পী জুঁ পেয়-র ঘোড়ার উপস্থাপনায় যে ধরনের সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই।
নব্য ভারতীয় ধারার প্রত্যক্ষ অভিঘাত রয়েছে তাঁর যে সমস্ত ছবিতে তার মধ্যে মহাভারতকে ভিত্তি করে আঁকা ছবিগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অজন্তার উত্তরাধিকার তিনি ব্যবহার করেন। ‘কুরুক্ষেত্র’ নামে পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধের একটি বড় মুরালধর্মী ছবি আছে এই প্রদর্শনীতে, যাতে ধরা আছে পুরাণকল্প সম্পর্কে তাঁর গভীর বোধের পরিচয়। আবার ‘রুফটপ’ নামে কলকাতার বাড়িঘর, পথ, উড়ন্ত পাখির দৃশ্য, ‘ওল্ড ক্যালকাটা’, ‘ট্রাফালগার স্কোয়ার’, মাছ ধরার জন্য ‘ফিশিং’ ইত্যাদি ছবিতে ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিককে তিনি নিজের মতো ব্যবহার করেছেন। জীবনের নানা ক্ষেত্রে দৃষ্টিকে স্বকীয় ভাবে পরিব্যাপ্ত রেখেছেন শিল্পী রণেন আয়ান দত্ত।