চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

উন্নয়নের ঘোড়দৌড়ে বিপন্ন মানবতা

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত পাঠভবনের ৫০-বছর পূর্তির প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষকলকাতার পাঠভবন বিদ্যালয়ের ৫০-বছর পূর্ণ হল। এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। এর প্রেরণার উৎসমূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শিক্ষাভাবনা। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত পাঠভবনের ৫০-বছর পূর্তির প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

কলকাতার পাঠভবন বিদ্যালয়ের ৫০-বছর পূর্ণ হল। এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। এর প্রেরণার উৎসমূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শিক্ষাভাবনা। শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীতে যাকে তিনি উৎসারিত করে গেছেন। শিক্ষার বিকাশের সঙ্গে সমগ্র প্রকৃতিকে একাত্ম করে নেওয়া। শিক্ষার্থীর মনশ্চক্ষু খুলে দিয়ে তাঁর ভিতরের নিজস্ব সৃজনশীলতাকে ক্রমাগত উন্মীলিত করতে থাকার প্রয়াস। এই নিয়ে সারা জীবনের সাধনা ছিল ঋষি-কবির। তত্ত্বের সঙ্গে সব-রকম সৃজনকে মিলিয়ে নেওয়া সেই শিক্ষাপদ্ধতির অন্যতম একটি দিক। কলকাতা শহরে এই কাজটি করা খুব সহজ ছিল না। প্রতিষ্ঠার বছর ১৯৬৫-তেও ছিল না। আজও নেই। তবু কিছু নিবেদিত মানুষের ঐকান্তিক প্রয়াসে পাঠভবন সেই কাজটি করে গেছে। তারই কিছু নিদর্শন তুলে ধরতে পাঠভবনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বিড়লা-অ্যাকাডেমিতে আয়োজন করা হয়েছিল আলোচনাচক্র ও প্রদর্শনী।

Advertisement

আলোচনার বিষয় ছিল: ‘শিক্ষাদীক্ষায় শিল্পচর্চার অভিমুখ’। বক্তা ছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রপ্রমিত রায় ও সৌমিক নন্দী মজুমদার। ইন্দ্রপ্রমিত ও সৌমিক এখানেই বিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছেন। এখন তাঁরা কৃতী শিল্পী ও শিল্প-তাত্ত্বিক। তাঁরা তাঁদের আলোচনায় সারা বিশ্বের অজস্র শিল্পকাজ দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন শিল্পসৃষ্টির মূল উৎস ও প্রবণতাগুলি কী। সকলেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছেন এই সিদ্ধান্তে যে ছোটদের এবং বড়দেরও স্বকীয়তাকে সম্মান করা ও বিস্ময়বোধকে সজীব রাখাই হওয়া উচিত শিক্ষার একটি মৌলিক আদর্শ।

সেই আদর্শেরই প্রতিফলন দেখি পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের নানা আঙ্গিকের শিল্পকাজের ভিতর। বিভিন্ন মাধ্যম ও প্রকরণে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয় এখানে। শুধু রং-তুলির ছবিই নয়, কাগজ কেটে ও সেঁটে করা কাজ, অরিগেমির বিভিন্নধরণ, কাপড় কেটে, সেলাই করে, ছবি তৈরি করা, বাটিকের কাজ, ভাস্কর্যের নানা পদ্ধতি, মাটি নিয়ে খেলা করতে করতে গড়ে ওঠা বিচিত্র সব প্রতিমাকল্প, ছাপ চিত্রের নানা ধরণ, কাঠখোদাই, লিনোকাট বা স্লেট কেটে ছাপ তোলার নানা পদ্ধতি ইত্যাদি বিবিধ প্রকরণের কাজে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বর্ণময় হয়ে উঠেছে এই প্রদর্শনী। বাস্তবের অনুকরণই যে ছবি নয়, ছবির যে রয়েছে নিজস্ব এক অভিব্যক্তির জগৎ যা বাস্তবের নানা অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করে – এই শিল্পসম্ভার মগ্ন দর্শককে সেরকম এক বোধে পৌঁছতে সাহায্য করে। এই প্রদর্শনীর এবং এই বিদ্যালয়ের নিরন্তর শিল্পচর্চার সার্থকতা এখানেই।

পাঠভবনের ছাত্র-ছাত্রীদের এবারের ৫০-বছর পূর্তির প্রদর্শনীতে অতিরিক্ত প্রাপ্তি ঘটেছে, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের কাজের সম্ভারে। প্রায় ২৪ জন শিল্পীর বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্য থেকে একটি ঐক্যসূত্র বেরিয়ে আসে। এক ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বোধ। সভ্যতার উন্নয়নের ঘোড়দৌড়ে কেমন করে বিপন্ন হচ্ছে মানবতা ও প্রকৃতি, এরই নানা নিদর্শন আমরা পাই বিভিন্ন শিল্পীর কাজে। পাঠভবনের শিক্ষাদর্শের মূল সুরটিও হয়তো ধরা থাকে এখানেই।

প্রবীর গুপ্ত-র একটি ভিডিও শুধু মুগ্ধ নয় ব্যথিতও করে দর্শককে। আজকের পরিস্থিতিতে মৃত্যুর নৈরাজ্যকে উন্মোচিত করে। রাস্তার উপর একটি পাখি মরে পড়ে আছে। তার স্বজন অন্য কয়েকটি পাখি ক্রমাগত সেই মৃত্যুর সামনে তাদের শোক ও হতাশা ব্যক্ত করে যাচ্ছে। এই হল ভিডিওটির বিষয়। চিত্রভানু মজুমদারের দুটি ছবির একটি ডিজিটাল কোলাজ। অন্যটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের বিমূর্ত রচনা, যার ভিতর উন্মোচিত হয় অন্ধকারের পরিমণ্ডল। ইন্দ্রপ্রমিত রায়ের ‘কনস্টেলেশন’ আলো-ছায়ার মরমি সংঘাতে গড়ে ওঠা এক বিমূর্তায়িত নিসর্গ। ছোট ছোট পাঁচটি ড্রয়িং-এ সৌমিক নন্দী মজুমদার কৌতুকদীপ্ত কল্পরূপাত্মক অথচ গহন বাস্তবের আলেখ্য এঁকেছেন। পরাগ রায়ের দুটি ক্যানভাস ‘দ্য ওয়াইজ কাউ’ ও ‘ডিনার টাইম’ সামাজিক সংকটের প্রতীকী উপস্থাপনা। ঈলীনা বণিকের দীর্ণ বাস্তবতার অবয়বী উপস্থাপনাদুটিও তাই। মধুছন্দা সেন আলোকচিত্রে বাস্তবকে কল্পনাদীপ্ত ভাবে বিমূর্তায়িত করেছেন। ঋষি বরুয়া ইস্পাতের পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ জুড়ে গড়ে তুলেছেন মৃত্যুর প্রতীকী রূপ। অভিজিৎ গুপ্তের রচনাদুটিতেও হিংসার বাতাবরণের সাংকেতিক রূপ।

আরও পড়ুন
Advertisement