কল্পরূপ: অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত ধীরেন শাসমলের প্রদর্শনীর একটি ছবি
আমাদের চিত্রকলায় দেশীয় ঐতিহ্যগত আত্মপরিচয় সন্ধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের গোড়া থেকে। তা থেকে জেগে উঠেছিল একটি বিশেষ ঘরানা, যা ‘নব্য ভারতীয় ঘরানা’ নামে পরিচিত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু ছিলেন এর সূচনা পর্বের প্রধান পথিকৃৎ। পরবর্তী কালে এই চিত্ররীতি নানা বৈচিত্রে প্রসারিত হয়েছে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা ঐতিহ্যে বিবর্তিত হয়েছে।
এখনকার যে সব শিল্পীর মধ্যে এই বিবর্তিত ঐতিহ্যের প্রকাশ দেখা যায় ধীরেন শাসমল তাঁদেরই একজন। রূপকথার জগৎ ও লৌকিক সারল্যের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আগ্রহ তাঁকে বাস্তব-অতিক্রান্ত কল্পরূপের জগতের দিকে আকৃষ্ট করেছে। এই কল্পরূপাত্মক অলঙ্করণের বোধ সব সময়ই তাঁর ছবির আঙ্গিক নিয়ন্ত্রণ করেছে।
অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ২৯টি ছবি নিয়ে তাঁর একক প্রদর্শনী। নানা বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। পুরাণকল্পমূলক বিষয় আছে যেমন শিশু-কৃষ্ণ, দেবী দুর্গা ইত্যাদি। কাল্পনিক বিষয় আছে যেমন জলদেবী। ফুল, ফুলদানি যেমন আছে, তেমনই আছে মাছ, ঘোড়া ইত্যাদি। রৈখিক অলঙ্করণময়তা তাঁর সমস্ত ছবিরই বৈশিষ্ট্য। অলঙ্করণ এবং কল্পরূপের প্রয়োজনে তিনি বিষয়ের স্বাভাবিক আয়তনকে পরিবর্তিত করেছেন। যেমন শিশু-কৃষ্ণ যখন এঁকেছেন তাঁর শরীর, হাত পা হ্রস্ব করেছেন। তুলনায় মাথাটি যেন একটু স্ফীত হয়েছে। অনুপাতের এই পরিবর্তন প্রচ্ছন্ন কৌতুকের মধ্যে কল্পরূপাত্মক সৌন্দর্যের বিশেষ এক মাত্রা এনেছে। মাছের রূপায়ণ সম্পর্কেও এ কথা সত্য। এ ভাবে আকৃতি পরিবর্তন করে ছন্দের বিশেষ বিন্যাস তাঁর ছবিকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে।
প্রাচ্য লৌকিক আঙ্গিকের সঙ্গে তিনি খুব সন্তর্পণে পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত তাঁর আঁকা ফুলগুলি। ফুলের বৃন্ত, পাপড়ি ও কেশরগুলিকে তিনি এমন ভাবে স্ফীত ও বহুমাত্রিক করেছেন যাতে তা স্বাভাবিক পার্থিব ফুলের রূপ অতিক্রম করে অপার্থিবতায় অভিষিক্ত হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রণা পরিস্ফুট হচ্ছে। এখানেই তিনি ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারকে প্রসারিত করেছেন। ঐতিহ্যগত আত্মপরিচয় এভাবেই রূপান্তরিত হচ্ছে।
সব ছবিতে অবশ্য রূপের এই সংহতি তিনি বজায় রাখতে পারেননি। রূপাবয়ব আলুলায়িত হয়েছে। ঘোড়ার রূপায়ণগুলি এই সীমাবদ্ধতার অন্যতম দৃষ্টান্ত।