পুস্তক পরিচয় ২

এক নিতান্ত মেঠো মানুষের উত্থান

একটা বড় গাছ কত অসংখ্য পাখিকে আশ্রয় দেয়। কত কাঠবেড়ালি। শুধু কি তাই! কত পথিককে ছায়া দেয়। কত লোক তার গায়ে লাল-হলুদ সুতো বেঁধে তাকে দেবতা বলেও মানে। একটা বড় গাছের সঙ্গে এক সময় পাত্র না পাওয়া মেয়েদের বিয়েও হয়েছে।

Advertisement
রূপক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০০:০১

একটা বড় গাছ কত অসংখ্য পাখিকে আশ্রয় দেয়। কত কাঠবেড়ালি। শুধু কি তাই! কত পথিককে ছায়া দেয়। কত লোক তার গায়ে লাল-হলুদ সুতো বেঁধে তাকে দেবতা বলেও মানে। একটা বড় গাছের সঙ্গে এক সময় পাত্র না পাওয়া মেয়েদের বিয়েও হয়েছে। বড় গাছ মানে একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু তার বড় হওয়ার আগে আসল যে জিনিসটা— সেটা তার বীজ। তার কী-ই বা আকার, অথচ ছোটর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মহীরুহ। সন্ধের প্রদীপ জ্বালানোর আগে দুপুরের সলতে পাকানোর মতো পুরনো প্রবাদকে এখানে টানতে হল। তার কারণ দুটো বই। প্রথমটা— অপরাজেয়, দ্বিতীয়টা— জাগরণ। লেখক দেবব্রত সিংহ। অপরাজেয়-কে যদি মহীরুহ ধরা যায়, তবে তার বীজ নিশ্চয়ই জাগরণ। কবি হিসেবে দেবব্রত সিংহ সুপরিচিত। তাঁর ধুলোমাটির মানুষ ধুলোমাটির কবিতা বাংলা কবিতায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। উপন্যাসে তিনি পার্টি-অধ্যুষিত গ্রামবাংলার এক নিখুঁত চিরকালের কাহিনি রচনা করেছেন। নিছক উপন্যাস নয়, একে মহাকাব্য বলা উচিত। অপরাজেয় যখন শেষ হচ্ছে তখন তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’ চলচ্চিত্রে মান্না দে-র সেই গান মনে পড়ে— ‘লাথি খেয়ে আর কতদিন বাঁচবি তোরা। রুখে দাঁড়া একবার রুখে দাঁড়া’।

Advertisement

দেবব্রত সিংহ কোনও ম্যাজিক রিয়ালিজমের ধার ধারেননি। গ্রামবাংলার প্রান্তিক মানুষদের কথা বলেছেন তাঁদেরই ভাষায়, যে জন্য এই উপন্যাস এত জীবন্ত। এত বড় এর চালচিত্র যে অপরাজেয় পড়তে পড়তে জাগরণ-এ ফিরে গেলে যেন ভাষার সময়যানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যায়। বিশেষত যে ‘ডায়লেক্ট’-এ চরিত্ররা কথা বলেছে সেই সব বানান যতদূর সম্ভব মুখের কাছে নিয়ে গিয়েছেন দেবব্রত। ‘মানুষটা বলতক, জানিস সারি, আমি প্রধান হল্যে প্রথম কাজটা কী করব জানিস আমাদে অঞ্চলের গাঁ গেরামে যেখানে যত খাটে খাওয়া মানুষের হাভাতা মানুষের অন্ধকার কুঁড়্যাঘর আছে সেগুলোকে সব আলোঝলমলা কর‌্যে দিব। কত স্বপুন ছিল মানুষটার, তুমাদিকে লিয়ে কত স্বপুন ছিল।’ এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। লেখক নিজে তাঁর মাটি আর উপন্যাসের মাটি চষে খেয়েছেন তাই এ ভাবে একে উৎকীর্ণ করতে পেরেছেন শব্দ-বাক্য-অক্ষরে।

এক সময় সাক্ষরতা অভিযান করে সরকার ভেবেছিল ইতিহাস গড়ে ফেলবে। এই অভিযান যে আসলে গ্রামবাংলায় গোপনে গোপনে পার্টির মতবাদ চালান করে দেওয়া, এ সব বুঝতে পারার পর একজন একা মানুষের লড়াই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। কী ভাবে একজন প্রান্তিক মানুষ ‘পার্টিবাবু’দের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে তার এক অসামান্য ‘দলিল যুগপৎ’— অপরাজেয় ও জাগরণ। কোথাও যেন মনে হয়, কিশোর বয়সে পড়া নিকোলাই অস্ত্রভস্কি-র ইস্পাত-এর সঙ্গে তুলনীয়। দুটি খণ্ড একের অন্যের পরিপূরক। জাগরণ যে কেন জাগরণ, তা অপরাজেয়-র শেষে এসে বোঝা যায়। একজন নিতান্ত মেঠো মানুষের উত্থান। ‘জগা মিস্ত্রি’ এ উপন্যাসের একটা মিথ। সে বেঁচে ছিল প্রত্যেকের বিবেক জাগানোর জন্য। সে বেঁচে থাকবেও। তাকে ঘিরেই তো প্রান্তিক মানুষদের উত্থান। যেখানে গণা তার বক্তৃতায় বলছে, ‘পার্টিবাবুরা জগাকে যখন মেম্বার করব প্রধান করব বলে কথা দিইয়ে শেষটাতে ধাপ্পা দিলেন, জগা যখন দেখেশুনে ভোটে লিদ্দল দাঁড়াবেন বলে একাই রুখে দাঁড়ালেন তখন আমি বলেছিলাম তুই একা লস জগা, তোর সঙ্গে আমিও আছি। তাবাদে দেখলাম... আমাদের গাঁ গেরামের যত খেটে খাওয়া মানুষ সবাই আছে, অখন দেখলাম গোটা অঞ্চলটা আমাদের সঙ্গে আছে।’ যে কথা বলতে গিয়ে এতটা এগিয়ে আসতে হল, তা হল, অপরাজেয়-র শেষ হচ্ছে সারিকে দিয়ে, যার শরীর এবং চেতনায় এক নতুন জাগরণ দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ, জাগরণ উপন্যাস হিসেবে আবার মানসিক, নৈতিক জাগরণ হিসেবেও একজন সংগ্রামী নারীর বোধের ভিতর ফুটে উঠছে। কারও অজানা নেই, গণসংগঠনের নামে ‘পার্টিবাবু’রা কোথায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের নিয়মেই গ্রামের প্রান্তিক মানুষ সূ্র্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখত। সে সবের বিরুদ্ধে কারও শক্ত মেরুদণ্ডের কাহিনি— অপরাজেয়। আর তার পূর্বসূরি জাগরণ।

দেবব্রত সিংহ ছত্রে ছত্রে বুঝিয়েছেন তিনি কতটা ভূমিপুত্র। যাঁদের নিয়ে, যাঁদের জন্য, অর্থাৎ নিপীড়িত সেই সব মানুষ যদি এই উপন্যাসের কথা জানতে পারেন বা পড়তে পারেন। এমন বিস্তারিত বর্ণনার সঙ্গে এমন লড়াইয়ের কথা যদি কোনও মহাভারতের সঞ্জয় তাঁদের কাছে, তাঁদের কানে পৌঁছে দেন তবে জানবেন তাঁরা এই মহতী বেঁচে থাকার লড়াইয়ে রসদ পাবেন। কেন না, রাজা আসে রাজা যায়। দিন বদলায় না।

উপন্যাসে কোথাও কোথাও লেখক অসাধারণ দক্ষতায় এক গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছেন। তাঁর উপন্যাস দীর্ঘ নদীর মতো কখনও কোথাও বাঁক নেয়। মোদ্দা কথা তার মোহনায় গিয়ে মেশা। দেবব্রত সিংহ তাই পেরেছেন। আশা করা যায়, তিনি এমন মানুষের কথা আরও শোনাবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement