চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

ধ্বনিত হয় সময় ও অস্তিত্বের হাহাকার

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিড়লা অ্যাকাডেমির বার্ষিক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষএই সময়ের তরুণ শিল্পীদের কাজে সাম্প্রতিকের দ্বন্দ্বসংকুল অনিকেত পরিস্থিতি প্রগাঢ় এক প্রতিবাদী পরিসর তৈরি করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী : রণজিৎ পাল।

শিল্পী : রণজিৎ পাল।

এই সময়ের তরুণ শিল্পীদের কাজে সাম্প্রতিকের দ্বন্দ্বসংকুল অনিকেত পরিস্থিতি প্রগাঢ় এক প্রতিবাদী পরিসর তৈরি করে। ঐতিহ্যগত আঙ্গিককে তাঁরা অনেক সময় রূপান্তরিত করেন। অনেক সময় ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে ‘রূপ’-এর নতুন ভাষ্য তৈরি করেন। যেভাবেই সঞ্চারিত হোক তাঁদের প্রকাশ, ‘ক্ষমতা’-র বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলাই হয়ে ওঠে সেই প্রকাশের প্রধান এক বৈশিষ্ট্য। তাঁদের লক্ষ্য খুব স্থির। কোনও অনিশ্চয়তা নেই সেখানে।

বিড়লা অ্যাকাডেমির বার্ষিক প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত ১১-জন শিল্পীর কাজ নিয়ে ‘স্বীকৃতি’ শিরোনামে যে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি তার মূল প্রবণতা অনেকটা এ রকম। প্রদর্শনীর স্মারকপত্রের ভূমিকায় জনি এম.এল যে অনিশ্চয়তার কথা লিখেছেন, তাঁর ভাষায় — ‘I could sense tremendous amount of uncertainity ruling these works’, সেটা আদৌ সমর্থনযোগ্য নেই। শিল্পীরা নিশ্চিতভাবেই কাজ করেছেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সে দিক থেকে আলোচ্য প্রদর্শনীটি খুবই সংহত ও সমৃদ্ধ।

Advertisement

উৎসব চট্টোপাধ্যায় দুটি ভিডিও দেখিয়েছেন। এর মধ্যে ‘লস/লস্ট’ শিরোনামে ৩২-মিনিটের রচনাটিকে পরিপূর্ণ ডকু-ফিচারই বলা যেতে পারে। অসামান্য মনন, সংবেদন ও দক্ষতায় তৈরি করেছেন এই ছবি, যাতে এই সময়ের অন্তর্লীন তীব্র হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে। যান্ত্রিকতা ও প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে ‘ক্ষমতা’ যে সর্বাত্মক ধ্বংসের আবহ তৈরি করেছে, তাতে কী ভাবে বিধ্বস্ত হচ্ছে মানবসত্তা, তারই কল্পরূপাত্মক ধারাভাষ্য তাঁর ছবিতে। দুটি চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিধাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ছবি। তার একটি স্বপ্ন সংক্রান্ত, ‘barotrauma’; আর একটি চর্মরোগ সংক্রান্ত, যার পারিভাষিক নাম ‘Vitiligo’। ভূমিকে মানুষ ক্ষতবিক্ষত করছে। সেই ক্ষতকে যেন নিজের শরীরে ধারণ করে একটি মানুষ স্বপ্নতাড়িত হয়ে ধ্বংসের নানা রূপ উন্মীলিত করছে। কাফকা অনুষঙ্গের এই রূপায়ণে এটিই মূল উপজীব্য। ‘কেদারা’ শিরোনামে ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের দ্বিতীয় ভিডিওটিও ‘ক্ষমতা’-র বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিধ্বস্ত এক যুবকের কাহিনি। দৃশ্যকলার পরিসর এভাবেই পরিবর্ধিত হচ্ছে সাম্প্রতিক তরুণ শিল্পীদের কাজে।

খগেশ্বর রাউত-এর টেরাকোটা ভাস্কর্য ঐতিহ্যগত টেরাকোটা থেকে একেবারেই আলাদা। স্বাভাবিকতা প্রকাশেরও নতুন অভিমুখ তৈরি করেছেন তিনি, যেমন ফল নিয়ে করা তাঁর ভাস্কর্য। কিন্তু তার মধ্যেও যেন অস্তিত্বের হাহাকার ধ্বনিত হয়। অনির্বাণ হালদারের ভাস্কর্যেও প্রচলিত মাধ্যম নতুন রূপে ব্যঞ্জিত হয়েছে। শনের দড়ি দিয়ে করা তাঁর নরম ভাস্কর্য বা লোহার তার ও কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি বিমূর্ত রচনা নতুন অভিব্যক্তি উৎসারিত করে।

অর্ক গোস্বামী’র আলোকচিত্র ‘ইম্প্রেশন-৩’ রচনায় বিমূর্ততা প্রধান্য পেয়েছে। যেখানে সময়ের বহুমাত্রিক সংকট প্রতিধ্বনিত হয়।

ছাপচিত্র বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছিলেন— রণজিৎ পাল, প্রিয়ম তালুকদার ও উজ্জয়িনী নন্দী। রণজিৎ এচিং ভিত্তিক একটি কাজের শিরোনাম দিয়েছেন ‘প্যাকেজিং অব লাইফ’। স্কুলের পোশাক পরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে শিশুরা। যান্ত্রিক সার্থকতার বিভিন্ন লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের উপর। উজ্জয়িনী-র একটি কল্পরূপাত্মক কাঠ খোদাইও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

পলাশচন্দ্র বৈদ্য খবরের কাগজের উপর কালি-কলমে কাটাকুটি করা রচনায় রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যকে প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে সাম্প্রতিকের দ্বন্দ্বসংকুলতায় অভিষিক্ত করেছেন। শ্রীনিবাস রাও দুগ্গাপু-র মাছ নিয়ে করা রচনাগুলিতে ঐতিহ্যগত আঙ্গিক সাম্প্রতিকের নতুন তাৎপর্যে অন্বিত। শিরোনামহীন একটি রচনায় এক যুবকের মুণ্ডহীন গলার ভিতর থেকে কলকল করে বেরিয়ে আসছে অজস্র মাছ। উপর থেকে ঝুলছে একটি নৌকা।

মনোজিৎ সামন্ত-র ‘এনিহোয়ার ডোর’ রচনাটিতে এক ব্যবসা-কেন্দ্রের অভ্যন্তরকে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন তলে পরিপ্রেক্ষিত বিন্যস্ত করেছেন। অনুচিত্রের আঙ্গিকের আধুনিকতাবাদী উপস্থাপনায় সাম্প্রতিকের অমানবিক জটিলতাকে পরিস্ফুট করেছেন। স্বাভাবিকতার সঙ্গে উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদী রীতিকে মিলিয়ে ছবি করেছেন দেবজ্যোতি দাস। আখ্যানমূলক রূপায়ণে তুলে এনেছেন এই সময়েরই অব্যক্ত হাহাকার।

আরও পড়ুন
Advertisement