পুস্তক পরিচয় ১

উজানি আলোকরেখার কাজ করে

বুলহে শাহের কাব্যিক অভিব্যক্তির সঙ্গে সেকালের মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বহু সুফি, সন্ত ও ভক্ত কবিদের রচনার কিছুটা মিল পাই।

Advertisement
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
সুফি লিরিকস, বুলহে শাহ। সম্পা. ও অনু: ক্রিস্টোফার শ্যাকল। মূর্তি ক্লাসিকাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়া, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২৯৫.০০

সুফি লিরিকস, বুলহে শাহ। সম্পা. ও অনু: ক্রিস্টোফার শ্যাকল। মূর্তি ক্লাসিকাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়া, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২৯৫.০০

পঞ্জাবি সাহিত্য সমালোচকরা মধ্যযুগের সুফি কবিদের মধ্যে বুলহে শাহকে (১৬৮০-১৭৫৮) সর্বোচ্চ মান্যতা দেন। আজও পাকিস্তান ও ভারতের দুই পঞ্জাবে তাঁর রচনার বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশ হয়। দেশভাগের আগে পঞ্জাবি সাহিত্য মূলত শাহমুখী লিপিতে প্রকাশিত হত। কিন্তু বিভাজনের ফলে কেবল পঞ্জাব দু টুকরো হয়নি, পঞ্জাবি সাহিত্যে কিছুটা ভাগাভাগি দেখি। আজ ভারতীয় পঞ্জাবে যে লেখা কেবল গুরুমুখী লিপিতে লিখতে হয়, পাক-পঞ্জাবে প্রায় একই বিষয় শাহমুখীতে প্রকাশিত হয়। বোধহয় দেশভাগ পঞ্জাবিদের ভাষাসংস্কৃতির উত্তরাধিকার থেকে তেমন ভাবে বঞ্চিত করতে পারেনি বলে, বুলহে শাহের জনপ্রিয়তায় তেমন হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেনি।

ঔপনিবেশিক আমলে ছাপাখানা মধ্যবিত্তের কাছে হিন্দি-উর্দু ভাষা-সাহিত্যকে পৌঁছে দিলেও, সেখানকার গৃহকোণের দেওয়া-নেওয়ার জন্যে সাধারণ মানুষ তার মা-বোলি পঞ্জাবিকে পরিত্যাগ করেনি। পঞ্জাবিতে আদানপ্রদানের শুরু কবে থেকে, সে কথা আজ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। আনুমানিক বারো শতকের শেষ থেকে মুলতান হয়ে মিঞামীর পর্যন্ত বিস্তৃত বেশ কয়েকজন সুফি কবির নজরকাড়া রচনার জন্যে, পঞ্জাবি ভাষাকে ‘সহস্র বর্ষের সাধনার ধন’ বললে খুব একটা অন্যায় হবে না।

Advertisement

কিছুদিন বসবাসের পর, পঞ্জাবে ইসলাম আর রাজবেশে আটকে থাকেনি। স্থানীয় সংস্কৃতির অনেক কিছু গ্রহণ ও বর্জন করে, সে ক্রমশ দেশজ রূপ গ্রহণ করলে, মধ্যপ্রাচ্যের সুফি ভাবধারাও পঞ্জাবিতে রূপান্তরিত হয়ে বুলহে শাহের মতো মহৎ কবির জন্ম দেয়। সমকালের অন্য কবিদের মতো, তাঁর রচনার মাধ্যম মুখের ভাষা হওয়ায়, সেখানে যেমন জনপরম্পরার ছাপ দেখি, তেমনই তার বিপুল প্রচার ও প্রকাশে অনেক বেশি লৌকিক রূপব্যঞ্জনা দেখতে পাই।

ক্রিস্টোফার শ্যাকল অনূদিত-সম্পাদিত বুলহে শাহের নতুন সংস্করণটি মূল্যবান ও যুগোপযোগী। আজকের পৃথিবীতে প্রায়শই যখন নানা অসহিষ্ণুতা ও ধর্মান্ধতার প্রকাশ দেখি, তখন বুলহে শাহের কাব্যসংগ্রহের নতুন সংস্করণ যেন কিছুটা উজানি আলোকরেখার কাজ করে। এতদিন পর্যন্ত বুলহে শাহের যে সব কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলি মূলত পঞ্জাবি ভাষার পাঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নতুন সংস্করণটি এই রচনাকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরবে।

সম্পাদক পঞ্জাবি ভাষায় গুরুমুখী লিপিতে প্রামাণিক পাঠ প্রকাশের পাশাপাশি, পণ্ডিতজনের চাহিদা মেটাতে, একটি মান্য ইংরেজি পাঠ ও সঙ্গে টীকা ও ব্যাখ্যান যুক্ত করেছেন। ফলে সংস্করণটিতে ভারতীয় পঞ্জাবের মাতৃভাষা পঞ্জাবিকে মর্যাদার জায়গা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুনিয়ার সুহৃদ সমাজ ও গবেষকদের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে রেখে সম্পাদনার কাজে গুরুত্ব দিতে ভোলেননি শ্যাকল। তাঁর দীর্ঘ গবেষক জীবনের সিংহভাগ মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ইসলামি জগতের নানা ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষা, তার ভাষান্তর ও ব্যাকরণ রচনা ও চর্চায় কেটেছে। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁকে যে ধরনের তথ্য সংগ্রহ, তত্ত্বের বিচার ও জটিল প্রশ্নের জট খুলতে হয়েছে, তার নানান ইঙ্গিত সম্পাদকীয় ভূমিকা, টীকা ও গ্রন্থপঞ্জি থেকে পাওয়া যাবে।

কবি যে কালে লিখেছিলেন, সে যুগের পঞ্জাবে না ছিল মুদ্রণযন্ত্র, না ছিল সাহিত্যের মান্য পাঠের চাহিদা। তখন লোকমুখে কবিখ্যাতির প্রচলন থাকায়, যোজন অন্তর কাব্যের উচ্চারণের পার্থক্য হওয়া খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। সেখান থেকে এক কবিতার একাধিক পাঠ এবং তার মধ্যে কোনটিতে কবিকণ্ঠ নিখুঁত ভাবে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, ইত্যাদি নানা প্রশ্নের সর্বসম্মত বিচারের কেবল একটি পথ আছে কি না, তাই নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনার মধ্য দিয়ে শ্যাকল সম্পাদকীয় বিতর্কটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কোনও এক নির্দিষ্ট ধরনের বাক্যের গঠন, ভাবের সাযুজ্য, রচনাশৈলীর সাদৃশ্য ও শেষে কবির ভণিতাকে যখন বুলহে শাহর নিজস্ব বলে চিহ্নিত করতে পেরেছেন, তখন তাকে কাব্যসমগ্রের অন্তর্গত করেছেন। সম্পাদকের মতে, বুলহে শাহের রচনার কয়েকটি বিশেষ আদল আছে, যা কবিতাগুলি বার বার পাঠের মধ্যে দিয়ে ছুঁতে পারা যায়। মন্দ কবিযশোপ্রার্থীর শত চেষ্টা সেখানে পৌঁছবে না বলে শ্যাকল দাবি করেছেন।

বুলহে শাহর অধিকাংশ সৃষ্টি ‘কাফি’ আঙ্গিকে লেখা সংক্ষিপ্ত কবিতা। তা ছাড়া তিনি পূর্বজ ও সমকালীন অন্য কবিদের মতো, ‘বারামাহ’ (বারমাস্যা), ‘আঠভারা’ (আটদিন), ‘শিরাফি’ (ফার্সি অক্ষরের ক্রম ও পংক্তি মেনে কবিতা) ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত ধারায় কাব্য রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের জন্যে দিবস-রজনী বিরহ-বেদন, দূরত্বের অবসানে অহরহ স্বপ্নসম মিলন কামনা, তার জন্য অবিশ্রাম প্রস্তুতি, এমনকী দেহাতীত আলিঙ্গনের জন্যে অসীম প্রত্যাশায় অপেক্ষার কথা তুলে ধরেছেন। অন্য সুফি সাধকদের মতো তিনি পিরি-মুরিদি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কেবল আত্মাবলুপ্তির কথা বলেননি, তাকে ঈশ্বরানুভূতির প্রধানতম শর্ত বলে ইঙ্গিত করেছেন। প্রয়োজনমতো তিনি মহিলা কণ্ঠস্বর আত্মস্থ করেছেন।

বুলহে শাহের এই ধরনের কাব্যিক অভিব্যক্তির সঙ্গে সেকালের মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বহু সুফি, সন্ত ও ভক্ত কবিদের রচনার কিছুটা মিল পাই। একদিকে তিনি যেমন নিজের জীবনচর্চায় আচারসর্বস্ব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসের কঠোর বিরোধিতা করেছেন, তেমনই ঈশ্বরকে খুঁজেছেন প্রচলিত মুসলমান-হিন্দুর সীমানাটানা মানসিকতার বাইরে। মন্দির-মসজিদ, বেদ-কোরান, কাশী-মক্কা, একাদশী-রমজান ইত্যাদি কোনও কিছুতে পাওয়া যায় না বলে, বুলহে শাহ তাঁকে অন্তরে খুঁজেছেন। বিরহানলে দগ্ধ হয়েও, তাঁর সঙ্গে নতুন সেতু বাঁধার আশা ছাড়েননি। অবশ্য তিনি নিজে মুসলমান না হিন্দু, সেই নিয়ে তাঁর প্রশ্নের অন্ত ছিল না। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘বুলহা কি জানান ম্যঁই কউন’।

প্রেমাস্পদের সঙ্গে বিরহ যন্ত্রণার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে, বুলহে শাহ সমকালীন পশ্চিম পঞ্জাবের দেশজ সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন ছবি তুলে ধরেছেন। সেখান থেকে একদিকে যেমন রমতা যোগী, বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে গ্রামসমাজে জটিল সম্পর্কের খবর পাই, তেমনই হিন্দু বর্ণব্যবস্থা প্রসূত জাতিভেদের কঠিন নিগড়, বিয়ের পণ জোগাড়ের আশায় মেয়েদের চরকায় সুতো কেটে পয়সা রোজগার, গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে পশুপালন অর্থনীতির দেওয়া নেওয়া, হিন্দু মুসলমানের স্থানিক সংঘর্ষ, বণিকগোষ্ঠীর নানা ধরনের লেনদেন, শাসন কাঠামোয় ভাঙন, ইত্যাদি বহু কিছুর বিক্ষিপ্ত ছবি খুঁজে পাই।

অষ্টাদশ শতকের পঞ্জাবে কবি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। অনেক পণ্ডিতজন সেকালকে রাজনৈতিক ইতিহাসের যুগসন্ধি বলে মনে করেন। বুলহে শাহ মুঘল দিনাবসানের পাশাপাশি শিখ শক্তির উত্থান ঘটছে বলে জানিয়েছেন। তিনি দুটি কাফিতে নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুরের আত্মদানের কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি। তার এক শতক আগে পঞ্চম গুরু শিখ ধর্মগ্রন্থ সম্পাদনের সময় বাবা ফরিদ ও কবিরের একাধিক পদকে কিছুটা নিজের মতো করে গ্রহণ করেছিলেন বলে কথিত আছে।

বুলহে শাহের রচনায় উল্লেখ ছাড়া, শিখ ধর্মের আদিপর্বে পঞ্জাবে বিভিন্ন গুরুদের সঙ্গে সুফি সন্তদের নানা কথাবার্তা চলত বলে একাধিক সূত্র থেকে জানতে পারি। সে দিক থেকে শিখ ধর্মে ঈশ্বরবিষয়ক চিন্তাচেতনায় সুফি প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। এ বিষয়ে আলোচ্য সংস্করণের মুখবন্ধে শ্যাকলের মতো গবেষকের নীরবতা কিছুটা আশ্চর্য করে। শ্যাকলের নীরবতার মধ্যে এক ধরনের অস্বীকৃতির সুর আছে বলে যদি কেউ অভিযোগ করেন, তার সবটা উড়িয়ে দেওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার।

আরও পড়ুন
Advertisement