চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

আঙ্গিকের মাধ্যমেই ব্যক্ত হয় উষ্মা ও জোরালো প্রতিবাদ

সম্প্রতি মায়া আর্ট স্পেসে অনুষ্ঠিত হল ‘বাংলা কার্টুন’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষকার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র বা কৌতুক-নকশা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এই চিত্র-আঙ্গিকটির অন্যতম উদ্দেশ্য হাস্যরস সৃষ্টি। নির্মল, সশ্রদ্ধ হাস্যরসের উপস্থাপনা যেমন এর একটি উদ্দেশ্য, তেমনই এই আঙ্গিকের ভিতর দিয়ে শিল্পী তাঁর উষ্মা এবং তীব্র প্রতিবাদও ব্যক্ত করেন। প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ কার্টুুনের প্রধান একটি উদ্দেশ্য। কার্টুুন রচনার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে স্বাভাবিকের বিকৃতিকরণ বা ডিস্টরশন। যা স্বাভাবিক, তা সব সময় দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১

কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র বা কৌতুক-নকশা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এই চিত্র-আঙ্গিকটির অন্যতম উদ্দেশ্য হাস্যরস সৃষ্টি। নির্মল, সশ্রদ্ধ হাস্যরসের উপস্থাপনা যেমন এর একটি উদ্দেশ্য, তেমনই এই আঙ্গিকের ভিতর দিয়ে শিল্পী তাঁর উষ্মা এবং তীব্র প্রতিবাদও ব্যক্ত করেন। প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ কার্টুুনের প্রধান একটি উদ্দেশ্য। কার্টুুন রচনার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে স্বাভাবিকের বিকৃতিকরণ বা ডিস্টরশন। যা স্বাভাবিক, তা সব সময় দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। স্বাভাবিককে ভাঙলে সেই আপাত-বিকৃতি সত্যকে প্রকট করে তুলতে পারে। এক সময় ‘কার্টুুন’ অভিধাটি বৃহত্তর চিত্রের পূর্ববর্তী নকশা হিসেবেও গণ্য হত। রাফায়েল সিস্টিন চ্যাপেলের জন্য এ রকম সম্পূর্ণ স্বাভাবিকতাবাদী উপস্থাপনায় বাইবেলের আখ্যানের প্রাথমিক খশরা করেছিলেন, যা পরে ট্যাপেস্ট্রিতে রূপান্তরিত হওয়ার কথা ছিল। এ রকম স্বাভাবিকতাবাদী রূপায়ণকে অবশ্য আজ আর কেউ কার্টুন বলে না।

মায়া আর্ট স্পেস গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ‘বাংলা কার্টুুন’ শিরোনামে প্রদর্শনী। পরিকল্পনা ও বিন্যাস করেছেন দেবদত্ত গুপ্ত। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়েছে ১৮৭২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বিভিন্ন পত্রিকা বা সাময়িক পত্রে প্রকাশিত কার্টুনের বিবর্তন। এ বিষয়ে অমৃতবাজার পত্রিকা ছিল পথিকৃৎ। এই প্রদর্শনীর প্রথম কার্টুুনটি এই পত্রিকার ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৭২ সংস্করণ থেকে নেওয়া। একজন ইংরেজ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের অশ্ব ও অশ্বচালক নিয়ে নির্মল কৌতুক। সঙ্গে চার লাইনের একটি বাংলা কবিতাও রয়েছে। স্বাভাবিকতাবাদী কার্টুনের আর একটি ধরন দেখা যায় ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথের একটি ছবিতে। শিরোনাম ‘রঙ্গালয়ের মহাদেব’। উপশিরোনামে ছবিটির বর্ণনা রয়েছে এ রকম ‘হস্তে টিনের ত্রিশূল, ভালে পঞ্চবর্তিকা শক্তিবিশিষ্ট ইলেকট্রিক ভাল্ব সহযোগে মদনভষ্ম করিলেন’। এখানেই কৌতুকের মধ্য দিয়ে পুরাণকল্প ও আধুনিকের সমন্বয় ঘটল।

Advertisement

অভিব্যক্তিবাদী বাংলা কার্টুনের প্রধান পথিকৃৎ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তৎকালীন নানা সামাজিক অসঙ্গতিকে ব্যঙ্গচিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি যে ভাবে সাধারণের মধ্যে প্রচার করেছিলেন, সামাজিক তাৎপর্যের দিক থেকে, কার্টুনের নান্দনিকতার দিক থেকেও তার স্বাতন্ত্র্য অবিসংবাদিত। এই প্রদর্শনীতে আমরা দেখি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত একটি ছবি। তাতে এক স্কুলমাস্টার একটি পাখিকে বলছেন: ‘পাখী তোর বসন্তের গান থামা, পড় বসে A B C D’। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের বিচ্ছিন্নতাকে কশাঘাত করেছেন শিল্পী। তাঁর ব্যঙ্গচিত্র সংকলন ‘বিরূপ বজ্র’ (১৯১৭), ‘অদ্ভুত লোক’ (১৯১৭), ‘নব হুল্লোড়’ (১৯২১) কার্টুনের জগতে দিকচিহ্ন স্বরূপ। এর কিছু কিছু ছবির প্রতিলিপি প্রদর্শনী কক্ষের ভিতরে ও বাইরে ছড়ানো ছিল। ‘প্রবাসী’তে ১৩২২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত অসিতকুমার হালদারের জলরঙের ছবিটিতে রন্ধনরতা গৃহবধূ ও শাশুড়ির ছবিটিকে সঠিক অর্থে কার্টুন বলা যায় কি না এ বিষয়ে সংশয় থাকে। এতে রূপাবয়বের ভাঙন নেই, ব্যঙ্গ বা কৌতুকও নেই।

সমসাময়িক কালে কল্পরূপাত্মক ভাঙনের মধ্য দিয়ে কৌতুক নকশা সৃষ্টিতে সুকুমার রায় ছিলেন অতুলনীয়। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় (শ্রাবণ ১৯২৯) প্রকাশিত তাঁর একটি কৌতুক-নকশায় তিনি তাঁর রচনার ধরন ব্যক্ত করেছেন এ ভাবে ‘ছবির টানে গল্প লিখি নেইক এতে ফাঁকি/ যেমন ধারা কথায় শুনি হুবহু তাই আঁকি’। সামাজিক দায়বোধে দীপ্ত প্রতিবাদী কার্টুনের দুই পথিকৃৎ শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোর। তাঁদের কার্টুন প্রকাশে ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকাটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এছাড়াও বহু শিল্পী কাঁফি খান, শৈল চক্রবর্তী, রেবতীভূষণ, পি. কে. এস. কুট্টি, রঘুনাথ গোস্বামী, চণ্ডী লাহিড়ি, অহিভূষণ মালিক প্রমুখ। রেবতীভূষণের একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে ইজেলের উপর কালো ক্যানভাস দাঁড় করানো। তাতে সাদা রেখায় আঁকা রয়েছে ফুল ও সাপের ছবি। নীচে লেখা ‘বাজেট ৮৩-৮৪’। সামনে দর্শক, পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন শিল্পী। উপরে লেখা ‘এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি’। বাংলা কার্টুনের জগৎ ক্রমান্বয়ে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement