পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

লেখকই হয়ে ওঠেন উপন্যাসের নায়ক

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি, ঢাকা থেকে কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের জীবন ও সাহিত্যসৃজন বিষয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তরুণ লেখক মাহমুদুল হকের সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক হিসেবে লেখকের জীবদ্দশায় তাঁর সংস্পর্শে আসেন এবং জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। আবু হেনা মোস্তফা এনাম। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ৩২০.০০

কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। আবু হেনা মোস্তফা এনাম। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ৩২০.০০

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি, ঢাকা থেকে কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের জীবন ও সাহিত্যসৃজন বিষয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তরুণ লেখক মাহমুদুল হকের সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক হিসেবে লেখকের জীবদ্দশায় তাঁর সংস্পর্শে আসেন এবং জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই আগ্রহেরই ফসল এই মনোগ্রাহী গ্রন্থ। রচনাপঞ্জি ও জীবনপঞ্জি ছাড়া বিভিন্ন সমালোচক তাঁকে নিয়ে যে সব আলোচনা ও মন্তব্য করেছিলেন, তাও সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে লেখক বহু পরিশ্রম করে তাঁর পারিবারিক জীবন, শৈশব ও প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরেছেন। সঙ্গে রয়েছে তাঁর রচিত নটি উপন্যাসে তাঁর মানস বিবর্তনের ইতিবৃত্ত। রয়েছে কিছু দুর্লভ ছবি ও চিঠিপত্র। মাহমুদুল হক বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ভুবনে তাঁর সৃজনের স্বতন্ত্র নির্মাণকৌশল ও বিষয়ের গুণে হয়ে উঠেছিলেন শীর্ষ কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীলতার ব্যাপ্তি মাত্র এক দশক।

এক দিকে অসম্ভব গতিশীল ও জাদুময় সংলাপ সৃজন, অন্য দিকে চরিত্রের মনোজাগতিকতা পরিস্ফুটনে নানা উপচার, নন্দন ভাবনার বিভিন্ন প্রকৌশল এবং তা উপস্থাপনের ঐশ্বর্যময় ভাষা আয়ত্ত করে মাহমুদুল হক অত্যন্ত সচেতন অভিনিবেশে একটি রুচিশীল সাহিত্যিক গদ্য নির্মাণে অন্বেষী হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে, পশ্চিমবঙ্গের বারাসতে, মৃত্যু ২২ জুলাই ২০০৮ সালে ঢাকায়। মানবজীবনের জটিলতাকে তিনি বহুতলস্পর্শী শৈল্পিক দক্ষতায় তাঁর রচিত উপন্যাস ও ছোটগল্পে উপস্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত তাঁর খেলাঘর মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে ভিন্নতর মাত্রা নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া দেশভাগকে অবলম্বন করে রচিত কালো বরফ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে মানবিকতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিল। সর্বমোট নয়টি উপন্যাস ও সত্তরটি গল্প নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। জীবনের অন্তিম দশটি বছর তিনি লেখেননি। প্রতিষ্ঠা ও তরুণ গোষ্ঠীর শ্রদ্ধা-ভালবাসা পাওয়া সত্ত্বেও তিনি লেখালিখি নিয়ে কোনও কথা বলতে চাইতেন না। একদা মানুষটির বন্ধুবৃত্ত ছিল বিরাট। সেই মানুষটি শেষ জীবনে হয়ে পড়েছিলেন বান্ধবহীন, নিঃসঙ্গ। তিনি যখন মৃত্যুতে ঢলে পড়েন তখন ছিলেন প্রায় কপর্দকশূন্য।

Advertisement

আমরা যারা তাঁর মুগ্ধ পাঠক ও তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, তাঁকে চিনতাম এক আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক অঙ্গীকারবদ্ধ কথাসাহিত্যিক হিসেবে। তিনি যখন সরে এলেন লেখার জগৎ থেকে এবং সৃজন উদ্যানকে তুচ্ছজ্ঞান করে অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিকতায় নিমগ্ন হলেন এবং সন্ন্যাসীসুলভ নৈর্ব্যক্তিকতায় জগৎ সংসার সম্পর্কে কথা বলতেন। আমরা তাঁকে এই সময় চিনতে পারতাম না। এই সময় তিনি এক পিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আমরা এ হিসাব কোনও দিন মেলাতে পারিনি।

সত্তর দশকের প্রথম দিকে তাঁর প্রথম উপন্যাস অনুর পাঠশালা প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি বৃহত্তর পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। বিশেষত, তাঁর ভাষার ভিন্ন নির্মিতি ও বোধ সংলাপ হয়ে ওঠে প্রচলিত ভাষায় বিপরীতে ভিন্ন মাত্রার। যদিও পরবর্তী কালে তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাসটিকে সৃজন উৎকর্ষের দিক থেকে কোনও গুরুত্ব দেননি। এটি রচিত হয় ১৯৬৭ সালে; কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে বই হিসেবে বের হল ১৯৭৩ সালে। এই বইটি তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। ন’টি উপন্যাসে তিনি জীবনের জটিলতা এবং মানবমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলিকে যে ভাবে ছুঁয়ে গিয়েছেন তা শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনকে দীপ্ত করেনি, শৈল্পিক গুণেও তা অনন্য।

দ্বিতীয় উপন্যাস নিরাপদ তন্দ্রা। প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তৃতীয় বই জীবন আমার বোন। এই বইটি প্রকাশের পরই বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতায়, বিষয়, প্রকরণ ও গদ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। কালো বরফ উপন্যাসটিতে তাঁর স্বাতন্ত্র্য হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময়। দেশবিভাগ নিয়ে এমন বিষাদমণ্ডিত গ্রন্থ তখনও বাংলাদেশে বের হয়নি। এই বইটি তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। দেশভাগ মানুষের মনকে যে শূন্যতায় নিয়ে যায় এবং হৃদয়ে মানস-প্রতিক্রিয়ায় যে আউটসাইডার বোধ সৃষ্টি করে জীবনচর্যায়, জন্মভূমি ও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে আসা মাহমুদুল হক যেন স্বয়ং হয়ে ওঠেন এই উপন্যাসেরই নায়ক। দ্য প্লেগ-এর রিউ, পুতুলনাচের ইতিকথা-র শশী ও কালো বরফ-এর আবদুল খালেক আমাদের চেতনালোকে একাকার হয়ে থাকে। সারা জীবন তাঁকে কি তাড়া করে ফিরেছে দেশত্যাগের বেদনা ও এক অস্থিরতা? কোথাও তিনি থিতু হলেন না। শিকড়ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সংসারে না, জীবিকায় না, সম্ভাবনাময় ব্যবসায়ী হিসেবে যে আত্মপ্রকাশ হয়েছিল সেখানেও না।

সে জন্যই বোধ করি আশির দশকের প্রথম দিকে তিনি জন্মভূমি বারাসতের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। কলকাতায় গিয়ে বন্ধু ও সখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে দিবারাত্রি পাঁচ দিন আড্ডা দিয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়। বারাসত আর যাননি। সেই বারাসতের গ্রামকে দেখতে পাবেন না এই আশঙ্কায় যন্ত্রণা ও কষ্টকে ধারণ করে ফিরে আসেন ঢাকায়।

গ্রন্থটি বৃহত্তর পাঠকের কাছে আদৃত হবে এবং পাঠক বিরলপ্রজ এই লেখক সম্পর্কে অবহিত হবেন এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

আরও পড়ুন
Advertisement