পুস্তক পরিচয় ২

ইতিহাসের আশ্চর্য উপাখ্যান

একগুচ্ছ দড়ির দু-প্রান্তে গিঁট বেঁধে দড়িগুলোকে পৃথকভাবে বিছিয়ে দিলে যেরকম দেখায় রেশমপথ দেখতে ঠিক সেরকম। গিঁটের একদিক কিন দেশের চাংঘান, অপরদিকটি কাশগড়।’ ‘কাশগড়ে এসে রেশমপথ শেষ হয়েছে?’

Advertisement
জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
গ্রহণকাল, মৈত্রী রায় মৌলিক। আনন্দ, ৩০০.০০

গ্রহণকাল, মৈত্রী রায় মৌলিক। আনন্দ, ৩০০.০০

একগুচ্ছ দড়ির দু-প্রান্তে গিঁট বেঁধে দড়িগুলোকে পৃথকভাবে বিছিয়ে দিলে যেরকম দেখায় রেশমপথ দেখতে ঠিক সেরকম। গিঁটের একদিক কিন দেশের চাংঘান, অপরদিকটি কাশগড়।’ ‘কাশগড়ে এসে রেশমপথ শেষ হয়েছে?’ ‘না, তবে কাশগড়ের পর পথগুলি এক হয়ে গেছে। সে পথ খোকন্দ, সমরকন্দ, বোখারা পেরিয়ে কৃষ্ণসাগরে পড়েছে।’ বারাণসীর তরুণ উদয়নকে বোঝাচ্ছিল ব্যবসায়ী ‘বন্ধু’ ইয়াকুব (পৃ ১৩৫)। কিন্তু আমাদের, নাগরিক বঙ্গবাসীর মনে আরও কত প্রশ্ন রহস্যময় সেই রেশমপথকে ঘিরে, যে পথ দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে চিন, ভারতবর্ষ ও মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির নিয়ামক ছিল, ভাস্কো-ডা গামার ভারতে পৌঁছনোর পর থেকে যে পথ গুরুত্ব হারাতে থাকে। প্রশ্ন অনেক ছিল, কিন্তু মোটামুটি একটা ধারণা বা পরিচিতি লাভের মতো কোনও বই ছিল না।

চারশো পৃষ্ঠার উপন্যাস গ্রহণকাল। প্রথম পাঠেই চমকে দেন নতুন লেখক মৈত্রী রায় মৌলিক। পেশায় ভূতত্ত্ববিদ মৈত্রী একই সঙ্গে ভালবাসেন মাটি, জঙ্গল ও জঙ্গলবাসী মানুষদের। সেই ভালবাসায় আবেগের চেয়ে অনেকটা বেশি আগ্রহ বাস্তবকে চিত্রিত করে রাখার। হয়তো এই প্রবল আগ্রহই তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছে এই উপন্যাস। আখ্যানভাগ ন্যস্ত হয়ে আছে ভারত মূলস্থান কাশগড় মঙ্গোলিয়া তিব্বত, উত্তর চিন ও দক্ষিণ চিন জুড়ে। সময়কাল প্রায় কুড়ি বছর। এই সুবিস্তৃত ভূগোলের বিভিন্ন শহর, গ্রাম, জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে কাহিনি। আখ্যানের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রক্ত ও তুষারের ঝড়ের মতো এক তীব্র উপাখ্যান, মঙ্গোলিয়ার। সে সময়ের ভারতবর্ষ বা ‘কিন দেশ’-এর সমৃদ্ধ জীবনের ঠিক বিপরীত, অচেনা এক হিংস্র অনিশ্চিত জীবন। অভাব খাদ্যের, পোশাকের, আঠারোটি গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধে নিত্য মৃত মানুষদের স্থান পূরণের জন্য নতুন নতুন শিশুর জন্মের। মেরাকিটদের হাতে বুরখান গোষ্ঠীপতি ইয়েসুগাইয়ের মৃত্যু দিয়ে উপাখ্যান শুরু। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হোয়েলুনের বড় ছেলে তেমুজিনের বয়স তখন নয়। খেনতাই গোষ্ঠীপতি দেইচিনের মেয়ে বোরতে-র সঙ্গে ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফিরছিলেন ইয়েসুগাই।

Advertisement

একটা সদ্য ধরা মাছের দখল নিয়ে বয়সে একটু বড় সৎভাই বেগতারকে বর্শা ছুড়ে খুন করে কামাব, তেমুজিনের একান্ত বিশ্বস্ত ছোট ভাই। না হলে ‘ওই বেগতারই গোষ্ঠীপতি হবে। মা-কে বিয়ে করে অনেক সন্তান তৈরি করবে দল বাড়াবার জন্য।’ শিকার আর অল্পস্বল্প ফল ছাড়া খাবারের অভাব। প্রচণ্ড ঠান্ডা ঠেকাবার জন্য পোশাকের অভাব। হত্যা তাই কেবল প্রতিহিংসা নয়, আত্মরক্ষারও পথ। তবু তারও মধ্যে উৎসব থাকে, থাকে প্রেম বন্ধুত্ব বাৎসল্য করুণা। নীল আকাশের দেবতা টেঙ্গেরি, সকল জীবের তিনি প্রতিপালক। তাঁর সামনে পরস্পরের রক্তবিন্দু চেটে নিয়ে, নাকে নাক ঠেকিয়ে রক্ত সম্পর্ক ও নিঃশ্বাসের বাতাস মিলিয়ে পরস্পরের ‘অন্‌দা’, আজন্ম বন্ধু, হয় দুই বালক। হাতে পায়ে শেকল, গলায় পরানো বিরাট লোহার চাকতি, পনেরো বছর বয়সি নির্যাতিত ক্রীতদাস তেমুজিনকে করুণা করেন তাইচুদ গোষ্ঠীর বয়স্ক সৈনিক ‘শিরা’। নিষ্ঠুর প্রতিকূলতার মধ্যেও পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত রয়ে যায় বোরতে আর তেমুজিন।

ইয়াংসি নদীর ধারে সমৃদ্ধ সঙ রাজ্য। জুর্চ বা জুরখানদের আক্রমণে তছনছ হয়ে যাওয়া বিয়ানলিয়াঙ। অতি সমৃদ্ধ হান অভিজাতদের বিলাস ও নিষ্ঠুরতা আর দুই গোষ্ঠীর মাঝখানে অগণিত সাধারণ মানুষ— শিল্পী, চাষি, ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী, অনাথ, বৃদ্ধ আতুর। বিশাল এক সম্মেলক চলা। অভিযানের এক পর্বে কিন দেশের তরুণ ফেং-কে ভারতের ধানখেত, আমবাগান চেনায় হান্‌ মেয়ে মেঙ্গতে। একই সঙ্গে জুড়ে যায় ভারতবর্ষেরও ইতিহাস। কারণ কিনদেশ যদিও তাদের রেশমকীট থেকে সুতো তৈরির রহস্য গোপন রাখে, হিন্দুস্থান প্রভূত কার্পাসবস্ত্রের পাশাপাশি গাছের আঁশ থেকে তৈরি রেশমবস্ত্র রেশমপথ বেয়ে চালান দেয় তকশিল আর বারিগাজার পথে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাশালীরা সেই উৎপাদন অঞ্চলগুলি কবজা করতে চায়। ‘ঢককা থেকে ঘৌড় পর্যন্ত, ওদিকে সাগালো থেকে কাশগড়... গাজি শাহাবুদ্দিন মহম্মদ ঘোরি আর আবদুরি কুতুবুদ্দিন শুধু রাজ্যজয়ের জন্য হিন্দুস্তান দখল করবেন না। ওদের আসল লক্ষ্য রেশমপথ। তার আগে ধীলিকা, ঢক্কার রেশমবাজার কবজা করবেন। সুলতানি ফৌজ খুব শীঘ্র বঙ্গদেশে চড়াও হবে।’ (পৃ ১৮০)

যে কোনও চমৎকার পরিচালকের ফিল্মের মতো, ওস্তাদ বাদকের বিলম্বিত আলাপে ঝলক দিয়ে ওঠা তানকারির মতো ভারত ও চিন, দুই সমৃদ্ধ ধীরগতি সভ্যতার সঙ্গে কুশলী বুনটে ঝলসে উঠছে মঙ্গোলিয়ার ক্ষুদ্র এক দলপতির ক্ষমতা বিস্তারের কাহিনি। তেমুজিন-এর ক্ষিপ্র নির্মম সেনাদল ঝাঁপিয়ে পড়ে জটিল, সূক্ষ্ম, শ্লথ কিন সভ্যতার ওপর আর বন্য নেকড়ের আক্রমণে রক্তক্ষয় হতে হতে যেমন বসে পড়ে হাতি, তেমনই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় চিন, আবার তারই মধ্যে জেগে থাকে শিগিকেনের সতর্কবাণী ‘উঁজে, আপনার সেনাবাহিনী... বর্শা ছুঁড়তে পারে কিন্তু দিনরাতের হিসাব জানে না... ভবিষ্যতে এক উলুস মোঙ্গল রাজ্য চালাতে শিক্ষিত লোকের দরকার’। (পৃ ২৩২) আর, বাইরের এই বিপুল তরঙ্গের ভেতরে চলতে থাকে অসংখ্য ছোট ঘটনা, ব্যক্তিজীবনের সুখদুঃখের বিবরণ যা এই প্রবাহকে রূপ দিয়েছে। এই বিশাল প্রেক্ষাপটে অসংখ্য ছোটবড় চরিত্র ও ঘটনার সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলা, যে কোনও উপাদানকেই বসিয়ে নেওয়া মূল চরিত্র ‘কাল’ এর গায়ে— এর জন্য কবজির সঙ্গে সঙ্গে মগজেরও জোর লাগে। আশ্চর্য নয় যে লেখককে চার বছর চালাতে হয়েছে পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা ও লেখার কাজ। একই সঙ্গে যে ভাবে লেখক প্রবীণ ঔপন্যাসিকের নিস্পৃহ দৃষ্টি অর্জন করতে পেরেছেন, তা-ও মুগ্ধ করে। অনেকখানি প্রতিক্রিয়ার জায়গা ছাড়া আছে পাঠকের জন্য। সঠিক অর্থে এমন ঐতিহাসিক উপন্যাস পাঠের সুযোগ রোজ রোজ আসে না, স্বভাবতই।

আরও পড়ুন
Advertisement