চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

আধুনিকতায় সঞ্জীবিত সমকালীন চিত্রকল্প

‘সিমা’য় চলছে লালুপ্রসাদ সাউ-এর একক প্রদর্শনী। ঘুরে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ।‘সিমা’য় চলছে লালুপ্রসাদ সাউ-এর একক প্রদর্শনী। ঘুরে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

সিমা -গ্যালারিতে শুরু হয়েছে লালুপ্রসাদ সাউ-এর একক প্রদর্শনী। ৫৭টি টেম্পারার ছবি ও ড্রয়িং নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘বাবু ও বিবি’। ঊনবিংশ শতকে কলকাতার বাবু সংস্কৃতির দূরতর প্রতিধ্বনি থাকে এই শিরোনামে। যদিও তাঁর সব ছবি পুরুষ ও নারীর অবয়ব-ভিত্তিক নয়। রয়েছে ফুলের ছবি, ফুলদানিতে ফুল, প্রস্ফুটিত সূর্যমুখী, প্যাঁচা, কাক, চিংড়ি, শূকর ইত্যাদি নানা বিষয়। প্রচ্ছন্ন কৌতুক রয়েছে প্রায় সব ছবিতেই। দুটি অভিমুখে প্রসারিত হয়েছে সেই কৌতুক, এক দিকে নিরুপম, স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। আর এক দিকে সংহত করুণা, প্রতিবাদী চেতনা থেকে যা উৎসারিত।

লালুপ্রসাদ সাউ ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত এই সময়ের প্রধান একজন শিল্পী যিনি আধুনিকতাবাদী মূল্যবোধকে ঐতিহ্যদীপ্ত আধুনিকতায় সঞ্জীবিত করে সমকালীন চিত্রকলার এক স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় নির্মাণ করেছেন। অবনীন্দ্রনাথের হাতে এই ঐতিহ্যদীপ্ত আধুনিকতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। নন্দলাল বসু একে দেশীয় সংস্কৃতির গভীর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। ষাটের দশকের যে কয়েকজন শিল্পী সেই মূল্যবোধকে বিপর্যস্ত সময়ের ভিতর দিয়ে জারিত করে স্বদেশ ও বিশ্বের সমন্বয়ে নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত করেছিলেন, লালুপ্রসাদ তাঁদের মধ্যে প্রধানতম একজন।

Advertisement

তাঁর সুদীর্ঘ চিত্র-প্রয়াসকে দুটি প্রধান ধারায় ভাগ করে নেওয়া যায়। একটি ধারা ষাট ও সত্তর দশকের গ্রাফিক্স বা ছাপচিত্রের বিমূর্ত ছবি। দ্বিতীয়টি ১৯৮০-র দশক ও পরবর্তী সময়ের টেম্পারায় করা কৌতুকদীপ্ত একক অবয়বের ছবি, যার প্রাথমিক উৎস ঊনবিংশ শতকের বাবু সংস্কৃতি। তাঁর জীবনের কয়েকটি বাঁককে লক্ষ করলে তাঁর ছবির বিবর্তনকে বুঝতে সুবিধা হয়। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালে বীরভূম জেলার সিউড়ি-তে। গ্রামীণ পরিবেশ ও লৌকিক শিল্পের আবহ শৈশব থেকেই তাঁর শিল্পচেতনাকে পরিপুষ্ট করেছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে পাশ্চাত্য রীতিতে চিত্রশিক্ষা করেন। শিল্পের আধুনিকতাবাদী আঙ্গিক সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হয় সেই সময়। ১৯৭৩ থেকে ’৭৮ তিনি তাঁর নিজের কলেজেই অধ্যাপনা করেন। আর্ট কলেজ ও ‘সোসাইটি’-র সূত্রেই ছাপচিত্রে তাঁর গভীর অনুশীলন ও অন্বেষণের সূচনা। ১৯৭৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত তিনি বিশ্বভারতী কলাভবনে গ্রাফিক্স বিভাগে শিক্ষকতা করেন। শান্তিনিকেতনের উত্তরাধিকার তাঁর মধ্যে ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন সচেতনতা জাগিয়েছে।

তাঁর গ্রাফিক্স-এ সংকটাপন্ন, সমস্যাসংকুল, গাঠনিক এক নাগরিক অস্তিত্বের প্রকাশ অনুভূত হয়। বিমূর্ততা সত্ত্বেও তাঁর এচিং ও লিথোগ্রাফের ছবিতে বাস্তবতার অন্তঃস্থ সংঘাতই ঝংকৃত হতে থাকে, আধুনিকতাবাদের যা প্রাথমিক লক্ষণ। শান্তিনিকেতনে লখনউ-এর কোম্পানি ঘরানার পাখির ছবির একটি সংগ্রহ তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। কালীঘাটের পটচিত্রের প্রতিও তিনি আগ্রহ অনুভব করেন। প্রদর্শনীতে এই পর্যায়ের কিছু ছবির দৃষ্টান্ত দেখেছি। এই সহজ লাবণ্যে পৌঁছানোর পথটি কিন্তু খুব সরল ছিল না। ১৯৮০-র দশকে তিনি যখন টেম্পারায় এই আঙ্গিক নিয়ে চর্চা করেছেন, তখন তাঁর সেই অবয়বী প্রতিমাপুঞ্জের ভিতর অনেক সময়ই মৃত্যুচেতনা ও তমসাবৃত সংক্ষুব্ধতার নানা লক্ষণ দেখা যেত। এবং সেটা হয়ে উঠত বাইরের বাস্তবের আলোড়নেরই প্রতীক। এই অন্ধকার আলোড়িত করতে করতে তিনি ক্রমান্বয়ে আলোর দিকে গেছেন। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে আলোকিত অভিব্যক্তির পাশাপাশি অন্তঃস্থ কালিমার কিছু প্রতীকও রয়ে গেছে।

নীল শাড়ি পরে চেয়ারের উপর বসে আছে এক মানবী। সামনে একটি টেবিল। তার উপর একটি বিড়াল। কৌতুকদীপ্ত দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। নির্মাণ-পদ্ধতি থেকেই উঠে এসেছে অনুপম প্রশান্তি। এই প্রশান্তির বিপরীতে আমরা দেখে নিতে পারি আর একটি ছবি। একটি মুখ দু’ভাগ হয়ে সামনের অংশটি মুখোশে রূপান্তরিত হয়েছে। ছিন্ন মুখের সঙ্গে মুখোশটি সেলাই করে আটকানো রয়েছে। মানুষের এই বিশ্লিষ্ট দ্বৈত-সত্তার মধ্যে আজকের বিপন্ন অস্তিত্বের করুণ স্পন্দন শোনা যায়। ঐতিহ্যের ভিতর থেকেই শিল্পী নিষ্কাশিত করেন আধুনিকতাবাদী সংকট ও সংঘাত।

আরও পড়ুন
Advertisement